ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলার শেরের ভয়ে কাঁপল ভারত

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২২ জুন ২০১৫

বাংলার শেরের ভয়ে কাঁপল ভারত

মোঃ মামুন রশীদ ॥ যমদূত সামনে এলে যে ভয়ের হীম শীতল স্পর্শ টের পেয়ে যায় মানুষ, তেমনটাই যেন উপলব্ধি করছিল ভারতীয় দল। ওয়ানডে সিরিজ শুরুর আগে ভারতীয় দল চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত ছিল পেসার রুবেল হোসেন, মাশরাফি বিন মর্তুজা, তাসকিন আহমেদ ও অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের বোলিং মোকাবেলার। কিন্তু ভারতীয় দলের জন্য তারা কেউ বিপদ হয়ে আসলেন না। সাক্ষাত মৃত্যুদূত হয়ে গেলেন তরুণ মুস্তাফিজ! প্রথম ওয়ানডেতে তিনি ছিলেন ভারতের বিশ্ব কাঁপানো ব্যাটসম্যানদের কাছে একেবারেই অপরিচতি। অভিষেক ওয়ানডেতেই ১৯ বছর বয়সী এ তরুণ ৫ উইকেট শিকার করার পর অজুহাত হিসেবে অচেনা মুস্তাফিজকেই কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল ভারতীয় দল। তবে তাকে নিয়ে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে নামার আগে পরিকল্পনা আঁটতে ছাড়েনি সফরকারীরা। সে সব কোন কাজেই আসল না। দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও ত্রাস হয়ে গেলেন মুস্তাফিজ। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে শিকার করলেন ৬ উইকেট। ক্যারিয়ারের টানা দুই ম্যাচে মোট ১১ উইকেট শিকারের এ ঘটনা ওয়ানডে ইতিহাসেই প্রথম। আর দ্বিতীয় সে ঘটনার জন্ম দিয়ে বাংলাদেশকে গর্বিত করলেন তরুণ মুস্তাফিজ। ক্যারিয়ার অভিষেক ওয়ানডে খেলতে নেমেছিলেন দেশের মানুষের কাছেই সবেমাত্র ক্ষীণ পরিচয় নিয়ে। কারণ গত এপ্রিলে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একমাত্র টি২০ খেলতে নেমেছিলেন সে সময়ই প্রথম সবাই নাম শুনেছিলেন তার। এবার ওয়ানডে অভিষেকেই তোলপাড় ফেলে দিলেন। শুধু ৫ উইকেট নেয়ার জন্যই নয়, আলোচনায় আসলেন ভারতীয় অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে ধাক্কা দেয়ার কারণেই। ঘটনাটির কিছুক্ষণ পরেই ধোনির উইকেট নিয়ে নিজের খেলা ১৫০ ওয়ানডেতে উদযাপনের যে উন্মত্ততা দেখাননি সেটাই দেখিয়েছিলেন সাকিব। তবে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে প্রতিশোধটা নিজেই নিয়ে নিলেন মুস্তাফিজ। পুরো গ্যালারিই জেগে উঠল। এবার ’মওকা’ মতোই ধোনিকে পেয়েছে দেশের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শক-ভক্তরা। আর আনন্দে, আবেগে যেন পাগলই হয়ে গেলেন মুস্তাফিজ। মিরপুরের গ্যালারিতে শোরগোল উঠল তীব্রকণ্ঠে, ২৫ হাজার দর্শক সমবেত কণ্ঠে চিৎকার দিলেন, ‘মওকা, মওকা’। এবার বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মুখোমুখি হওয়ার আগে ভারত এ দুটি শব্দগুচ্ছ অপমানজনকভাবে ব্যবহার করেছিল ওই ম্যাচ উপলক্ষে নির্মিত এক বিজ্ঞাপনচিত্রে। এটা সেই মওকা। আর তরুণ মুস্তাফিজ দেশের মানুষকে সুযোগ করে দিলেন সেটা সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেয়ার। ভারতীয় দল টস জিতে ব্যাটিং নিতেই মিরপুরের দর্শকরা নীরব হয়ে গেলেন। কারণ ভারতীয় দলের বিশ্বসেরা ব্যাটিংয়ের ক্ষমতাটা সবারই ভালভাবে জানা। আগে ব্যাট করে ভারতীয় দল বাংলাদেশের বোলিংকে