ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আন্দোলনের হুঁশিয়ারি ॥ ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৫ জুন ২০১৫

আন্দোলনের হুঁশিয়ারি ॥ ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্র্ভুক্ত না করা এবং এ স্কেলের মাধ্যমে মর্যাদাহানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশের বেসরকারী স্কুল-কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার সময়তো বটেই ঘোষিত বাজেটেও এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক ও কর্মচারীর জন্য সুখবর নেই। সরকারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গেই নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তির দাবিতে তাই আন্দোলনে নেমেছেন বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা। আসছে প্রতিবাদ কর্মসূচী। শিক্ষক নেতারা কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, আগামী ১ জুলাই নতুন জাতীয় স্কেল কার্যকরের সঙ্গে সঙ্গেই বেসরকারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদেরও তা দিতে হবে। অন্যদিকে নতুন স্কেল প্রত্যাখ্যান করে পৃথক বেতন স্কেলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কোন না কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিদিন হচ্ছে প্রতিবাদ সমাবেশ। আজ শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে ক্ষোভের কথা জানাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কোন সুখবর না আসায় চলমান প্রতিবাদ কর্মসূচীর বাইরেও নতুন জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকরের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বেসরকারী প্রায় সকল শিক্ষক সংগঠনই। বেতন কমিশনের প্রস্তাবের পর থেকেই সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা আন্দোলন শুরু করেছেন। কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ঢাকায় চলছে সভা, প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন। শিক্ষক নেতারা বলছেন, প্রথমদিকে বলা হয়, বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা নতুন স্কেল পাবেন অন্যদের তুলনায় ছয় মাস পর। সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা আদৌ স্কেল পাবেন কিনাÑ তাই পরিষ্কার নয়। এ বিষয়ে সরকারের দিক থেকে কোন পরিষ্কার তথ্য না আসায় অসন্তোষ আরও বাড়ছে। বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন দাবি আদায়ে ইতোমধ্যেই কর্মসূচীর ডাক দিয়েছে। শিক্ষক নেতারা বলছেন, এর আগে যতবারই নতুন স্কেল হয়েছে ততবারই বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরাও তাতে সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু এবার বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার এমপিওভুক্ত সাড়ে ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী, বেসরকারী অনার্স-মাস্টার্স কলেজের প্রায় সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়ে ৩৭ হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাথায় হাত পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নের পর বাজারে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি দেখা দেবে। তারা যে বেতন-ভাতা পান তাতে তখন আর সংসার চলবে না। এ অবস্থায় এসব শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। আগের মতো বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে একযোগে পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছে বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক ও বাংলাদেশ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নুর মোহাম্মদ তালুকদার, বেসরকারী কারিগরি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু ইতোমধ্যেই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, বর্তমান শিক্ষাবান্ধব শেখ হাসিনা সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করার জন্য বেসরকারী শিক্ষকদের পে-স্কেল কার্যকর করা নিয়ে এ অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। পে কমিশনের প্রস্তাব দেশের এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখ শিক্ষক কর্মচারীকে ব্যথিত করে। শেখ হাসিনা সরকারই ’৯৭ সালে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। শিক্ষক নেতারা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। একই সঙ্গে বেসরকারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের নতুন জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকরসহ ২১ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলন কর্মসূচীর ডাক দিয়েছে বেসরকারী স্কুল, কলেজ ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের ১১টি সংগঠনের এই জোট শিক্ষক কর্মচারী ফ্রন্ট। জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের নেতারা এসব দাবি তুলে ধরেন। