ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সহজলভ্য, সস্তা ও গন্ধহীন হওয়ায় দ্রুত ছড়াচ্ছে সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে বস্তি পর্যন্ত;###;১ লাখ ব্যবসায়ীই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের;###;৮৫ ভাগ ইয়াবাই ভেজাল

‘মাসে ৬শ’ কোটি টাকার অবৈধ মাদক ব্যবসা ॥ ইয়াবার ভয়াল থাবা

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২০ জুন ২০১৫

‘মাসে ৬শ’ কোটি টাকার অবৈধ মাদক ব্যবসা ॥ ইয়াবার ভয়াল থাবা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ জাতির মেরুদণ্ড-শিক্ষাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে মরণ নেশা ইয়াবা। যা দেশের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলছে। মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এই মরণ নেশা। এক সময় সমাজের বিত্তশালী পরিবারের কোন বখে যাওয়া সন্তানের মধ্যে ইয়াবা সেবন সীমাবদ্ধ ছিল। হালে সে গ-ি পেরিয়ে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে এই মরণ নেশা। সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় মরণ নেশা ইয়াবা এখন বস্তি পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা অন্তত দেড় কোটি। এর মধ্যে এককোটি মাদকাসক্ত। এসব মাদকসেবীরা গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকার মাদক সেবন করে। অর্থাৎ মাসে ৬শ’ কোটি টাকা। আর সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন কমপক্ষে দু’শ’ কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা করছে। যদিও বাস্তবে এর পরিমাণ আরও বেশি। মাদকের মধ্যে ইয়াবা সেবন দিন দিন মহামারি আকার ধারণ করছে। মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম হয়ে সড়ক, রেল ও আকাশপথে সারাদেশে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ছে। মাদকের ক্ষেত্রে ইয়াবার পরের অবস্থানে রয়েছে হেরোইন। অবশ্য সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া ইয়াবার শতকরা ৮৫ ভাগই ভেজাল। এসব ইয়াবাসেবীর কিডনি ও মস্তিস্ক বিকল হওয়া ছাড়াও ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার, হৃদরোগ ও স্মৃতিশক্তি বিনষ্ট হচ্ছে। অধিকাংশ ইয়াবাসেবীর মস্তিস্ক অকেজো হয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। প্রাণঘাতী এই মাদকের প্রভাবে সমাজে বেড়ে যাচ্ছে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও খুনের মতো মারাত্মক অপরাধ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শতকরা ৮০ ভাগ খুনের সঙ্গেই কোন না কোনভাবে মাদকসেবী জড়িত। হালে খুনের সঙ্গে ইয়াবার সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিরোধ ও গবেষণা শাখা সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে অন্তত ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় পাইকারি ও খুচরা মাদক বিক্রেতার সংখ্যাই অন্তত ১৫ লাখ। ১৫ লাখের মধ্যে ১০ লাখ ব্যবসায়ী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের। বাকি ৫ লাখ ব্যবসায়ী দেশের বিভিন্ন জেলার। অধিকাংশ ব্যবসায়ীই ইয়াবা ও হেরোইন ব্যবসায় জড়িত। ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে জলপথে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে। সেখান থেকে স্থল ও আকাশ পথে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা আসছে। সড়কপথে ইয়াবার চালান আনতে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে সবজির ট্রাক, বাস, লরি, মাল আনা-নেয়ার কার্গোভ্যান, বিলাসবহুল গাড়ি ও প্রাইভেটকার। এছাড়া মহিলা ও শিশুদের জামা কাপড়ে নানাভাবে লুকিয়ে ইয়াবা আনা হয়। ইয়াবা বহন করার জন্য ভাড়ায় স্বামী-স্ত্রী, যুবক থেকে যুবতী শুরু করে নানা বয়সী মানুষও পাওয়া যায়। এরমধ্যে সবচেয়ে অভিনব কায়দায় ইয়াবা আনতে ধরা পড়ার ঘটনাটি ঘটে ২০১৪ সালে। ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনে করে এক যুবক ডান হাতে ক্র্যাচ, বাঁ হাতে এক্সরের ফাইল, মাথায় টুপি আর পরনে পায়জামা- পাঞ্জাবি, মুখে মাস্ক পরিহিত অবস্থায় কমলাপুর রেলস্টেশনে নামেন। দেখলেই যে কারও মনে হয়, তিনি অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন। তাকে সন্দেহ করার কোন কারণ নেই। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্টেশন পার হচ্ছিল ওই যুবক। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার জুয়েল রানার কাছে তথ্য ছিল ওই যুবক ইয়াবা নিয়ে আসছে। ওই যুবকের দেহ, ফাইলপত্র সবকিছুই তল্লাশি করে দেখা হলো। কোথাও ইয়াবা নেই। গোয়েন্দারা হতাশ। অবশেষে যুবকের ক্র্যাচের ভেতর থেকে বিশেষ কায়দায় রাখা বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার হয়। আটক যুবক সালাহউদ্দিনের (৩০) বাড়ি কক্সবাজার জেলার চকোরিয়া থানায়। ইতোপূর্বে সে এভাবেই আরও কয়েকটি বড় চালান ঢাকায় পৌঁছে দিয়েছে বলে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়। প্রতি পিস ২শ’ টাকায় কিনে ঢাকার কমলাপুরে পান্না নামে এক মহিলার কাছে প্রতি পিস ইয়াবা ২০ থেকে ৩০ টাকা লাভে বিক্রি করে দিত সালাহউদ্দিন। মহিলারা গোপনাঙ্গে, বাচ্চাদের চিপসের প্যাকেটে, জুতোর তলায়, ম্যাচের বাক্স, সবজির ট্রাকে, নানা ফলমূলের ভেতরে করে ইয়াবার চালান আনে। সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা। সহজলভ্য হওয়ার অন্যতম কারণ ঢাকা ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠা নকল ইয়াবার কারখানা। আসল ইয়াবার সঙ্গে নকল ইয়াবা মিশিয়ে একত্রে বিক্রি হচ্ছে। ফলে বর্তমানে পাড়া মহল্লায় প্রতিপিস ২শ’ টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দামের ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বিক্রি হওয়া শতকরা ৮৫ ভাগ ইয়াবাই নকল। গত বছরের ২৪ আগস্ট ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ বিলাসবহুল পাজেরো জীপে করে ইয়াবার চালান পৌঁছানোর সময় প্রায় ৫৫ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। আব্দুল্লাহ জুবায়েরসহ চারজনকে গ্রেফতার করে। জুবায়ের ইয়াবা বিক্রি করে পাজেরো জীপ ছাড়াও গুলশানের নিকেতনে দুটি আলিশান ফ্ল্যাট কেনে। একটিতে জুবায়ের ও তার ইয়াবা ব্যবসার পার্টনাররা থাকত। অপরটিতে নকল ইয়াবা তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। চট্টগ্রামেও জুবায়েরের ভেজাল ইয়াবা তৈরির কারখানা আছে। চট্টগ্রামে সফলভাবে ভেজাল ইয়াবার ব্যবসা করার পরই জুবায়ের ঢাকায় নকল ইয়াবা তৈরির অত্যাধুনিক কারখানা স্থাপন করেছিল। ডিবি ও র‌্যাব সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় বেচাকেনা হওয়া শতকরা ৮৫ ভাগ ইয়াবা ট্যাবলেটই ভেজাল। একেকটি আসল ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। অথচ ৮০ থেকে ৫শ’ টাকায় মিলছে ইয়াবা। এর প্রধান কারণ ভেজাল ইয়াবা। সাংকেতিক ভাষায় মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে ইয়াবা বেচাকেনার ঘটনা ঘটছে। ফলে অধিকাংশ ইয়াবার চালানই ধরা পড়ে না। এরসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তাও জড়িত। ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও কলেজগুলোতে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়েছে। ইয়াবা সেবনের পর মুখে কোন গন্ধ না হওয়ায় এটি জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। গন্ধ না থাকায় পরিবারের কেউ ইয়াবা সেবনের বিষয়টি বুঝতে পারে না। আর সস্তা হওয়ায় দ্রুত এর বিস্তার ঘটছে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় স্কুলে কলেজে ছড়িয়ে পড়েছে ইয়াবা। প্রায় প্রতিদিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে জব্দ হচ্ছে হাজার হাজার পিস ইয়াবা আর গ্রেফতার হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ী। গ্রেফতারের পর জামিনে ছাড়া পেয়ে আবার জড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা ব্যবসায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রোপলিটন বিভাগের উপপরিচালক রবিউল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত ফেনসিডিলের জায়গা দখল করে নিয়েছে ইয়াবা। প্রতি বোতল ফেনসিডিলের দাম প্রায় হাজার টাকা। প্রসঙ্গত, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে ভারত সরকার সীমান্তে থাকা মরণ নেশা ফেনসিডিলের অন্তত অর্ধশত ভেজাল কারখানা সিলগালা করে দেয়। এজন্য বর্তমানে বাংলাদেশে ফেনসিডিল ঢুকছে তুলনামূলক কম। দিন দিন ইয়াবা ও হেরোইন সেবীর সংখ্যা বাড়ছে। এর প্রধান কারণ সস্তা ও সহজলভ্যতা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নিরোধ ও গবেষণা শাখা সূত্রে জানা গেছে, দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কমপক্ষে দেড় কোটি। এরমধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা এককোটির ওপরে। বাকি ৫০ লাখ মাদকাসক্ত নয়, তবে তারা প্রায়ই মাদক সেবন করে। এসব মাদকসেবী বিভিন্ন পার্টিতে, অনুষ্ঠানে, ঘরোয়া পরিবেশ বা ব্যক্তিগতভাবে মাদক সেবন করে থাকে। এরা নানা ধরনের মাদক সেবন করে থাকে। প্রায় দেড়কোটি মাদকসেবী গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০ কোটি টাকা মাদকের পেছনে ব্যয় করে। আর সারাদেশের প্রায় ৩০ লাখ মাদক ব্যবসায়ী প্রতিদিন অন্তত দু’শ’ কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা করে থাকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশনস এ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) প্রণব কুমার নিয়োগী জনকণ্ঠকে বলেন, ইয়াবা হালের আতঙ্ক। ইয়াবার বিস্তাররোধে তারা কঠোরভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মাদকদ্রব্যের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। তারপরও মাদক পুরোপুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না মাদকের থাবা। ইয়াবা খুব ছোট আকারের মাদক হওয়ায় শরীরে বা কোন জিনিসের মধ্যে অল্প জায়গায় অধিক পরিমাণে আনা সম্ভব। ফলে ইয়াবার বিস্তার ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি মাদকদ্রব্য আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে মাদকের বিস্তার কমে আসবে। মাদক বিশেষ করে ইয়াবা সেবনের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেছেন, ইয়াবা সেবনে লিভার, কিডনি, হার্ট ও মস্তিষ্ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানুষের স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। দীর্ঘ সময় ইয়াবা সেবনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। ইয়াবাসেবীরা নির্ধারিত সময়ে ইয়াবা সেবন করতে না পারলে বা ইয়াবার টাকা যোগাড় করতে উত্তেজিত হয়ে অনেক সময় মানুষ হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। দীর্ঘ সময় ইয়াবা সেবনে শরীর শুকিয়ে যায়। শরীরে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, যা আস্তে আস্তে শরীরে ক্যান্সারের সৃষ্টি করে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, মাদকের বিষয়ে সরকার জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। মাদকের বিস্তাররোধে সাঁড়াশি অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি চলবে। সমাজ থেকে চিরতরে মাদক নির্মূল করতে নানা কৌশলী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
×