ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হাসপাতালের পোস্টমর্টেম

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৫ জুন ২০১৫

হাসপাতালের পোস্টমর্টেম

হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে অসহায়ভাবে স্ত্রীকে ধরে আছেন মোহন মাস্টার। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন ভদ্র মহিলা। মাঝে মধ্যেই ডুকরে কেঁদে উঠছেন। পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে ভোরবেলা এসেছেন ঢাকায়, দেশের বড় সরকারী হাসপাতালে। কিন্তু ভর্তি করাতে পারছেন না। কর্তব্যরত ডাক্তার সিট নেই বলে কিছু টেস্ট দিয়েছেন বাইরে থেকে করিয়ে আনতে। প্রায়ই দৈনিক পত্রিকায় দেখা ঢাকা মেডিক্যালের করিডোরে পড়ে থাকা রোগীদের দুর্দশার ছবির সঙ্গে নিজের আজকের অবস্থার মিল খুঁজে পেলেন তিনি। উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার বলেছেন এ্যাপিন্ডিসাইটিস। তাড়াতাড়ি অপারেশন করাতে। নইলে ফেটে গেলে...। তাই রাতের ট্রেনেই এসেছেন ভাল চিকিৎসার আশায়। এ্যাপ্রোন গায়ে, গলায় স্টেথো ঝুলানো একজন জানালেন কম খরচে ভাল চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেবেন। মোহন মাস্টার যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। সেই লোকই একজনকে সঙ্গে দিলেন ক্লিনিকে যাওয়ার জন্য। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খেলেন টেস্টের বিল দিতে গিয়ে। নার্স এসে জানালেন অপারেশনের আগে তিনব্যাগ ‘ও’ নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের ব্যবস্থা করতে। নার্সের কথা শুনে মাথায় হাত। তিনি জানেন তাঁর স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ ‘ও’ পজেটিভ। তবে কী বয়স হলে রক্তের গ্রুপ পাল্টে যায়! নাকি পরীক্ষা না করেই বলে দেয়া হলো? কৃশকায় একজন জানালেন তিনিই ব্যবস্থা করে দেবেন, তবে অগ্রিম টাকা দিতে হবে। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে টাকা দিলেন। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রক্তও আসে না, অপারেশনের ব্যবস্থাও হয় না। স্যালাইন নিয়ে আসে, মোহন মাস্টার পরখ করে দেখেন ডেট অনেক আগেই চলে গেছে। সন্ধ্যায় ডাক্তার এসে অপারেশনের জন্য ক্যাশে টাকা জমা দিতে বলেন। কাউন্টারে গিয়ে টাকার অংক শুনে মাথার ওপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে মোহন মাস্টারের। সঙ্গে যা টাকা-কড়ি এনেছিলেন তার সিংহভাগ খরচ হয়ে গেছে। এখন উপায়? অনুনয় করে লাভ হলো না। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন রোগী। স্ত্রী করুণ চোখে আর্তনাদ করে যেন বলছেন ‘আমাকে বাঁচাও! বড় আশা করে ক্লিনিকের পরিচালককে নিজের পরিচয় দিয়ে পরে টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেন। উত্তর পেলেন সিট ভাড়া পরিশোধ করে রোগী নিয়ে চলে যাওয়ার। চিরজীবন ছাত্রদের শিখিয়েছেন মানুষের সেবা করতে। তবে কী পবিত্র ধর্মগ্রন্থে লেখা অমোঘ বাণীর মর্মকথা ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’ এই ঘোর কলি যুগে অচল! সরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারীভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা ক্লিনিকগুলো কি সেবাকেন্দ্র? না বাণিজ্যকেন্দ্র! না কী ‘জল্লাদের দরবার!’ সেবার ব্রত নিয়ে যারা জনগণের টাকায় ডাক্তার হয়েছেন তাদের মানবিক মূল্যবোধ কী সেই টাকার কাছেই নুয়ে পড়েছে! স্ত্রীকে নিয়ে ক্লিনিক থেকে বাড়ি ফেরার পথে রাগে-দুঃখে, অভিমানে বৃদ্ধ মোহন মাস্টার বলে ওঠেন- ‘এসব মৃত পচে-গলে যাওয়া হাসপাতাল আর ডাক্তারদের পোস্টমর্টেম করে দেখা দরকার, তাদের কোথায় পচন ধরেছে!’ তেজগাঁও, ঢাকা থেকে দীর্ঘশ্বাসের নাম হাসপাতাল ইসমত পারভীন রুনু অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের ধর্মঘট আহ্বান, বিভিন্ন ইস্যুতে নার্সদের কর্মবিরতি পালন, কর্মচারীদের তীব্র অসন্তোষ, বিনা চিকিৎসায় আর অবহেলায় কাছের মানুষ কিংবা প্রিয় সোনামণিকে চিরতরে হারিয়ে রোগীদের বিক্ষোভ, হাসপাতাল কক্ষ ভাংচুরÑ এসব অপ্রীতিকর ঘটনার মাঝেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে আমাদের হাসপাতালগুলো। সেবা ধর্ম সেবাই কর্মÑ এ মনোভাব যখন বাণিজ্যে রূপ নেয়, তখন আর সুস্থ থাকা! সুস্থতার মোড়কে কেবলই বিড়ম্বনার হাতছানি। ভুয়া চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য, যত্রতত্র ক্লিনিক ব্যবসা, অপরিকল্পিত ও মানহীন প্যাথলজিক্যাল ল্যাব, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, সিট বা বেড সমস্যা, ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা, দক্ষ-অভিজ্ঞ অপারেটরের অভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অনিশ্চয়তা, রোগ নির্ণয়ে বিভিন্ন রকম ভোগান্তি, বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহে অনীহা, ব্যবহার অনুপযোগী টয়লেট ব্যবস্থা, দুর্গন্ধযুক্ত ও ময়লা উপচেপড়া ডাস্টবিন, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট। এতসব সমস্যার মধ্যে সুস্থ থাকার বদলে অসুস্থ হওয়ারই আশঙ্কা বেশি। এগুলো কি বিড়ম্বনা নয়? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘হাসপাতাল চিকিৎসকদের মন্দির, রোগী দেবতা আর আমরা যাঁরা চিকিৎসক আছি, তাঁরা সেই দেবতার পূজারি’। স্যারের এ বক্তব্যে পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা, কর্তব্যবোধ ও দায়িত্বশীলতাই প্রকাশ পেয়েছে। এক্ষেত্রে আন্তরিকতার কোন বিকল্প নেই। টিবি গেট, সিলেট থেকে
×