ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিচিত্র খাবারের পসরা বিকেল থেকেই জমজমাট বাজার

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২০ জুন ২০১৫

বিচিত্র খাবারের পসরা বিকেল থেকেই জমজমাট বাজার

মোরসালিন মিজান বলার অপেক্ষা রাখে না, রোজা মানে সংযম। সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকা। অভুক্ত মানুষের যে কষ্ট, উপলব্ধির সুযোগ করে দেয় রোজা। তবে এ-ও সত্য, সারাদিন রোজা রাখার পর সন্ধ্যায় একটু ভাল কিছু, সুস্বাদু কিছু মুখে দেয়ার ইচ্ছে হয়। আর সে ইচ্ছের সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটে ইফতারের সময়। বাসায় ইফতারের আয়োজন থাকে। তেমনি গোটা রাজধানীতে বসে এক মাসের দোকানদারি। অলিগলি রাস্তা সর্বত্রই ইফতার সামগ্রী পাওয়া যায়। এবারও রোজার প্রথম দিন থেকে দৃশ্যমান হচ্ছে পুরনো চিত্র। যথারীতি জমে উঠেছে চকবাজার। পুরনো ঢাকার বিপুল বিশাল আয়োজন এখন ঐতিহ্যের অংশ। মুঘলদের খাবার, রাজা-বাদশা-নবাবদের ভোজনবিলাসের ইতিহাস তুলে ধরে চকবাজার। ঘরে ইফতারের যত আয়োজনই থাকুক না কেন, পুরান ঢাকার চকবাজার থেকে পছন্দের দুই-এক আইটেম না হলে কী যেন বাকি থেকে যায়। বিশেষ করে প্রথম রোজার দিনটিতে চকের ইফতার যেন বাধ্যতামূলক। পুরান ঢাকার মানুষ বাজারে ঢুঁ না মেরে থাকতে পারেন না। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসে। ইফতার সামগ্রী কেনে বাড়ি ফেরেন রোজাদাররা। সব মিলিয়ে অন্য রকম আবেদন নিয়ে হাজির হয় চকের ইফতার বাজার। ভিড় এড়াতে শুক্রবার দুপুরেই এ প্রতিবেদক সেখানে হাজির হন। তখনও জুমার নামাজ শুরু হয়নি। অথচ বাজার জমে উঠেছে। প্রথম রোজার দিন থেকেই পসরা সাজিয়ে বসেছে কয়েক শ’ দোকানি। ছোট্ট পরিসর। গায়ে গা লেগে আছে। ওই অবস্থায় এমনকি চুলো জ্বালিয়ে চলছে বাহারি ইফতার তৈরির কাজ। গরমাগরম কেনার লোকের অভাব নেই। নামাজ শেষ হওয়ার পর ওইটুকুন জায়গায় যেন ঢল নামে ক্রেতার। দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পাওয়াও মুশকিল হয়ে ওঠে। ক্রেতা দেখে হাঁকডাকও বেড়ে যায় দোকানিদের। বিভিন্ন খাবার দেখিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। চকে বহু ইফতার সামগ্রী থাকলেও কিছু যারপর নাই বিখ্যাত। দারুণ স্বাদের সঙ্গে আভিজাত্য যোগ হওয়ায় এসব খাবার আর সাধারণ থাকে না। ভিড় ঠেলে বাজারে প্রবেশ করলে প্রথমেই কানে আসেÑ বড় বাপের পোলায় খায়/ঠোঙ্গা ভইরা লইয়া যায়। সুর করে বলছিলেন অপেক্ষাকৃত কমবয়সী বিক্রেতারা। হ্যাঁ, খাবারটির বিচিত্র নামÑ ‘বড় বাপের পোলায় খায়।’ কেন এমন নাম? নামেই আছে সে উত্তর। তবু জানতে চাওয়া প্রবীণ বাবুর্চি হাজী শহীদের কাছে। চোখের সামনেই খাবারটি তৈরি করছিলেন তিনি। বললেন, ‘দামী জিনিস তো। জাত বড়লোকরা খাইতো। সেই থিইক্যা এই নাম।’ তা, কী আছে এই খাবারে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, হাজী শহীদ এখান থেকে এক মুঠো, ওখান থেকে এক চিমটি কী যেন তুলে নিয়ে একত্রিত করছেন। একবার দুইবার নয়। বার বার। এভাবে ১৭ পদের মসলা, মুরগির কিমা, গরুর মগজ, কলিজী, ছোলা ইত্যাদির মিশেল ঘটে। তার পর ঠোঙ্গায় পুরে সেটি তুলে দেয়া হয় ক্রেতার হাতে। চকে আছে বিভিন্ন নামের কাবাব। বিচিত্র উপস্থাপনার কারণে প্রথমেই চোখে পড়ে সুতিকাবাব। কাবাবের পুরোটা সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে বলেই সুতিকাবাব নাম। এর টিউবলাইটের মতো লম্বা শরীর। তবে স্বাস্থ্য টিউবলাইটের চেয়ে অনেক ভাল। মাঝখানে লোহাড় শিক ঢুকিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেতা চাইলে একপাশ থেকে কেটে বিক্রি করা হয়। তেমন একটি দোকান থেকে ভেসে আসছিলÑ ‘গামা ভাইয়ের সুতিকাবাব... গামা ভাইয়ের আসল সুতি কাবাব...।’ কাছে গিয়ে দোকানি রনির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই কাবাব যিনি তৈরি করেছেন তার নাম আমানত হোসেন গামা। গামা থেকেই গামার সুতিকাবাব। বিক্রেতার ভাষায়Ñ ‘বহুত পুরানা জিনিস। আমাগো বড়বাবারা করত। এহন আমরা করি।’ এখানে গরুর মাংসের সুতিকাবাব বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দামে। খাসিরটার কেজি ৭৫০ টাকা। আস্ত খাসিকেও দিব্যি রোস্ট করে ফেলা হয়েছে। তারপর বিশেষ ব্যবস্থায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে টেবিলের উপর। দেখলে মনে হয়, এই বুঝি ছোট দেবে। আদতে সে সুযোগ নেই। দেহের আদল ঠিক থাকলেও এটি সুস্বাদু খাবার এখন। নামÑ আনাম খাসি। কিভাবে তৈরি করা হয় একে? জানতে চাইলে দুই কথায় উত্তর দিয়ে দিলেন ইদ্রিস নামের এক বাবুর্চি। বললেন, ‘হাত-পা বইন্দা পাতিলে বহাইয়া দেই। হের পর মসলা মারি।’ কেউ কেউ খাসির রান রান্না করে নিয়ে এসেছেন। মাংসের গায়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন সালাদের আইটেম। কিছু সময় পর পর উপর থেকে ঢালা হচ্ছে তরকারির ঝোল। তাতেই অদ্ভুত চিক চিক করে উঠছে খাবারটি! লোভনীয় এই ইফতার সামগ্রীর নামÑ লেগ রোস্ট। ছোট ছোট পাখিও রোস্ট করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নাম দেয়া হয়েছে ‘ভিজা রোস্ট।’ কবুতর আছে যথারীতি। বেশি দেখা যায় কোয়েল। কারও কারও দৃশ্যটি দেখে খারাপ লাগে বৈকি! তবে বেচা-কেনা বন্ধ থাকে না। মাংসের ইফতার পর্ব শেষ হলে আছে মিষ্টি খাবার। চকের শাহী জিলাপী খুব বিখ্যাত। এর বিশাল আকার। বড় ফুলকপির মতো। মোঃ মোতালেব নামের এক কারিগর দোকানের পেছনের অংশে বসে জিলাপী ভাজছিলেন। হাঁটু ভেঙ্গে আরাম করে বসে ডুবো তেলে প্যাঁচ কষছিলেন তিনি। কখনও পাঁচটি। কখনো ছয় থেকে সাত প্যাঁচ। এভাবে প্রতিটি জিলাপীর ওজন এক কেজি থেকে চার কেজি পর্যন্ত হয়ে যায়। কারিগর জানান, গত ৩০ বছর ধরে জিলাপী তৈরির কাজ করছেন তিনি। আর শাহী জিলাপী তৈরি করছেন দশ বছর ধরে। মূলত রমজানেই তৈরি করা হয় বড় আকারের এই জিলাপী। চকের এখানে ওখানে আরও সাজানো আছে দইবড়া, ফালুদা, মাঠা, লাবাং ইত্যাদি পানীয়। আর ছোলা মুড়ি তো না থাকলেই নয়। অসংখ্য আইটেমের ইফতার বাজার থেকে যার যা পছন্দ কিনছেন। পুরান ঢাকার বাসিন্দা হাবিব মোল্লা অনেকক্ষণ ধরে কিনে যেন ক্লান্ত কিছুটা। বললেন, ভিড়ের মধ্যে পারা যায় না। তবু প্রথম রোজায় এখানে আসতে হয়। বাপ-দাদারা আসতেন। না আসলে চলে না। গোপীবাগ থেকে চকে ইফতার কিনতে এসেছিলেন জিয়াউদ্দীন। পেশায় ব্যাংকার। বললেন, ইফতারের সব তো ঘরেই হয়। তবু এখানে আসি। ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবার আছে যেগুলো চক ছাড়া পাওয়া যায় না। রমজানের পুরোটাজুড়েই জমজমাট থাকবে চকবাজার। আর নতুন ঢাকার আয়োজনের কথা তো সবার জানা। যেখানে রেস্তঁরা সেখানেই ইফতারের পসরা। মুড়ি ছোলা, খেজুর, শরবতÑ সব দিয়ে সাজানো সম্মুখভাগ। বাজারে, রাস্তার ধারে বসে গেছে ছোট ছোট দোকান। আলাদা করে বলতে হয় বেইলি রোডের ইফতার আয়োজনের কথা। এখানেও দীর্ঘকাল ধরে চলছে ইফতারের বিশেষ আয়োজন। শুক্রবার রোজার প্রথম দিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দুই ধার ইফতার সামগ্রী দিয়ে সাজানো। এখানেও ডুবো তেলে ভাজা হচ্ছে জিলাপী। এই জিলাপী পাতলা। হালিমও বিক্রি হচ্ছে খুব। গুলশান বনানী এলাকার একাধিক ভারতীয় রেস্তরাঁ আয়োজন করেছে বিশেষ ইফতার বাজারের। পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতেও চালু হয়েছে ইফতার বুফে। এভাবে সামনে এসেছে ইফতারকেন্দ্রিক সংস্কৃতি। রমজানের শেষ দিন পর্যন্ত চলবে এমন আয়োজন।
×