ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টেন্ডার প্রক্রিয়া কি স্রেফ আইওয়াশ!

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১৩ জুন ২০১৫

চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি টেন্ডার প্রক্রিয়া কি স্রেফ আইওয়াশ!

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালে (এনসিটি) অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার তৎপরতা চলছে। প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ টার্মিনালের চারটি বার্থ পরিচালনার জন্য ইতোমধ্যেই দরপত্র সংগৃহীত হয়েছে। চলছে মূল্যায়ন ও যাচাইবাছাই কাজ। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়মনীতি চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে দরপত্রে এমন শর্ত আরোপিত হয়েছে যাতে করে একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যদের কাজ পাওয়ার সুযোগ না থাকে। এ ব্যাপারে আদালতে দুটি মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু মামলার শুনানির তারিখের আগেই যাবতীয় কর্ম শেষ করতে তোড়জোড় চলছে। চট্টগ্রাম বন্দর এনসিটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০৮ সালে। নানা জটিলতায় এ টার্মিনালে অপারেটর নিয়োগ হচ্ছিল না। বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থা ও ট্রেড বডির দাবি ছিল দেশের আমদানি-রফতানির পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে গতিশীলতা আনতে এনসিটিতে অপারেটর নিয়োগের। অবশেষে এ ব্যাপারে উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলেও সামগ্রিক প্রক্রিয়া শুরুতেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ সময় পর এনসিটি চালুর ব্যাপারে বন্দর কর্তৃপক্ষের গতি যেন সুপারসনিক বিমানের গতিকেও হার মানাচ্ছেÑ এমন বক্তব্যই পাওয়া যাচ্ছে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সূত্রে। বন্দর ব্যবহারকারীর অনেকে এ প্রক্রিয়া নিয়ে অর্থমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। কেননা, এ ব্যাপারে তিনি ওয়াকিফহাল এবং জনগণের অর্থ অপচয়ের যে কোন দিক নিয়ে তার হস্তক্ষেপের সুযোগ রয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থা ও বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্রে যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে এনসিটির চারটি বার্থে অপারেটর নিয়োগের শর্ত এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে তাতে করে একটি প্রতিষ্ঠানই শুধু কাজ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। এই অনিয়ম খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্যও বিব্রতকর। সে কারণে ইতোমধ্যেই কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে। কিন্তু তারপরও প্রক্রিয়া এগিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। বন্দর সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে আভাস দেয়া হয়েছে, এনসিটি পরিচালনা নিয়ে যে টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, এটা ¯্রফে আইওয়াশ। কাদের টেন্ডার টিকবে এবং কারা কাজ পাবে তা আগেই ঠিকঠাক করা হয়ে গেছে। আর এ কারণেই নিয়মনীতি না মেনে এবং আদালতে মামলা চলমান থাকা অবস্থায় অতি দ্রুতগতিতে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কর্মযজ্ঞ চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে প্রেরিত এক পত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব উল্লেখ করেন, “পিপিআর ২০০৮ এর বিধি ২৯ এর ২(ক) পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, প্রতিযোগিতা সীমিত করতে পারে এরূপ কোন শর্ত দিয়ে দরপত্র বিনির্দেশ তৈরি করা যাবে না। এই টেন্ডারের অভিজ্ঞতা হিসেবে শুধুমাত্র টার্মিনাল অপারেটরের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ আছে। আরও বলা আছে যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। কিন্তু বাংলাদেশের টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শুধুমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। কাজেই টেন্ডার ডকুমেন্টের উক্ত শর্তানুযায়ী এখানে প্রতিযোগিতার কোন সুযোগ না থাকায় পিপিআর এর ব্যত্যয় ঘটবে।” বন্দর কর্তৃপক্ষ এই পত্রে দরপত্রের শর্তাবলী রিভিউ করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু এরপরও মন্ত্রণালয় এনসিটিতে অপারেটর নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। এনসিটির চারটি বার্থে অপারেটর হতে আগ্রহীরা গত বুধবারের মধ্যে দরপত্র জমা দেয়। এদিনই ছিল নির্ধারিত শেষ তারিখ। দেখা যায়, ২, ৩, ৪ ও ৫ নম্বর বার্থের জন্য দরপত্র জমা পড়েছে মোট ৮টি। এর মধ্যে দুটি বার্থে যৌথভাবে দরপত্র জমা দিয়েছে আলোচিত সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের মালিকানাধীন মেসার্স এমএইচ চৌধুরী এবং নোয়াখালীর আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর মালিকানার মেসার্স এ এ্যান্ড জে ট্রেডার্স। বাকিরা পৃথকভাবে দরপত্র জমা দেন। এমন শর্তের মধ্য দিয়ে মূলত পছন্দের প্রভাবশালী একটি গ্রুপকে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করার গোপন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, টেন্ডারের এ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই দুটি মামলা দায়ের হয়েছে হাইকোর্টে। তন্মধ্যে একটি মামলার বাদী আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরীর মালিকানার প্রতিষ্ঠান মেসার্স কন্টেনার টার্মিনাল সার্ভিসেস (সিটিএস)। জনস্বার্থে অপর মামলাটি দায়ের করেন জনৈক রিদোয়ান আহমেদ। আগামী ১৪ জুন হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চে মামলার শুনানির নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু এর আগেই দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে টেন্ডারের যাচাইবাছাই কাজ। জানা যায়, গত বুধবার অর্থাৎ দরপত্র দাখিলের শেষ দিনই মিটিং করেছে টেন্ডার কমিটি। দরপত্রে অংশগ্রহণকারীদের টেকনিক্যাল অফারগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। সংক্ষুব্ধ অনেক বার্থ অপারেটরের অভিযোগ, অত্যন্ত সুকৌশলে তাদেরকে এ প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। যেভাবে শর্ত জুড়ে দিয়ে টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে তাতে সরকারের পিপিআর এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিয়মনীতিও উপেক্ষিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের ক্ষোভ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রতি। চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক বার্থ অপারেটর নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, সংসদীয় কমিটির কাজ যে কোন বিষয়ে সরকার তথা মন্ত্রণালয়কে উপদেশ ও পরামর্শ দেয়া। এ কমিটির সংসদ সদস্যগণ সরকারের প্রতি সুপারিশ তুলে ধরতে পারেন। সে জায়গায় কমিটি এক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে প্রভাব রেখেছে। দরপত্রকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সংসদীয় কমিটির যেখানে শর্ত শিথিল করার সুপারিশের কথা ছিল, সে জায়গায় তারা করেছেন উল্টো। একটি বড় প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে সংসদীয় কমিটির কতিপয় সদস ভূমিকা রেখেছেন বলে অভিযোগ দরপত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ না পাওয়া বার্থ অপারেটরদের। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার জন্য চারটি বার্থে অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জমা পড়েছে মোট ৮টি টেন্ডার । চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মোঃ জাফর আলম জানান, বুধবার বিকেলে খোলা হয় এনসিটির ২ ও ৩ নং বার্থের জন্য নির্ধারিত টেন্ডার বাক্স। এতে দেখা যায় মোট ৫টি দরপত্র জমা পড়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহী হিসেবে দরপত্র জমা দিয়েছে সেগুলো হচ্ছে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড, মেসার্স এএ্যান্ডজে টেডার্স, মেসার্স ফজলে এ্যান্ড সন্স, কন্টেনার এ্যান্ড টার্মিনাল সার্ভিসেস (সিটিএস) এবং মেসার্স এইচ কে। এর আগে গত মঙ্গলবার খোলা হয় ৪ ও ৫ নং বার্থের জন্য নির্ধারিত টেন্ডার বাক্স। এতে মোট তিনটি দরপত্র পাওয়া যায়। দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সাইফ পাওয়ার টেক লিমিটেড, এমএইচ চৌধুরী এবং এএ্যান্ড জে টেডার্স যৌথভাবে একটি দরপত্র জমা দেয়। আর ওই দুই বার্থের জন্য পৃথকভাবে দরপত্র জমা দেয় কন্টেনার এ্যান্ড টার্মিনাল সার্ভিসেস (সিটিএস) এবং মেসার্স বশির আহমেদ ডিস্ট্রিবিউটর।
×