ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রিভিউর কোন উদ্যোগ নেই ॥ পদোন্নতি বঞ্চিতরা হতাশ

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২১ জুন ২০১৫

রিভিউর কোন উদ্যোগ নেই ॥ পদোন্নতি বঞ্চিতরা হতাশ

তপন বিশ্বাস ॥ প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও পদোন্নতি বঞ্চিতদের ‘রিভিউ’-এর কোন উদ্যোগ নেই। বঞ্চিতরা এসএসবি সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন এবং সদস্যরা তাদের আশ্বাসও দিয়েছেন। এ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, অনেকে রিভিউর জন্য আবেদন করেছেন। এগুলো পর্যালোচনা হতে পারে এবং আমরা আবেদনগুলো নিয়ে শীঘ্রই বসব। কবে নাগাদ এ নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে তা অবশ্য জানা যায়নি। বিগত ৬ এপ্রিল প্রশাসনে রেকর্ড সংখ্যক কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদান করা হয়। তিন স্তরে ৮৭৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। এই পদোন্নতিতে যোগ্যতা থাকার পরও বাদ পড়েছেন অনেকে। অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ সুবিধার মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উইং থেকে কৌশলে জামায়াত-বিএনপিপন্থী অনেককে পদোন্নতির সুযোগ করে দেয়া হয়। এতে বাদ পড়ে যান সরকারের আস্থাভাজন অনেক কর্মকর্তা। এদের অনেকেই চারদলীয় জোট সরকারের আমলে যোগ্যতা থাকার পরও বার বার পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। বিগত আমলে রাজনৈতিক কারণে পদোন্নতি বঞ্চনার শিকার হওয়ার পর এই আমলেও আবার বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মধ্যে নেমে এসেছে হতাশা। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট উইংয়ের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত রোষানলে ও প্রতিহিংসার কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন কেউ কেউ। কোন কোন ক্ষেত্রে বঞ্চিত করতে ভুল তথ্য উত্থাপন করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট এই উইং থেকে। এতে এসএসবি সদস্যদের অগোচরে রয়ে গেছে অনেক কিছু। এমনকি পদোন্নতির পর ভাল পদে নিয়োগের জন্য এই উইংয়ের প্রভাবশালী ওই কর্মকর্তাকে খুশি করতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এক কর্মকর্তাকে পদোন্নতির তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য বিভাগীয় মামলায় দোষী সাব্যস্ত সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হয় যা সঠিক ছিল না। পদোন্নতির পর প্রকৃত ঘটনা অবহিত হয়ে এসএসবির এক প্রভাবশালী সদস্য বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করলে তথ্য উপস্থাপনকারী উইংয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, এটি ভুলবসত উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভার আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট উইং থেকে পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র এবং তথ্যাদি উপস্থাপন করা হয়। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এসএসবি সদস্যরা কর্মকর্তাদের পদোন্নতির মানদ- নির্ধারণ করেন। গত ২ জুন সিভিল সার্ভিস একাডেমির ৯২তম সমাপনী কোর্সে বক্তৃতা দিতে গিয়ে এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রশাসনে একযোগে ব্যাপক সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এত বড় পদোন্নতি অতীতে দেয়া হয়নি। এতে কর্মকর্তারা খুশি। তবে সবাইকে তো খুশি করা যায় না। অনেকে এখানে উপস্থিত আছেন। যারা এই পদোন্নতি প্রক্রিয়ার জড়িত, তাদের ধন্যবাদ জানাই। অনেকে পদোন্নতি প্রাপ্য ছিলেন। তারপরও বঞ্চিত হয়েছেন। বঞ্চিতদের যন্ত্রণা যাতে বেশি ভোগ করতে না হয় সে বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি। যোগ্যতা থাকার পরও উপসচিবে পদোন্নতির বঞ্চিতদের মধ্যে রয়েছেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এএসএম শফিউল আজম। ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ করতেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। বিএনপি শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টুঙ্গীপাড়া পর্যন্ত পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। বাদ পড়েছেন নাজমা বেগম। তিনি নিজে সরাসরি ছাত্রলীগ করতেন। ভাই মরহুম এ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন নেত্রকোনার পূর্বধলা আসনের আওয়ামী লীগের তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। এছাড়া পদোন্নতি বঞ্চিতদের মধ্যে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশারফ হোসেন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি অঞ্জন চন্দ্র পাল, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ গোলামুর রহমান, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য এবং গোপালগঞ্জ নিবাসী দীপংকর বিশ্বাস, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান হাসান মাহমুদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান (পিতা-বর্তমানে চাঁদপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার) শাহীনুর শাহীন খান, বিএনপি আমলে চাকরিচ্যুত অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিবের (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া) মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ওয়াহিদা মুশাররত অনিতা, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও বরিশাল মেডিক্যাল ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্যের স্ত্রী নুরুন্নাহার, ছাত্রলীগ করা মোঃ নজরুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান এস এম শাহ হাবিবুর রহমান হাকিম প্রমুখ। যুগ্ম সচিবে পদোন্নতি বঞ্চিতদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাংগঠনিক সম্পাদক, পিরোজপুরের প্রাক্তন জেলা প্রশাসক এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রীর একান্ত সচিব অনল চন্দ্র দাস, আওয়ামী পরিবারের সন্তান এবং বান্দরবানের সাবেক জেলা প্রশাসক কে এম তারিকুল ইসলাম, আওয়ামী পরিবারের সন্তান ও রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক মোঃ রফিকুল ইসলাম খান, আওয়ামী পরিবারের সন্তান ও বগুড়ার সাবেক জেলা প্রশাসক সারোয়ার মাহমুদ, আওয়ামী পরিবারের সন্তান জামালপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক মোঃ দেলোয়ার হায়দার, হবিগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক মণিন্দ্র কিশোর মজুমদার, মানিকগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক আওয়ামী লীগের সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোঃ শাহজাহান মিয়ার মেয়ের জামাই মোঃ মাসুদ করিম, আওয়ামী পরিবারের সন্তান আশোক কুমার দেবনাথ, কুয়েট ছাত্রলীগের প্রাক্তন নেতা সুশান্ত কুমার কুন্ডু, আওয়ামী পরিবারের সন্তান মোঃ নুরুল আলম নিজামী প্রমুখ। অতিরিক্ত সচিবে পদোন্নতি বঞ্চিতদের মধ্যে রয়েছেন নারায়ণগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিএনপি আমলে ওএসডিসহ বিভিন্ন স্থানে হয়রানিমূলক বদলি, বিগত আমলে দু’বার উপসচিব পদোন্নতি বঞ্চিত, জনতার মঞ্চে সক্রিয় কর্মকর্তা মোঃ সামছুর রহমান, নড়াইলের সাবেক জেলা প্রশাসক ও ছাত্রলীগ নেতা মোঃ আনোয়ার হোসেন, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিশ্বনাথ বণিক, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামী পরিবারের সদস্য দীপক কান্তি পাল, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও আওয়ামী পরিবারের সদস্য মোঃ আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। এদিকে পদোন্নতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এমন অনেক প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাও রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার শ্যালিকা, বিএনপি নেতা নিতাই রায় চৌধুরীর আপন ভাই, বিএনপি আমলের ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী আসাদুল হক দুলুর আত্মীয় এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত তারেক জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের দেশের সংবাদ সরবরাহকারী কর্মকর্তা, বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের সাবেক এপিএস এবং শেরপুর কট্টর বিএনপি পরিবারের সন্তান ও দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তা, বিএনপি আমলের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলনের এপিএস। জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা এবং জামায়াত নেতা ও প্রাক্তন স্থানীয় সরকার সচিব আবুল কাশেমের ভাই, বিএনপি আমলের দুই জেলার ডিসি থাকা কর্মকর্তা, এছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জের জামায়াতের কট্টর সমর্থক কর্মকর্তা, সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বিএনপি আমলের রংপুরের ডিসি থাকা কর্মকর্তা প্রমুখ। যুগ্ম সচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন চারদলীয় জোটের মন্ত্রী আবদুল্লা আল-নোমানের একান্ত সচিব এবং পারিবারিকভাবে বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা, বরিশালের মেয়র বিএনপি নেতা মুজিবুর রহমান সারোয়ারের সাবেক পিএস থাকা কর্মকর্তা (বিএনপিপন্থী), জোট আমলের প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব মোঃ সামশুল আমলের একান্ত সহযোগী বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা প্রমুখ।
×