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ আসাদুল হক বলেছেন, সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান যেদিন থেকে সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন পাবেন সেদিন থেকেই বেসরকারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদেরও তা দিতে হবে। বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা বিগত দিনে ঘোষিত সব জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বর্তমানে খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের জাতীয় বেতন স্কেল থেকে বঞ্চিত করা হলে বর্তমান সরকারের জন্য তা মারাত্মক আত্মঘাতী ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে। তারা আরও বলেন, বর্তমানে বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা সরকার থেকে শতভাগ বেতন ভাতা পেলেও বাড়িভাড়া মাত্র পাঁচশত টাকা, চিকিৎসা ভাতা মাত্র তিনশত টাকা এবং বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট মাত্র একশত বিশ টাকাÑ যা দিয়ে সামান্য বেতনভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীরা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। জাতীয় বেতন স্কেলে বেসরকারী এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের শর্তহীনভাবে স্কেলভুক্ত রাখতে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ এমএ সাত্তার বলছিলেন, পে-স্কেল নিয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। শিক্ষক সমাজের মাঝে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের সঙ্গে স্কেল কার্যকরের কোন বিকল্প নেই। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করেছেন। স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সাজাহান আলম সাজু বলেন, বিষয়টি সরকারের পরিষ্কার করা দরকার। শিক্ষকরা জানতে পারছে না আসলে কী হচ্ছে। এতে সরকারবিরোধীরা আরও সুযোগ পাচ্ছে অপপ্রচারের। ১ জুলাই থেকে বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কেল কার্যকর অবশ্যই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী আগে কখনই বেসরকারী শিক্ষকদের বঞ্চিত করেননি। এটা তিনি করতে পারেন না, কারণ তিনি জাতির জনকের কন্যা। শিক্ষক সমাজের জন্য তার দরদ আছে। সরকারী শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে আগামী ১ জুলাই থেকেই নতুন জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্যতম এ সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সরকার প্রতিশ্রুত নতুন পে-স্কেল আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে। কিন্তু বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কবে তা জানা নেই। এটা যা বৈষম্যমূলক, অগণতান্ত্রিক ও শিক্ষাবান্ধব নীতি পরিপন্থী। কমিশনের সুপারিশে দেশের ৫ লক্ষাধিক বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারী মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ বলেন, সরকার গঠিত ‘অষ্টম জাতীয় পে এ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন’ প্রতিশ্রুতি মোতাবেক প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য একটি যুগোপযোগী বেতন কাঠামো প্রস্তাব করেছে। কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে সকলের নতুন স্কেলে বেতন প্রদান আগামী জুলাই থেকে কার্যকরের সুপারিশ করা হলেও বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য কার্যকর নিয়ে প্রশ্ন আছে। তিনি বলেন, ১৯৯৭ সালে পঞ্চম পে-কমিশনের সুপারিশক্রমে প্রজাতন্ত্রের সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মতো এমপিওভুক্ত বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদেরও নতুন বেতন কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তৎকালীন শেখ হাসিনার সরকার বলেছিল, শিক্ষকদের বেতনের জন্য আর কখনও আন্দোলন করতে হবে না। এরপর ২০০৫ সালে ষষ্ঠ ও ২০০৯ সালে সপ্তম পে-কমিশনেও ১৯৯৭ সালের ধারবাহিকতা বজায় ছিল। কিন্তু এখন অষ্টম পে-কমিশনে বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের নতুন বেতন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চাদমুখী নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এ সময় প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে বৈষম্যমূলক নীতির অবসান