ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমরা চাই সবাই আমাদের মানুষ ভাবুক

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১৩ জুন ২০১৫

আমরা চাই সবাই আমাদের মানুষ ভাবুক

শর্মী চক্রবর্তী ॥ এই পৃথিবীতে মানুষ হয়ে জন্ম নেয়ার পর নারী অথবা পুরুষ চিহ্নিত না হত্তয়ার কারণে এ সমাজের স্বাভাবিক জীবনযাপনে তাদের ঠাঁই হয় না । তাদের আশ্রয় নিতে হয় এই সমাজেরই অচ্ছুৎ অপাংক্তেয় ডেরায়। যে শ্রেণীর নাম দেয়া হয়েছে হিজড়া । এদের জীবন বড়ই করুণ। সে জীবন বঞ্চনা, অবহেলা আর ঘৃণায় থাকে ভরপুর। তাদের জন্মও হয় স্বাভাবিক নিয়মে এই সমাজেরই মূল ধারায়, মা-বাবার গর্ভে। কিন্তু জন্মের পর ধীরে ধীরে বড় হওয়ার পথে একটা পর্যায়ে নিজ বাবা-মা, ভাই- বোন, আতœীয় স্বজন থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। জন্মদাতা মা-বাবা ঠিকই থাকে পরিচয়সূত্রে, কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে তাদের ¯েœহ-ভালবাসা, আদর-যতœ ক্ষীণ হয়ে যেতে থাকে মনের অলক্ষ্যে। আপন পারিবারের সদস্যদের ছেড়ে তারা গড়ে তুলে নিজেদের ভুবন। সেই ভুবনে থাকে এমনই অনেক মানুষ। তাদের কষ্টের শেষ নেই। একদিকে তারা চাইলেও অনেক কিছু পায় না অন্যদিকে এই সমাজের মানুষ তাদের অবহেলা করে। তাদের মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না। বাংলাদেশে বেসরকারী হিসেবে প্রায় ১৫ হাজার হিজড়া জনগোষ্ঠী রয়েছে। এদের সামাজিকভাবে গ্রহণ না করার কারণেই চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ নানা স্থানে বিভিন্নভাবে বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয় তাদের। হিজড়ারা এবং তাদের নিয়ে যেসব সংস্থা কাজ করে তারা দীর্ঘদিন ধরেই এদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে এবং তারা এই স্বাীকৃতিও পেয়েছে। তারপরও তাদের প্রতি মানুষের অবহেলা কমেনি। অনেক জায়গায় তারা প্রবেশ করতে পারে না। সরকার হিজড়াদের ট্রাফিকে নিয়োগ দেয়ার জন্য ভাবলেও এতে তারা রাজি নয়। কারণ তারা আদিকাল থেকে যে কাজ করে আসছে সেটি ছাড়া আর কোন কাজে যেতে চায় না। গান নাচ করে টাকা তুলেই তারা জীবন কাটাতে চায়। বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৫ হাজার হিজড়ার বসবাস। এই ১৫ হাজার হিজড়ার জীবন লাখো দুঃখে ভরপুর। কিন্তু তাদের দুঃখগুলো এক জায়গাতেই। তারা এ সমাজের মানুষের নিন্দা আর বঞ্চনার শিকার। পরিবার থেকে তারা আলাদা। সমাজ দিতে চায় না মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি। এরা অনেক সময় নিজের দুঃখগুলো বলে। বলতে গিয়ে খুলে নিজের কষ্টের ঝাঁপি। কষ্টের কথা বলতে গিয়ে মুহূর্তেই অন্ধকার হয়ে যায় হাস্যোজ্জ্বল মুখ। মনে হয় দুঃখ নামের কোনো অক্টোপাস তাদের চারদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। রাজধানী মগবাজারের একটি সরু গলি। মাংস আর মুরগির একাধিক দোকানের সমাহার সেখানে। সেই গলির ভেতরেই বসবাস করেন হায়দার হিজড়া। বয়স প্রায় ৫০-এর কোটায়। তার অধীনে আছে প্রায় ২শ’ থেকে ২৫০ জন হিজড়া। এতোটা কষ্ট নিয়েই তারা বেঁচে আছে যে বলতে গিয়ে আটকে যায় সবাই। শুক্রবার সকালে সেখানে গিয়ে কথা হয় হায়দার হিজড়ার সঙ্গে। জামালপুর থেকে আসা হায়দার হিজড়া একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলেছেন মগবাজারে। তার কাছে যারা আছে তাদের সন্তানের মতো আগলিয়ে রেখেছেন। তিনি বাকি সবার গুরু। তার সুন্দর একটা জীবন ছিল। পরিবার ছিল। ছোটবেলা থেকে পরিবারের সঙ্গে বসবাস করত। যখন তিনি তার শারীরিক পরিবর্তন বুঝতে পারলেন তখন নিজে থেকেই পরিবার থেকে আলাদা হয়ে যান। ঢাকায় এসে নতুন জীবন শুরু করলেন। তিনি বলেন আমাদের এই জীবনটা অভিশপ্ত। সবার কাছেই আমরা শুধু ঘৃণা আর লাঞ্ছনাই পেয়ে আসছি। কেউ আমাদের ভাল চোখে দেখে না। আমরা টাকা তুলি, খাবার তুলি এজন্য কেউ আমাদের দেখতে পারেন