ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৯৪ শতাংশ মৃত্যুই অস্বাভাবিক ;###;প্রতিদিন গড়ে আট থেকে দশ প্রবাসীর লাশ আসছে ;###;বেশিরভাগ মৃত্যুই স্ট্রোক, সড়ক দুর্ঘটনা ও অগ্নিকাণ্ডে;###;বিশেষজ্ঞের মতে, মৃত্যুর প্রধান কারণ মানসিক চাপ ও কর্মপরিবেশ

মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ॥ ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৩ জুন ২০১৫

মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজার ॥ ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ

কাওসার রহমান ॥ মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকের কাজ এবং থাকার পরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। প্রায়শই অগ্নিকা- কিংবা অন্য কোন দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে শ্রমিকের। ফলে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পরিবারে উদ্বেগ বাড়ছে। দেশে ফেরত আসা মৃত শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যায়, ৯৪ শতাংশ প্রবাসীই অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোকে। মূলত পাঁচটি কারণে বাংলাদেশীরা স্ট্রোক বা হৃদরোগের মতো সমস্যায় পড়েন। সম্প্রতি সৌদি আরবের আল হাসায় সড়ক দুর্ঘটনায় রহমত উল্লাহ (৩৫) নামে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হয়েছেন। রাতে কর্মস্থল থেকে বাইসাইকেলে বাসায় ফেরার পথে দ্রুতগামী একটি বাস তাকে পেছন থেকে চাপা দেয়। এ সময় তিনি গুরুতর আহত হন। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় কিং ফাহাদ হাসপাতালে নেয়া হয়। দুইদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে তিনি মারা যান। নিহত রহমত উল্লাহর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে। সৌদি আরবের আল হাসা এলাকায় একটি দোকানে সে কাজ করত। সম্প্রতি ওমানে একটি কারখানায় আগুনে পুড়ে চার বাংলাদেশীসহ ছয়জন মারা গেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শিল্পনগরী মোসাফফাহতে অগ্নিকা-ে ১০ জন নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশী। এর কিছুদিন আগে সৌদি আরবে অগ্নিকা-ে দুই বাংলাদেশী শ্রমিক মারা যায়। গত কয়েক বছরের সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকের মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, যাদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্যে। সরকারী হিসেবেই ২০১৩ সালে ৩০৭৫ বিদেশে কর্মরত শ্রমিক মারা গেছে। এদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সৌদি আরবে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়াতেও কর্মরত অনেক শ্রমিক মারা গেছে। শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, ছয় বছরে প্রায় ১৪ হাজার বাংলাদেশী প্রবাসীর মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই গড়ে আট থেকে দশ প্রবাসীর লাশ আসছে দেশে। জানুয়ারিতে এসেছে ২৪৯টি লাশ। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর এক দিনেই লাশ হয়ে দেশে ফেরেন ১৫ প্রবাসী শ্রমিক। এর মধ্যে ১০ জনের লাশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এই ১৫ জনের মধ্যে আটজন মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আর পাঁচজন দুর্ঘটনায়। এদের গড় বয়স ৩৮। ২০০৮ থেকে ২০১৩- এই ছয় বছরে ৫৬টি দেশ থেকে লাশ এসেছে ১৩ হাজার ৮৭২ প্রবাসীর। এর আগে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এসেছে ছয় হাজার ১৭টি লাশ। আরও আগে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিন হাজার ৬১৩ প্রবাসী শ্রমিকের লাশ আসার তথ্য আছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। সরকারী পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ছয় বছরে মোট ১৩ হাজার ৮৭২ প্রবাসীর লাশের মধ্যে চার হাজার ২০৯ জনের লাশই (৩০ শতাংশ) এসেছে সৌদি আরব থেকে। সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। ছয় বছরে এই সংখ্যা দুই হাজার ৩২৭ (১৬ শতাংশ)। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ছয় বছরে এসেছে দুই হাজার লাশ, কুয়েত থেকে ৮৮৬, ওমান থেকে ৬৬৪, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫২৩, ভারত থেকে ৪১০, বাহরাইন থেকে ৩৭৪, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩৪৫, কাতার থেকে ৩০৩, সিঙ্গাপুর থেকে ২৯৯, ইতালি থেকে ২৭৩, যুক্তরাজ্য থেকে ১৯৩, লেবানন থেকে ১৩১, লিবিয়া থেকে ১১৫, পাকিস্তান থেকে ১০২ এবং থাইল্যান্ড থেকে ৬৯ জন লাশ হয়ে ফিরেছেন। বাকি লাশ এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে। প্রবাসীদের লাশ এলে মৃত্যুর কারণ লিখে রাখা হয় বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কে। ২০১৩ সালে মারা যাওয়াদের মধ্যে দুই হাজার ৪৯৬ প্রবাসীর মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মাত্র ১৫৯ জনের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যুর হার মাত্র ৬ শতাংশ। ৯৪ শতাংশ প্রবাসীই অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোকে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ৭৪৯, অর্থাৎ ৩০ শতাংশ। হৃদেরাগে আক্রান্ত হয়ে ৪৭০, কর্মক্ষেত্রে ও সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬, অসুস্থতায় ২৯৮, ক্যান্সারে ৬২ এবং আগুনে পুড়ে ২৬ জন মারা গেছেন। আর ১৯ জন আত্মহত্যা এবং নয়জন খুন হয়েছেন। ২০ জনের মৃত্যুর কারণ অজানা। একইভাবে ২০১২ সালে মারা যাওয়া দুই হাজার ৩৭৭ জনের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে দেখা গেছে, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ১৫২ জনের (৬ শতাংশ)। স্ট্রোকে ৭৩০, হৃদরোগে ৩৩৬, অসুস্থতায় ২৫২, দুর্ঘটনায় ৭৫২, ক্যান্সারে ৫৬ ও আগুনে পুড়ে মারা যান আটজন। এছাড়া ১৩ জন খুন হয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন নয়জন। ৯৬ জনের মৃত্যুর কারণ অজানা। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদেশ থেকে যাদের লাশ আসছে তাদের ৯৪ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এদের ৩০ শতাংশ মারা গেছেন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে। অন্যরা হৃদরোগ, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, সড়ক দুর্ঘটনা, ক্যান্সার, আত্মহত্যা কিংবা প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন। অনুসন্ধান করে জানা যায়, মূলত পাঁচটি কারণে বাংলাদেশীরা স্ট্রোক বা হৃদরোগের মতো সমস্যায় পড়েন। এগুলো হলো প্রতিকূল পরিবেশ, যে বিপুল টাকা খরচ করে বিদেশে যান, সেই টাকা তুলতে অমানুষিক পরিশ্রম এবং একই সঙ্গে বাড়িতে টাকা পাঠানোর চিন্তা, দিনে ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকা, দীর্ঘদিন স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সব মিলিয়ে মানসিক চাপের কারণেই সাধারণত স্ট্রোক বা হৃদরোগের মতো ঘটনা ঘটছে। দীর্ঘদিন সৌদি আরবে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করে এখন ঢাকার ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মাছুম সিরাজ। সৌদি আরবে কেন এত বাংলাদেশী স্ট্রোক বা হৃদেরাগে মারা যান, জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যে প্রচ- গরম। সেখানে তাপমাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডিগ্রী পর্যন্ত থাকে। আমাদের শ্রমিকরা যে পরিবেশে সেখানে কাজ করছেন, সেটা অমানবিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্রম আইন মানা হয় না। আবার তারা যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকেন সেখানে অনেকেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যান।’ তিনি মনে করেন, কাজের পরিবেশ বা থাকার পরিবেশ উন্নত করা ছাড়া এই মৃত্যু বন্ধের কোন উপায় নেই। অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার জানান, প্রবাসীদের এমন মৃত্যু মানা যায় না। যে বয়সে তারা মারা যাচ্ছেন সেই বয়সে হৃদেরাগ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে মারা যাওয়াটা স্বাভাবিক নয়। তারা যে পরিবেশে কাজ করছেন, যে মানসিক চাপ নিচ্ছেন, সেটাই মৃত্যুর বড় কারণ। সরকারের উচিত, সমস্যাটিকে গুরুতরভাবে নিয়ে এর সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কারাম এশিয়া। এর সমন্বয়ক হারুন-অর-রশিদ জানান, এত প্রবাসীর মৃত্যু মর্মান্তিক। