ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবরোধহীন নারী

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ২৬ জুন ২০১৫

অবরোধহীন নারী

ছিলেন তাঁরা অন্ধকারে এক একটি বাতিঘর। আলো হাতে সকল বিপদে দুর্দিনে অন্ধকারে জাতিকে পথ দেখিয়েছেন গোটা জীবন ধরে তাঁরা। তাঁদের কাজ তাঁদের অগণিত মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। কথা ও কাজে মিল ছিল বলেই হয়ত অসংখ্য মানুষের অকুণ্ঠ ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা পেয়েছেন তাঁরা। সকল অন্যায় অসত্যের বিরুদ্ধে তাঁরা ছিলেন সদা প্রতিবাদী, মানুষের কল্যাণে সর্বদা নিবেদিত, অকুতোভয়, সকল সংগ্রামে ছিলেন দিশারী। জীবনের পুরো সময়টাই তাঁরা উৎসর্গ করেছেন নারীমুক্তি তথা মানুষ মুক্তির জন্য। সেইসব মহীয়সী নারী বিশ শতকে সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষার অগ্রগতি ও দেশাত্মবোধের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা তৈরি করেছিলেন। এ সময়ে উপমহাদেশ তথা বাংলায় নারীজাগরণ ঘটেছে ধাপে ধাপে। নারী জাগরণের এই সময়টায় অগ্রদূত সেইসব মহীয়সী অনেক পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তাঁরা নারী জাতিকে শিক্ষিত করে মানুষ হিসেবে সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবারে মর্যাদা দিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দিনের পর দিন নানামুখী চাপ সহ্য করেও তাঁরা থামেননি। যে সমাজে মেয়েরা ছিল সত্যিকার অর্থে অন্ধকারে, সে সমাজে মেয়েদের জন্য স্কুল চালু করেছেন এমনকি সাহিত্যচর্চাও করেছেন নিজ ভাষা ও আবেগকে আশ্রয় করে নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া। অবরোধবাসিনীকে তিনি উদার আকাশ ও বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখার পথ খুলে দিয়েছেন। তার ছাত্রী ও অনুসারীরা নারী শিক্ষার আলোকছটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশব্যাপী। সাহসে বুক বেঁধে সমাজের ভ্রƒকুটিকে উপেক্ষা করে ভয়াবহ প্রতিকূলতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রগুলো একে একে তৈরি করে দিয়েছেন। নারীর সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবির আগে তাকে মানুষ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়েছেন মহীয়সীরা তাঁদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে। নারী সমাজকে মুক্ত জগতে দাঁড় করতে তাদের এই নিরলস লড়াইয়ের মধ্যে ছিল না কোন কৃত্রিমতা। বরং ছিল গভীর আন্তরিকতা এবং কাজ করার অনন্য উদ্যম। ধর্মান্ধতাকে পেছনে ঠেলে তাঁরা বেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে দেখা যায়, নারী আবার মধ্যযুগীয় অবরোধবাসিনীতে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। মানসিক আধিপত্যে ক্রমশ ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও জঙ্গী শক্তির আধিক্য বাড়ছে। যে দীর্ঘ সংগ্রাম, লড়াই করে নারীজাগরণ ঘটিয়েছেন বেগম রোকেয়া থেকে কবি সুফিয়া কামাল পর্যন্ত, তা এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে হোঁচট খেতে পারে না। জননী সাহসিকা হিসেবে এ অঞ্চলের নারী জাগরণের উত্থানের আদর্শ সেই কবি সুফিয়া কামাল প্রেরণা যোগাবেনই। কারণ দীর্ঘদিন তিনি নারীর মুক্তিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকি রাজনৈতিক আন্দোলনে রাজপথে নেমেছেন, সবার মধ্যে সাহস যুগিয়েছেন। তার রেখে যাওয়া সেই পথ ধরে নারীরা এগিয়ে আসবে, অন্যায়-অনিয়ম, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি তার সময়ে ছিলেন সোচ্চার কণ্ঠ। প্রগতিশীল আন্দোলন ছিল তার আরাধনার প্রাণভূমি। যা বলেছেন, তাই পালন করেছেন। নারী সমাজের জাগরণের সাহসী অভিযাত্রিক এ মহীয়সীর আদর্শকে ধারণ করার অর্থই নারী ও সমাজের মুক্তি। মানুষ হিসেবে যে ক’জন বলিষ্ঠ ও দৃঢ়চেতা বাঙালী অমর হয়ে বিরাজ করছেন, সেই বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের মতোই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মহীয়সীরা। জাগ্রত থাকবেন নারী সমাজের ও অন্তরলোকে প্রেরণা বর্তিকা হয়ে। তাঁদের জীবনাচরণে খুঁজে নিতে হবেই আলোকবর্তিকার উজ্জ্বল আলো।
×