দুমড়ে-মুচড়ে একটা উড়ন্ত সূচনা দেয়ার ক্ষমতাই রাখে। কিন্তু মিরপুরের দর্শকদের নীরবতা উল্লাসধ্বনিতে রূপান্তর হতে সময় লাগেনি। মুস্তাফিজ ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই ফিরিয়ে দিয়েছেন ওপেনার রোহিতকে। উল্লাসে কেঁপে উঠেছে ‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম। তবে এরপর ধাওয়ান-কোহলি ৭৪ রানের জুটি গড়ে ভারতকে একটা ভাল অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন। নাসির এ দু’জনকেই ফিরিয়ে দেন। তবে এক উইকেট নেয়ার পর তেমন সুবিধা করতে না পারার কারণে মুস্তাফিজকে সরিয়ে নিয়েছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। প্রথম স্পেলে ৫ ওভারে ৩২ রান দিয়ে এক উইকেট শিকার করেন তিনি। ইনিংসের ৩৬তম ওভারে আবার ফিরে আসেন তিনি। আর ফিরেই আবার আঘাত হানেন মুস্তাফিজ। ফিরিয়ে দেন ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা সুরেশ রায়নাকে। আগের ম্যাচে ধোনির সঙ্গে একটা মানসিক লড়াই হয়েছিল মুস্তাফিজের। সে ম্যাচে ধোনিকে জবাবটা দিতে পারেননি। এবার তাকে মোক্ষম জবাব দিয়েছেন এ তরুণ। ধস ঠেকানোর জন্য ব্যাটিংঅর্ডার পরিবর্তন করে আগে ভাগে নেমেছিলেন অধিনায়ক ধোনি। ক্রমেই তিনি দলকে দারুণ এক অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যে কাটারের জন্য প্রথম ওয়ানডেতে নিজেকে ভয়ঙ্করতম হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন সেই কাটারেই পরাস্ত করলেন ধোনিকে। ফিরিয়ে দিলেন সাজঘরে। পুরো স্টেডিয়াম তখন ‘মওকা, মওকা’ ধ্বনিতে ফেটে পড়ল। পরের বলেই অক্ষর প্যাটেলকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে হ্যাটট্রিকের সুযোগ সৃষ্টি করেন মুস্তাফিজ। তবে হ্যাটট্রিক বলে রবিচন্দ্রন অশ্বিন সে যাত্রা এক রান করে ঠেকিয়ে দেন মুস্তাফিজকে। কিন্তু অশ্বিনকে নিজের পরবর্তী ওভারেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ৬ উইকেট শিকারি হয়ে ওঠেন মুস্তাফিজ। যা ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে মাত্র একবারই ঘটেছে। অভিষেক ম্যাচ এবং ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ম্যাচে ৬ উইকেট শিকারের একমাত্র ঘটনাটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘটিয়েছিলেন জিম্বাবুইয়ের পেসার ব্রায়ান ভিটোরি। তিনি ২০১১ সালে হারারেতে ১২ ও ১৪ আগস্ট নিজের ক্যারিয়ারের টানা দুই ম্যাচে মোট ১১ উইকেট শিকার করলেন। এবার ভারতের বিরুদ্ধে আরও বড় ঘটনার জন্ম দিলেন মুস্তাফিজ। যারা ভেবেছিলেন দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ভারতের শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের বিরুদ্ধে দারুণ কিছু করাটা কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে মুস্তাফিজের জন্য সেটাকে ভুল প্রমাণ করেছেন তিনি। এবার ৬ উইকেট শিকার করে নতুন ইতিহাস গড়ার মাধ্যমে মুস্তাফিজ ধসিয়ে দিলেন ভারতের ব্যাটিং। দ্বিতীয় স্পেলে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে একের পর এক ভয়ঙ্কর কাটার দিয়ে ৪.৫ ওভার বোলিং করে মাত্র ১১ রান দিয়ে আরও ৪ উইকেট শিকার করেছেন তিনি। সবমিলিয়ে ১০ ওভারে ৪৩ রানে ৬ উইকেট শিকার করে ভারতের জন্য সাক্ষাত যমদূত হিসেবে আবির্ভুত হন মুস্তাফিজ।
×