ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্বদেশ রায়

একটি দিনপঞ্জির খসড়া

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১৮ জুন ২০১৫

একটি দিনপঞ্জির খসড়া

১৬.৬.১৫ ‘ভোর। আকাশের রঙ ঘাস ফড়িংয়ের মত নীল।’ ভোরকে সব সময়ই এমনভাবে দেখতে ইচ্ছে করে। আজও খুব ভোরে উঠি। স্টাডিরুমের পর্দার ব্লাইন্ড ওপেন করে দেখি আকাশজুড়ে ঘন কালো মেঘ। মনটা বদলে গেল মেঘ দেখে। দুঃখ থাকল না আকাশের রং নীল নয় বলে। বরং দেখতে ইচ্ছে করল কেমন দেখাচ্ছে এই কালো মেঘের নিচে দিগন্তজোড়া উত্তাল জলরাশির পদ্মাকে বা একটি সবুজ ক্ষেতের ওপর পড়া কালো মেঘের ছায়া। হঠাৎ ঝির ঝির করে বৃষ্টি এলো। জানালার কাঁচে বৃষ্টির ছোঁয়া। আরও অন্ধকার হয়ে এলো আকাশটা। এবার আকাশ থেকে মুখ ফিরিয়ে পড়ার টেবিলে আসি। পড়তে ইচ্ছে করছিল অমিতাভ ঘোষের একটি ট্রিলজির শেষ খ-টি। অফিয়াম নিয়ে লেখা। কিন্তু কোথায় যেন মনের ভেতর একটা অস্থিরতা কাজ করছে আজ। অন্যদিন হলে হয়ত উপন্যাসটির পাতা ওলটাতে পারতাম। এর বদলে আমেরিকার কলেজ শিক্ষা নিয়ে একটি প্রবন্ধ পড়তে শুরু করি। খুবই ভাল লাগতে শুরু করে অভিজ্ঞ এ প্রফেসরের লেখা। এক জায়গায় এসে মনে হলো তিনি শিক্ষকদের জন্যে যে কথা বলছেন, এ তো আমার জন্যও। সাংবাদিকতার জন্যও। শিক্ষকদের কাজ বলতে তিনি বলেছেন, ছাত্রকে কিছু বাড়তি অক্সিজেন দেয়া। মনে হলো, আমি কি এর বাইরে! সাংবাদিক হিসেবে আমারও কি কাজ নয় সমাজকে, মানুষকে একটি বাড়তি অক্সিজেন দেয়ার চেষ্টা করা। এ লেখাটি পড়া শেষ হতেই মন আবার অস্থির হয়ে যায়। দেয়ালে ঘড়ির দিকে চোখ দেই। সাতটাও বাজেনি। এখনও দু’ঘণ্টা দেরি। দু’ঘণ্টা পরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী মুজাহিদের রায়। মনে হলো এতক্ষণে নিশ্চয়ই টিভি ক্যামেরা পৌঁছে গেছে সুপ্রীমকোর্টের সামনে। তরুণ ছেলেমেয়েরা মাইক্রোফোন হাতে নানান কথা বলে সময় পার করছে। এই যে নানান কথা বলে সময় পার করা হয়- এর বদলে আরও কিছু করা যায়, যা নিউজকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে- সমাজকে ওই ‘অক্সিজেন’ দেয়। কিন্তু আজ তা নিয়ে ভাবনা বেশিদূর এগোয় না। কারণ ঘড়ির কাঁটা তখন এগোচ্ছে। বার বার মনে হচ্ছে, কেন আস্থা রাখতে পারছি না বিচার বিভাগের ওপর! এ আস্থা না রাখতে পারার কারণগুলো মনের পর্দাজুড়ে আসে, সেগুলো থাক আপাতত অপ্রকাশিত। মনের পর্দার চিন্তা মনকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তোলে। ততক্ষণে টি-পটটি খালি। বুঝলাম কয়েক কাপ চা খেয়েছি। সময় ও ঘড়ির কাঁটা যেন আরও ভারি হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে ঘড়ির কাঁটা চলছে না। ওবামানোমিক্স, তাঁর হেলথ ইনসুরেন্স ও বিচারকদের উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তব্য এ নিয়ে কয়েকটি লেখা সামনে। ঠিক পড়া নয়, উল্টে পাল্টে দেখতে থাকি। আবার সেই বিচারক সামনে আসে। ওবামা বলছেন, বিচারকরা যেন মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে রায় দেন। সারা পৃথিবীর বড় বড় নিউজ এজেন্সী এ নিউজটি কত পজিটিভ হিসেবে প্রচার করেছে! আর আমাদের পার্লামেন্টে কসাই কাদেরের রায় ও সাঈদীর রায়ের আগে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বিচারকদের প্রতি অনুরোধ করব, তারা যেন দেশের মানুষের আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দেন। এ নিয়ে কত কথা, কত টিভির পর্দা যে ফেটে যায়! সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। যাক, এবার কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল। অন্তত ঘড়ির কাঁটাটি চলেছে। ইতোমধ্যে সাড়ে আটটা বেজে গেছে। কোর্ট রিপোর্টার বিকাশ দত্তকে ফোন করলাম। ফোন ধরলেন না। বুঝতে পারি, তিনি সুপ্রীমকোর্টের ভেতরে। স্নেহাষ্পদ তরুণ রিপোর্টার আরাফাত মুন্নাকে ফোন করি। খুবই ত্রস্ত তার গলা, বলল সে কোর্টে পৌঁছে গেছে। বিকাশ দা ওখানে আছেন। আমি বললাম, যাহোক তুমি আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করো। বাকি সময়টুকু কাটানোর জন্যে সোস্যাল মিডিয়ায় নানাজনের অভিব্যক্তি দেখতে থাকি। সবার অভিব্যক্তির সঙ্গে নিজের মনের একটা মিল খুঁজে পাই। সবাই যে কিছুটা উদ্বিগ্ন তা তাদের প্রতিটি শব্দ ও বর্ণ বলে দিচ্ছে। ৯টা বেজে কয়েক মিনিট। মুন্না ফোন করে জানায়, ফাঁসি বহাল। না, খুব কোন উচ্ছ্বাস নয়, শুধু বুকের ওপর থেকে যেন একটা পাথর সরে গেল। এতক্ষণে মনে হলো শরীর ও মন যেন স্বাভাবিক হয়েছে। হঠাৎ যেন শরীরের প্রতিটি রোমকূপ খাড়া হয়ে গেল। কেন যেন হঠাৎ মনে হলো শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। নিজের দু চোখ বেয়ে কিছুটা জলও গড়িয়ে পড়ল। শ্যামলী আপা আমাকে দেখলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, বড় বোনের মতো দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করেন। আমার দীর্ঘায়ু কামনা করেন। আমার একটি স্বাভাবিক সাদামাটা জীবন। হয়ত একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হবে। ঘাস, পোকামাকড় বা বড়জোর একটি ছোট্ট পাখির মৃত্যুর মতো। এর বেশি কিছু নয়। অস্বাভাবিক একটি মৃত্যু, নির্মম একটি মৃত্যু যখন একজন বড় মানুষের জীবনকে সংক্ষিপ্ত করে দেয়। আর সেই বিশাল অথচ সংক্ষিপ্ত জীবনের বাকি ভার যাকে বহন করতে হয়, বহন করতে হয় সারাক্ষণ একটি নির্মম মৃত্যুর ভার। ওই বোঝা আসলে কত ভারি! ভাবতে পারি কি আমরা? চেষ্টা করিনি কখনও ভাবার ও প্রকাশের। কারণ, এ মৃত্যুর ভার তো অর্জুনের গা-ীবের থেকেও ভারি। এ গা-ীবের ভার প্রকাশের ক্ষমতা যে আমার নেই তা ভালো মতোই জানি। আমাদের হয়ত অপেক্ষা করতে হবে কোন এক ব্যসদেবের জন্যে। যে ব্যসদেব কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের থেকেও অনেক বড় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখবেন পৃথিবীর সেরা মহাকাব্য। এজন্য হয়ত কয়েক সহস্র বছরও হতে পারে সে অপেক্ষা। তার পরেও মনে হলো আজ শ্যামলী নাসরিন আপার মতো হয়তো কত অযুত মা, কত নিযুত বোন হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন ভাইয়ের মাথায়, সন্তানের মাথায়, বোনের মাথায়। এই মাথাগুলোর চুলে এতদিনে অপরাধে জট পড়ে গিয়েছিল। আজ সে জট ভেসে গেছে যেন হিমালয় কন্যা পদ্মার স্রোতে। তারাশঙ্কর বলেছেন, মানুষের নাকি সব কিছু হতে ইচ্ছে করে। তাঁর নাকি কখনও কখনও মনে হতো যদি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান হতে পারতেন! তারাশঙ্করের লেখা পড়লে মনে হয়, উনি পৌরসভার চেয়ারম্যান কেন, প্রধানমন্ত্রী হলেও ভাল করতেন। কারণ তাঁর যোগ্যতা অপরিসীম। অন্যদিকে কোন পদ দেখলে আমার ভয় করে, লুকাতে ইচ্ছে