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বলে আসছি, শ্রমিকের কাজের পরিবেশ উন্নত করা হোক। নিয়মিত ছুটি দেয়া হোক। তাদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেয়া হোক। কিন্তু কেউ তা শুনছে না। সৌদি আরবের সাংবাদিক রুমী সাঈদ জানান, বর্তমানে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। যেটি বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, সরকার কর্তৃক নির্ধারিত যেসব জায়গা শ্রমিকের কর্মস্থল হিসেবে বিবেচিত সেগুলো বেশ নিরাপদ। কিন্তু আমাদের দেশের শ্রমিকরা এখানে এসে নিজেরাই ফ্যাক্টরি খুলে বসে। নিজেদের বাসায় তারা বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। ওই জায়গাগুলো নিরাপদ নয়। এর কারণে অগ্নিকা- ঘটে। তিনি জানান, কিছু জায়গায় একসঙ্গে অনেক বেশি মানুষ বসবাস করেন। অনেক সময় মালিকরা অল্প জায়গায় বেশি শ্রমিক রাখার ব্যবস্থা করে। তিনি বলেন, বাংলাদেশী শ্রমিকের অসচেতনতার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা হয়। অভিবাসনবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, অনেক শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ পায় না। যেসব শ্রমিকের অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং থাকার পরিবেশ ভাল নয় তাদের ক্ষেত্রেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বড় ফ্যাক্টরিতে কাজ করা কিংবা কোম্পানির ভিসা নিয়ে গেলে কাজ এবং থাকার কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু যারা ফ্রি ভিসা নিয়ে সেখানে যাচ্ছে অর্থাৎ যাদের নির্দিষ্ট কোন কাজ নেই তাদের অনেকেই ঝুঁকিতে পড়েন। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে ফ্রি ভিসায় জনশক্তি পাঠানোর সংখ্যা বেড়েছে। মূলত এই ফ্রি ভিসায় যাওয়া শ্রমিকরাই থাকে অত্যন্ত মানবেতর পরিবেশে। এদের কাজের কোন ঠিক নেই। আজকে তাদের নিয়ে যায় খেজুর গাছ পরিষ্কার করাতে, আর আগামীকাল নিয়ে যায় কোন স্কুলের টয়লেট পরিষ্কার করাতে। এসব শ্রমিককে প্রতিদিন লম্বা সময় ধরে কাজ করতে হয়। বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র হলো মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ। তবে এর মধ্যেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মালোয়শিয়া। আরব দেশগুলোতে কর্মরত আছে সাড়ে ৫৮ লাখ ৫৪ হাজার বাংলাদেশী; যা বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ৮২ শতাংশ। এসব দেশে কর্মরত সিংহভাগ অদক্ষ ও আধাদক্ষ শ্রমিক। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার ১২টি দেশে বাংলাদেশের জনশক্তির বড় বড় বাজার রয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত, ওমান, সিরিয়া, মিসর, বাহরাইন, লিবিয়া ও জর্দান। অন্যদিকে দেশের মোট রেমিটেন্সের শতকরা ৬১ ভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। গবেষক বেলায়েত হোসেনের মতে, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতর ‘হৃদপি-’ হলো এই শ্রমবাজার। এ খাত থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশে আসছে সেটা এক শ’ ভাগ বাংলাদেশে থাকছে এবং বাংলাদেশের কাজে লাগছে। অন্যান্য খাত থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তার সিংহভাগই এসব খাতের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় করতে হয়। শ্রমবাজার থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশকে একটি ভিশন দেখাচ্ছে। আর সেই ভিশন হলো বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যে মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখছে তার মূল ভিত্তি এই শ্রমবাজার। তাছাড়া বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে যে ভৌত অবকাঠামো ও ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ তৈরির প্রয়োজন তারও ভিত্তি এই শ্রমবাজার। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, কোন ধরনের সমস্যায় পড়ে বাংলাদেশী দূতাবাসের দ্বারস্থ হলে বেশিরভাগ সময় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত সাড়া পাওয়া যায় না। মালয়েশিয়া থেকে ফোনে তারা জানান, সেখানে অবস্থানরত প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশীর মধ্যে ২০ লাখেরও বেশি অবৈধ। যখন এসেছিল তখন হয়ত পর্যটক ভিসা বা স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে গিয়েছিল। পরে কাজে যোগ দিয়ে এক সময় অবৈধ হয়ে যায়। আর এখন ধরা পড়ার ভয়ে যে যেখানে পারছে লুকিয়ে থাকছে। দেশে ফেরা বা তাদের বিষয় নিয়ে মালয়েশিয়ান সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করতে সেখানকার বাংলাদেশী দূতাবাসের কোন সহযোগিতা নেই বলে জানান অধিকাংশ প্রবাসী। একই রকম অবস্থা সৌদি আরবে কর্মরত বাংলাদেশীদেরও। বেশ কয়েক সৌদি প্রবাসী জানান, তাদের কাগজপত্র ঠিক করা, আকামা তৈরি করাসহ নানা বিষয়ে দালালের খপ্পরে পড়ে একদিকে যেমন বিপুল অর্থ খরচ হয় অপরদিকে হতে হয় হয়রানির শিকার। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতার ব্যাপারে তারা মালয়েশিয়া প্রবাসীদের মতো একই অভিযোগ করেন। তাদের অভিযোগ, দূতাবাস কর্মকর্তারা তাদের তেমন সহযোগিতা করেন না। একই ধরনের অভিযোগ করেন আরব আমিরাতের প্রবাসীরা। তাদের অভিযোগ, দুর্ঘটনায় নিহতদের খোঁজ নেয় না বাংলাদেশী দূতাবাস। উদাহরণ হিসেবে তারা জানান, গত ১৯ মার্চ দুবাই আল বর্ষায় কর্মরত অবস্থায় মাথায় আঘাত লাগলে মোতালেব (২৭) ২য় তলা থেকে নিচে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ সময় কোম্পানির লোক পুলিশকে ফোন করলে পুলিশ নিহতের লাশ পুলিশী তদন্তের জন্য নিয়ে যায় আল বর্ষা পুলিশ স্টেশনে। মোতালেবের বাড়ি চাঁদপুর জেলায়। কিন্তু তার সম্পর্কে আর কোন বিস্তারিত জানা যায়নি। সে এমি টেকনিক্যাল সার্ভিস নামে কোম্পানিতে আসে আরব আমিরাতে কাজের জন্য। মোতালেবের কোম্পানি থেকে তাদের কাজের জন্য নিয়ে আসা হয় গোল্ডেন ফ্যালকন সাপ্লাই কোম্পানিতে। ওই দিনই নতুন কোম্পানির কাজে যোগদান করেন মোতালেব। অথচ দুবাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোন খবর নেই। শুধু তাই নয়, মোতালেবের মৃত্যুর ৫দিন হয়ে গেলেও তার কোন খবর নেয়নি বাংলাদেশ দূতাবাস। তবে দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তারা এই অভিযোগ মানেন না। তাদের কেউ কেউ বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যত বাংলাদেশী কাজ করছেন সেই তুলনায় দূতাবাসে লোকবল কম। কর্মকর্তারা বলেন, শ্রমিকের চাকরি কিংবা বাসস্থান বিষয়ে কোন সমস্যা হলে সেটি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করে তারা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। প্রবাসী শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (কনস্যুলার) লুৎফর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বিদেশে শ্রমিকের নিরাপত্তা দেখার জন্য বাংলাদেশ মিশন থেকে বিভিন্ন কারখানা নিয়মিত মনিটরিং করা হয়। বিষয়টি দূতাবাসের শ্রম ও কনস্যুলার উইং দেখাশোনা করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকের বিভিন্ন কারখানা দূতাবাস থেকে পরিদর্শন করা হয়। আবার শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়ে সেখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতাদেরও নির্দেশনা দেয়া রয়েছে বলেও তিনি জানান। ভাগ্য ফেরানোর আশায় বিদেশে গিয়ে একের পর এক তরুণ প্রাণ লাশ হয়ে ফিরে আসছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদায় জানানোর পর স্বপ্নে বিভোর স্বজনরা আবার বিমানবন্দরে লাশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু রোধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকের এই অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে শ্রম সংগঠনগুলো উদ্বিগ্ন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, এক কোটি লোক বিদেশে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আটটি লাশ আসা অসম্ভব কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার মোঃ ইফতেখার হায়দার জনকণ্ঠকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বেশিভাগ ফার্নিচার কারখানার শ্রমিক মারা যায়। কারণ ফার্নিচার কারখানায় কেমিক্যাল ব্যবহারা করা হয়। এতে আগুল লাগে বেশি। এছাড়াও বেশি মারা যায় নির্মাণ শ্রমিক। মৃত শ্রমিককে আমরা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করি, পাশাপাশি যাদের অপমৃত্যু হয় তাদের সাহায্য দেয়া হয়। তবে এর বাইরে এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের তেমন কোন করণীয় নেই বলে জানান তিনি। তিনি জানান, এটা দেখভাল করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালনে উদাসীন। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক (কনস্যুলার) লুৎফর রহমান বলেন, অনেক সময় শ্রমিকরা প্রতারিত হয়ে থাকেন। বিদেশে তিনি কোন্ পরিবেশে কাজ করবেন, সেটা আগে থেকে নিশ্চিত হতে পারেন না। বিদেশে যাওয়ার আগে রিক্রুটিং এজেন্সি হয়ত বলে দেয়, কারখানার পরিবেশ খুব ভাল। তবে সেখানে গিয়ে দেখেন কারখানার পরিবেশ ভাল নয়। তখন সেই নেতিবাচক পরিবেশেই কাজ করতে বাধ্য হন তারা। তিনি বলেন, বিদেশে শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেখভালের জন্য বাংলাদেশ মিশন থেকে নিয়মিত বিভিন্ন কারখানা মনিটরিং করা হয়। দূতাবাসের শ্রম ও কনস্যুলার উইংও এ বিষয়টি দেখাশোনা করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে শ্রমিকদের বিভিন্ন কারখানা দূতাবাস থেকে পরিদর্শন করা হয়।
×