না। কিন্তু আমাদের কষ্টটা কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না। আমরা কোন ভাল জায়গায় যেতে পারি না। কারও সঙ্গে মিশতে পারি না। ছোটবেলা থেকে অবহেলা পাওয়ার কারণে পড়ালেখাও করতে পারিনি। তাহলে আমরা চলব কি করে। এছাড়া আমাদের আদি পেশা হিসেবে নাচ গান করে আসছি এইটা ছেড়ে দিলে তো আমরা বাঁচতেই পারব না। হায়দার বলেন, আমরা এই সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদা পেয়েছি সবাই বলে। কিন্তু এর কার্যকারিতা তো নেই। আমার বয়স হয়েছে কিন্তু আমি বয়স্ক ভাতা পাই না তাহলে কোথায় পেলাম স্বীকৃতি? সবাই বলে হিজড়াদের আচরণ ভাল না তারা বকাবকি করে। রাস্তায় দেখলেই টাকা চায়। কিন্তু এসবের আগে কি হয় সেটাকি কেউ কখনো দেখেছে। যখন কেউ আমাদের সঙ্গে খারাপ ভাবে কথা বলে তখনই আমরা খারাপভাবে উত্তর দেই। এছাড়া গায়ে পরে ওই মানুষরা খারাপ ব্যবহার করে আমাদের সঙ্গে। আমরা টাকা চেয়ে পেট চালাই সবার কাছে হাত পাতি এটার জন্যই এমন করে সবাই। এছাড়া কি করব সভ্য সমাজে তো আমাদের মতো হিজড়াদের কোন স্থান নেই। সবাই আমাদের বলেদিক কোথায় যাব আমরা। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল হায়দারের। তিনি বলেন, এই ঢাকা শহরে বসবাস করি। কিন্তু নিজের দেশে বড় শপিংমল বসুন্ধরা সিটিতে যেতে পারি না। সেখানে আমাদের যাওয়া নিষিদ্ধ। আমরা কি ঘুরতেও সেখানে যেতে পারি না। আমাদের কি চাওয়া পাওয়া থাকতে পারে না। কিন্তু না সেখানে যেতে দেয়া হয় না। আমাদের জন্য যদি এতো কিছুই করা হয় তাহলে এতো বাধা কেন। আমরা কেন আর দশজনের মতো নই। এটা আমাদের সবার প্রশ্ন। তিনি আরও বলেন, স্বামী নাই, সন্তান নাই, সংসার নাই, বেঁচে আছি খুব কষ্টে। অন্যের সন্তানের জন্মতে আমরা খুশি হয়ে নাচ গান করি। অন্যের সন্তানদের লালন পালন করি। আমার এই কষ্ট কি কেউ মুছতে পারবে? স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে গেলেও অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের কেউ ভাড়া দিতে চায় না। কোন চাকরি দিতে চায় না। আমি খুব কষ্টে তিলে তিলে আমার শিষ্যদের জন্য এই আশ্রয়টা করেছি। যারা কোথাও স্থান পায় না তাদের নিয়ে আমি এখানে বসবাস করি। শুধু তাই নয় বাইরে গেলে মানুষ আমাদের বিভিন্ন ধরনের কথা বলে। পোশাক নিয়ে কথা বলে। আমাদের দুর্বলতায় আঘাত করে। এসব শোনার পরও আমরা অনেক কষ্টে নিজেদের মতো বাঁচার চেষ্টা করছি। আমরা তো ইচ্ছে করে হিজড়া হইনি। তিনি আরও বলেন, আমরা যেমন কষ্ট লাঞ্ছনা সহ্য করে এই সমাজে চলছি আমাদের মতো পরবর্তী প্রজন্মের কেউ যেন এমন অবহেলার শিকার না হয়। তাদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব কিছুর ব্যবস্থা করা হলে তারা আমাদের মতো জীবন কাটাবে না। এই জীবনে অভিশাপ ছাড়া আর কিছুই নেই। মগবাজারে থাকা সেই হিজড়াদের কেউই ট্রাফিকে কাজ করতে চায় না। মনের দুঃখে তারা বলে আমাদের কাজ দিতে হলে র‌্যাবে বা পুলিশে কাজ দেয়া হোক। এই দু’টার একটাতে কাজ দেয়া হলে আমরা করব অন্য কিছুতে করব না। হিজড়াদের একজন সোনালী। অনেক বছর ধরে হায়দার হিজড়ার সঙ্গে থাকে। নাচ আর মডেলিং করেন তিনি। কাজের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, অবহেলা আর বঞ্চনার জন্য পড়ালেখা করতে পারিনি। তখন থেকে নাচটাকে পেশা করে নিয়েছেন। নিজের জীবনের পাওয়া কষ্টগুলো থেকে তিনি বলেন, এই জীবনটা অনেক কষ্টের এখানে কোন সুখ নেই। আমি জীবনে অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। আমি চাই হিজড়াদের জন্য পড়ালেখার পথটা যেন সুগম হয়। তারা আর দশ জনের মতো চাকরি করতে পারে। আমরা যেভাবে আলাদাভাবে বেঁচে আছি এইভাবে যেন কেউ না থাকে পরিবারের সঙ্গে থেকে ভালভাবে বেড়ে ওঠতে পারে। আর সবার প্রতি একটাই অনুরোধ আমাদের সবার আমাদের হিজড়া না ভেবে মানুষ ভাবেন। তাহলে আমরা আমাদের কষ্টগুলো নিয়েই এই সমাজে সবার সঙ্গে চলতে পারব।
×