করে। তারপরেও মানুষ তো! মাঝে মাঝে অনেক কিছু ইচ্ছে করে। মনে হয়, যদি তুলির আঁচড়গুলো ফুটিয়ে তুলতে পারতাম। মনে হতে থাকে, যদি ‘ভারতের পিকাসো’ প্রিয় শিল্পী প্রয়াত হুসেনের মতো তুলি থাকত। তিনি যেমন ভারতজুড়ে ইন্দিরার শরীর ও আঁচল ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার একটি ছবিতে তুলির টানে। মনে হলো, হুসেনের মতো বা কাইয়ূম চৌধুরীর মতো শক্তিশালী তুলির টানে হিমালয়কন্যা পদ্মার স্রোত রেখার মতো হতে পারে না শেখ হাসিনা আর তাঁর আঙ্গুলগুলো! ৪৫ বছর ধরে মাথার চুলে যে অপরাধের জট পড়ে আছে তা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি ওই স্রোত রেখা দিয়ে। একাকীর এসব ভাবনা শেষ হয়ে যায়। সাড়ে দশটা বেজে যায়। অফিসে আসার তাড়া। পথে বেরুতে প্রচ- যানজট। একেবারে বাম্পার টু বাম্পার। স্মার্টফোনের কল্যাণে, এই যানজটে এখন আর অত কষ্ট হয় না। শুধু পড়া নয়, অফিসের অনেক কাজও সেরে ফেলা যায়। সেরে ফেলা যায় অনেক লেখালেখি। অনেক ব্যক্তিগত কাজও। যানজটের রাস্তা হলেও চারপাশ কী স্বাভাবিক! কত মানুষ চলছে আর চলছে। এ যেন রবীন্দ্রনাথের সেই জনারণ্য। আর আকাশ! এখন আকাশ ঘাস ফড়িংয়ের মতো নীল। এর পরে অফিসের লিফটে পা। আরেক ব্যস্ত জীবন। এখানে কল্পনার অবকাশ কম। এখানে শুধু খবর নিয়েই যত কাজ। প্রধান খবর ওই একটাই, কুখ্যাত মুজাহিদের ফাঁসি। রাত নয়টায় অফিসের কাজ শেষ করে কেন যেন আজ বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করে না। কোথায় একটা ফুরফুরে মন কাজ করছে। মন তাই বেছে নেয় ক্লাব। ক্লাবে অনেক আড্ডা। একটার পর একটা আড্ডা শেষ হয়। রাত গভীর হয়, আনন্দের পাশাপাশি কয়েকজন বসে নানান আলোচনা। সে আলোচনায় সব থেকে বেশি গুরুত্ব পায়- বাংলাদেশ এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। একে আর দমানো যাবে না। তিন লাখ কোটি টাকা বাজেটের দেশ। এখন প্রয়োজন শুধু শিক্ষার মান। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান। যার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে যোগ্যরা। তারা শক্তিশালী করবে বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। আর আলোচনার ভিতর আসে পিনু খান। অনেকেরই মত, শুধু এক পিনু খান নয়, অন্তত শত শত পিনু খান জন্মে গেছে সারাদেশে। শেখ হাসিনাকে এখন পরশুরামের কঠোর কুঠার হাতে এই পিনু খানদের ও তাদের ছেলেদের নির্মূল করতে হবে তার দল থেকে, দেশ থেকে। অনেক রাতে বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরতে ফিরতে পথে মনে হলো, কই, কেউ তো আলোচনা করল না মুজাহিদের ফাঁসির রায় আপীল বিভাগে বহালের প্রভাব রাজনীতিতে কী হবে? সারাদিন শেয়ার মার্কেটও যেমন টের পায়নি তেমনি কারও আলোচনায়ও আসেনি। বেগম জিয়া বলেছেন, তিনি সুযোগের অপেক্ষায় আছেন- সে কথাও তোলেননি কেউ আলোচনায়। আসলে শুধু অর্থনীতিতে নয়, রাজনীতিতেও শেখ হাসিনা দেশকে সেই স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে গেছেন ইতোমধ্যে- যাতে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড এখন আইনমাফিক একটি ঘটনামাত্র। বেগম জিয়াও বাসি হয়ে গেছেন। এখন মানুষ চায় নির্মূল হোক পিনু খানরা ও তাদের ছেলেরা। এগিয়ে যাক দেশ। আসুক আরও সুন্দর ভোর! কাঁচ পোকার শরীরের মতো উজ্জ্বল নীলাভ ভোর! [email protected]
×