ঘটাতে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি সংগঠনের পক্ষ থেকে আহ্বান জানান অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ। এদিকে এ স্কেল প্রত্যাখ্যান করে পৃথক বেতন স্কেলের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। আজ শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করে ক্ষোভের কথা জানাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। জাতীয় বেতন স্কেল বাতিল, পুনর্নির্ধারণ এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল ঘোষণার দাবিতে গেল সোমবার দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একযোগে কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচী পালন করেছেন। শিক্ষক নেতারা বলেছেন, এটি সরকারবিরোধী কোন কর্মসূচী নয়, কিংবা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলনও নয়। এই কর্মসূচী শুধু শিক্ষকদের ন্যায্য সম্মান ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেল আদায়ের জন্য। চলতি মাসের মধ্যে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য ঘোষণা আসতে হবে। শিক্ষকদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যবর্তী সময়ে ঘোষিত বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণ করে সকল বৈষম্য দূর করে সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা সিনিয়র সচিবের সমতুল্য করা; অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা পদায়িত সচিবের সমতুল্য করা; সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের বেতন কাঠামো ক্রমানুসারে নির্ধারণ করাসহ শিক্ষকদের যৌক্তিক বেতন স্কেল ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী ২০ জুন ২০১৫ জাতীয় প্রেসক্লাবের লাউঞ্জে একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অনুরূপ বেতন কাঠামো ঘোষণার জন্য প্রস্তাবনা উপস্থাপন করবেন শিক্ষকরা। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পরবর্তী সময়ে যেকোন কর্মসূচী সফল করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জানা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন। অর্থনীতির সূচকে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতেও শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। বর্তমান (সপ্তম পে-স্কেল) বেতন স্কেলে বাংলাদেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন মাত্র ১১ হাজার টাকা, অধ্যাপকের ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। প্রস্তাবিত অষ্টম বেতন স্কেলে তা দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রভাষকের মূল বেতন ধরা হয়েছে ২২ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের মূল বেতন ধরা হয়েছে ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। এরপরও সবার চেয়ে পিছিয়েই থাকছে বাংলাদেশ। অথচ নেপালে বর্তমানে প্রভাষকের মূল বেতন ২৮ হাজার ১৯২ টাকা আর অধ্যাপকের ৬৫ হাজার ১৮৪ টাকা। অষ্টম বেতন স্কেলে মর্যাদার দিক দিয়েও আগের চেয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। শিক্ষকরা বলেছেন, শিক্ষকরা যদি মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়েন তাহলে তারা কিভাবে ক্লাসে পড়ালেখায় মন দেবেন? আর মানের উন্নয়নই বা কিভাবে হবে? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে এখন ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এর মধ্যে অধ্যাপক আছেন প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ অধ্যাপক সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন পদোন্নতির ১২ থেকে ১৪ বছর পর, তাদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ২৫০ জন। সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এত দিন সর্বোচ্চ বেতন পেয়েছেন। অর্থাৎ তাদের বেতন সচিবদের বেতনের সমান। সপ্তম বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সচিব উভয়েই ৪০ হাজার টাকা মূল বেতন স্কেল পান। কিন্তু নতুন বেতন স্কেলে (অষ্টম পে-স্কেল) গ্রেড-১ এর আগেও তিনটি ধাপ রাখা হয়েছে। প্রথম ধাপে ৯০ হাজার টাকা বেতন পাবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবরা। দ্বিতীয় ধাপে ৮৪ হাজার টাকা পাবেন সিনিয়র সচিবরা। আর তৃতীয় ধাপে পদায়িত সচিবরা পাবেন ৮০ হাজার টাকা। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে গ্রেড-১। এখানে রয়েছে সচিব (ওএসডি) ও অধ্যাপকরা (সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত)। বেতন কমিশন অবশ্য সিলেকশন গ্রেড তুলে দেয়ার প্রস্তাব করেছে। তা করলে অধ্যাপকদের নেমে আসতে হবে গ্রেড-২ তে। যেখানে বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। অন্য পদের শিক্ষকদেরও এভাবে নিচের ধাপে নামতে হবে। সপ্তম বেতন স্কেলে গ্রেড-৪ এ থাকা সহযোগী অধ্যাপকরা মূল বেতন পান ২৫ হাজার ৭৫০ টাকা। নতুন স্কেলে তারা পাবেন ৫০ হাজার টাকা। তাদের গ্রেড ঠিক থাকলেও আগের একই মর্যাদার প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপরে উঠে যাচ্ছেন। আর সহকারী অধ্যাপকরা ১৮ হাজার ৫০০ টাকার মূল বেতনের বদলে পাবেন ৩৫ হাজার ৫০০। তাদের ক্ষেত্রেও সহযোগীদের মতো একই ঘটনা ঘটছে। শিক্ষকরা বলছেন, এত দিন আমরা সর্বোচ্চ গ্রেডে বেতন ও সম্মান পেলেও নতুন বেতন কাঠামোতে আমাদের দুই ধাপ নিচে নেমে আসতে হবে, যা আমাদের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা সরকারী কর্মকর্তাদের মতো সুযোগ-সুবিধা আশা করি না। কিন্তু আমাদের কেন নিচে নামিয়ে দেয়া হবে? মন্ত্রিপরিষদ ও মুখ্যপরিষদ সচিবরা আমাদের ওপরে থাকতে পারেন। কিন্তু এর পরের অবস্থানে তো আমাদের থাকা উচিত। আর আমাদের মূল দাবি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। সেটা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আগের মর্যাদার অবস্থানে রাখতে হবে। নইলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। কর্মসূচীর বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, আমরা ১৯ জুনের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও ইউজিসি চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি দেব। ২০ জুন সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচী ঘোষণা করব। অনশনসহ আরও কঠোর কর্মসূচী আসতে পারে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান পর্যালোচনা এবং ঢাবি, জবি, রাবি, জাবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের শিক্ষকরা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় যথেষ্ট পিছিয়ে আছেন। অধিকাংশ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রভাষকের পদ নেই। তাদের শুরু সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। আশপাশের দেশগুলোতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল রয়েছে। ভারতে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৫৫ হাজার, সহযোগী অধ্যাপকের ৯০ হাজার এবং অধ্যাপকের এক লাখ ১০ থেকে এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা। পাকিস্তানে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন এক লাখ চার হাজার, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ ৫৬ হাজার ও অধ্যাপকের দুই লাখ ৩৪ হাজার টাকা। শ্রীলঙ্কায় সহকারী অধ্যাপকের বেতন স্কেল এক লাখ পাঁচ হাজার ৬৮০, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ ৪০ হাজার ও অধ্যাপকের এক লাখ ৮৬ হাজার ৩৪৫ টাকা। চীনে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৯৬ হাজার ৩০৯, অধ্যাপকরা পান এক লাখ ৫০ হাজার ৩৩১ টাকা। মালয়েশিয়ায় সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন দুই লাখ ৫৩ হাজার ১৫৮, অধ্যাপকরা পান তিন লাখ ৬০ হাজার ৩০৫ টাকা। জাপানে সহকারী অধ্যাপকদের মূল বেতন দুই লাখ ৪২ হাজার ৭২৯, অধ্যাপকরা পান চার লাখ ৫১ হাজার ৮৮৮ টাকা। এর বাইরে আবাসন, যাতায়াতের জন্য গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বাংলাদেশে অষ্টম পে-স্কেলে যুগ্মসচিব ও তদোর্ধ পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের গাড়ি ক্রয়ে ২৫ লাখ টাকা ঋণ সুবিধা ও মাসিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ৪৫ হাজার টাকা বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এ সুবিধা দিতে হলে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ সংস্থানের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, এক দেশে তো দুই নিয়ম হতে পারে না। জনগণের করের টাকায় যুগ্মসচিবরা যদি এ সুবিধা পেতে পারেন তাহলে আমরা পাব না কেন? তারা বলেন, সিনিয়র অধ্যাপক ও অধ্যাপকদের পদমর্যাদা ও বেতন যথাক্রমে সিনিয়র সচিব এবং পদায়িত সচিবদের সমান করাসহ স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো গঠনের দাবি পূরণ করতে হবে। আর এ দাবি না মানলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নির্দেশনায় সব শিক্ষক পরবর্তীতে কঠোর কর্মসূচী গ্রহণ করবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, প্রস্তাবিত পে-স্কেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য সত্যিই একটি বেদনার বিষয়। এ স্কেল বাস্তবায়িত হওয়ার আগে বিষয়টি নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের একটু ভাবার অনুরোধ জানান তিনি।
×