মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বিলাস বহুল গাড়িতে করে ইয়াবার বড় চালান নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এমন খবরে ওতপেতে থাকা র্যাব-৭-এর সদস্যের এক পুলিশ সদস্যকে শনিবার রাতে ফেনীর লালপোল এলাকা থেকে একটি এলিয়ন কার, প্রায় ৭ লাখ পিস ইয়াবা ও চালকসহ গ্রেফতার করে।
প্রায় ৭ লাখ পিস ইয়াবার চালানের মজুদদার উচ্চ আদালতের পেশকার, এ্যাডভোকেট, পুলিশের বিশেষ শাখার কর্মকর্তা ও কনস্টেবল। ইয়াবার ব্যবসা থেকে বাড়ি, গাড়ি, দোকান সবই যুগিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নগর বিশেষ শাখার টেকনিক্যাল এলাকার এএসআই মাহফুজুর রহমান। র্যাব সেভেনের পতেঙ্গা সদর দফতরে গোযেন্দা সেলের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য স্বীকার করেছে পুলিশের ওই সদস্য। পাইকারি দরে ১৪-১৫ জন খুচরা বিক্রেতার কাছে সে প্রায় ২৯ কোটি টাকার ইয়াবা বিক্রির মতো চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে রবিবার, যা তার সঙ্গে থাকা নোটবুকের সঙ্গে হিসেবের মিল রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, র্যাব সেভেন এ ঘটনার সঙ্গে পুলিশের সম্পৃক্ততা থাকায় ঢিলেঢালা প্রেস ব্রিফিং করেছে রবিবার সকালে। এতে মিডিয়ার সামনে পুলিশের এই সদস্যকে হাজির করা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, সাধারণ অপরাধী ও বাহিনীর অপরাধীর মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে আস্কারা দেয়া হযেছে। কিন্তু পুলিশের এই সদস্যকে মিডিয়ার সামনে হাজির করে তার মুখোশ উন্মোচন করা হলে আগামীতে বাহিনীর অসাধুরা থমকে যেত।
র্যাব সেভেনের পতেঙ্গা সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে র্যাবের পক্ষ থেকে। র্যাবের টহল দল নিয়মিত এই সড়কে টহল পরিচালনা করে আসছে। গত ২০ জুন রাত সাড়ে এগারোটায় ফেনী ক্যাম্পের টহল দলের কাছে অভিযোগ আসে লালপোল এলাকায় একটি কালো রঙের ‘এলিয়ান’ প্রাইভেটকার একটি ছোট বাচ্চাকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যাচ্ছে। অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাবের টহল দল কালো রঙের ‘এলিয়ান’ প্রাইভেটকার (ঢাকা মেট্টো গ-১৭-৭১৮১) আটক করে। এসময় পুলিশ সদস্য মাহফুজ ও ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফেনী ক্যাম্পে নিয়ে যায় র্যাব সদস্যরা। সেখানে গাড়িটিতে তল্লাশি চালানো হয়। গাড়ির ভেতরের পেছনের বাঙ্কার থেকে দুটি ট্রলি ব্যাগ ও যাত্রী আসন থেকে দুটি লাগেজ উদ্ধার করা হয়। এই চারটি লাগেজ থেকে পলিথিনে মোড়ানো ও প্যাকেট ভর্তি ৬ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এসব ইয়াবার বাজার মূল্য প্রায় ২৭ কোটি ২০ লাখ টাকা।
এ ঘটনায় ঢাকার টেকনিক্যাল সেকশনে কর্মরত পুলিশের এসবি শাখার এএসআই মাহফুজুর রহমানকে (৩৫) আটক করা হয়। সে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার মিরপুর এলাকার জমিশেদ মিয়ার ছেলে। তার গাড়ির চালক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাদুগড় এলাকার মৃত ওমর আলী ভূইয়ার ছেলে জাবেদ আলী। মাহফুজের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে মাদক বিক্রির নগদ ৭ লাখ টাকা, দুটি মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের ৮টি ক্রেডিট কার্ড, মাদকের হিসাবের তিনটি নোট বুক। আর চালকের কাছ থেকেও দুটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
আরেক সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার যাত্রাবাড়ীর দনিয়াপাড়া এলাকায় তার একটি বিলাসবহুল দোতলা বাড়ি রয়েছে। একই এলাকায় ১০-১২ দোকানও রয়েছে। কয়েকটি গাড়ি, ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ও বিভিন্ন ব্যাংকে নগদ টাকা ও ফিক্সড ডিপোজিট রয়েছে। তার সিন্ডিকেটের সদস্য ২৫। কক্সবাজারে পুলিশে চাকরির সময়ই সে গাড়ির সামনের সিটে পুলিশের পোশাক পরেই কক্সবাজার থেকে শুধু ঢাকাই নয় দেশের উত্তরাঞ্চলেও ইয়াবার চালান নিয়ে যেত।
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে মাহফুজ জানিয়েছে, সে পুলিশের একজন এমএসআই। বর্তমানে এসবি, ঢাকা টেকনিক্যাল সেকশনে কর্মরত। তার বিপি নং ৮০০১০৬৩১১৯, এসবি আইডি নং-৭৭৮৫। সে ২০১১-২০১৩ সালে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানায় চাকরি করত। সেই সময়ে বিভিন্ন ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত ইয়াবার চালানের বিষয়ে সে জানায়, কক্সবাজার জেলায় কর্মরত ডিবি পুলিশের এএসআই মোঃ বেলাল এবং হাইওয়ে পুলিশের কুমিরা ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মোঃ আশিক তাকে ইয়াবাগুলো ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছে। অপরদিকে ঢাকায় তার কাছ থেকে ইয়াবাগুলো হাইকোর্টের পেশকার (মহুরী) মোঃ মোতালেব, এ্যাডভোকেট জাকির, এসবি কনস্টেবল শাহীন, কাশেম ও গিয়াসের কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা। এ পর্যন্ত সে মোট ১৪ জনের কাছে প্রায় ২৮ কোটি ৪৪ লাখ ১৩ হাজার টাকার ইয়াবা বিক্রি করেছে বলে র্যাবের কাছে স্বীকার করেছে।
এ ব্যাপারে র্যাব সেভেনের মিডিয়া উইং ও এএসপি সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, এসবির এএসআই মাহফুজ দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কক্সবাজারে চাকরির সময় অবস্থায় তার সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সখ্য গড়ে ওঠে। ইয়াবার ব্যবসা করে বিপুল সম্পদের মালিক বনে গেছে। সে গাড়ি তল্লাশির সময় নিজেকে পুলিশের চোখ দিয়ে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু র্যাব সদস্যদের সন্দেহ হলে তাকে ফেনী ক্যাম্পে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। উল্লেখ্য, র্যাব-৭ সদস্যরা এ পর্যন্ত ২২ লাখ এক হাজার ৩৭৮ পিস উদ্ধার করেছে।