ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সালাতুত্্ তারাবীহ;###;অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মাহে রমাদানের খাস্্ ইবাদত

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ২৬ জুন ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ মাহে রমাদানের খাস্্ ইবাদত

রমাদান মাস, প্রাচুর্যের মাস। এ এক মহান মাস। সিয়ামের এই মাসে ইশার সালাত আদায় করার পরে এবং বিতরের সালাত আদায় করার পূর্বে দুই রাক’আত করে করে দশ সালামে যে বিশ রাক’আত সুন্নাত মুআক্কাদা সালাত আদায় করতে হয় তাকে বলা হয় সালাতুত্ তারাবীহ্ বা তারাবীহ্র নামাজ। তারাবীহ্্ শব্দের অর্থ বিরাম বা বিশ্রাম। এই সালাতে প্রতি দুই রাক’আত অন্তর কিছুক্ষণ বিরাম নেয়া হয়, যে কারণে একে সালাতুত্্ তারাবীহ্্ বলা হয়। এই সালাত আদায় করলে সায়িমের (রোজাদার) মননে এক অপূর্ব প্রফুল্লতা ও প্রশান্তি নেমে আসে। অন্তরের গভীরে এমন এক অনন্য জ্যোতির বিচ্ছুরণ ঘটে যার আভা প্রস্ফুটিত হয় তার চেহারায়। দিবসের প্রায় সাড়ে তেরো ঘণ্টা কঠিন কৃচ্ছ সাধনের পর ইফতারের মধ্য দিয়ে সায়িমের মধ্যে যে আনন্দ আভা বিম্বিত হয় তা সুদৃঢ় হয়ে ওঠে কুড়ি রাক’আত তারাবীহ্্র সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। এছাড়াও এই সালাত পড়লে গোনাহরাশি ক্ষমা করা হয়। হাদিস শরীফে তারাবীহ্্র সালাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু থেকে বর্ণিত একখানি হাদিস আছে, কালা সামি’তু রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইয়াকুলু লি রমাদানা মান কামাহু ইমানানান ওয়া ইহ্তিসাবান গুফিরালাহু মা তাকাদ্দামা মিন যাম্বিহ্্- তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি রমাদানে ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় তাতে দ-ায়মান হবে, তারাবীহ্্র সালাত আদায় করবে তাঁর পূর্ববর্তী গোনাহ্্সমূহ মাফ করে দেয়া হবে (বুখারী শরীফ)। এখানে উল্লেখ যে, রমাদানের রাত্রিতে জাগরণ বা দ-ায়য়মান হওয়া দ্বারা তারাবীহ্্ সালাতকেই বোঝানো হয়েছে। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি মোতাবেক দ্বিতীয় হিজরীর শা’বান মাসের শেষ তারিখের দিবাগত রাত তথা পহেলা রমাদান রাতে (বাদ ’ইশা) সর্বপ্রথম তারাবীহ্্র সালাত মসজিদুন্্ নববীতে প্রিয়নবী হযরত রসুলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম আদায় করেন। প্রিয়নবী রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী আয়িশা রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হা থেকে বর্ণিত আছে যে, রসুলুল্লাহ্্ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম সালাত (তারাবীহ্্র সালাত) আদায় করেন এবং তা ছিল রমাদানে। মূলত আগে মসজিদুন্্ ননবীতে একাধিক জামা’আতে একই সময় তারাবীহ্র সালাত সাহাবায়ে কেরাম আদায় করতেন, কেউ কেউ একাকীও পড়তেন। তারাবীহ্্র সালাতে কোরান মজীদ তিলাওয়াত সশব্দ হওয়াতে অনেকের কোরান পাঠের আওয়াজ উত্থিত হতো, মসজিদে নববীতে হযরত উমর ইবনুুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু এক ইমামের নেতৃত্বে এই সালাতের জামা’আত ব্যবস্থা চালু করেন। আমরা জানি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাবের দশ বছরের খিলাফত (৬৩৪-৬৪৪ খ্রি) আমলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গৃহীত হয় তার মধ্যে এই তারাবীহ্্র সালাতের জামা’আত ব্যবস্থাও একটি। সম্ভবত এই জামা’আত ব্যবস্থা চালু হয় ৬৪১ খ্রিস্টাব্দে। এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি হিজরী সনের প্রবর্তন করেন ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে। একখানি দীর্ঘ হাদিসে আছে যে, হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি রমাদানে ইমানের সঙ্গে সওয়াব লাভের আশায় তারাবীহ্র সালাতে দাঁড়াবে তাঁর পূর্ববর্তী গোনাহ্সমূহ মাফ করে দেয়া হবে। শিহাবের পুত্র বলেন যে, হযরত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করলেন, তারপরও এটা একই ভাবে চলে আসছিল। এমনকি হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু তা’আণা আন্্হুর (প্রায় আড়াই বছরের) খিলাফতকালে এবং হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর খিলাফতের প্রথমভাগে এ রকমটাই ছিল। ইব্নে শিহাব উরওয়া ইব্নে যুবায়র সূত্রে আবদুর রহমান ইব্নে আব্্দ আল-কারী থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রমাদানের এক রাতে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর সঙ্গে মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পেলাম যে, লোকেরা বিক্ষিপ্ত জামা’আতে বিভক্ত। কেউ একাকী সালাত আদায় করছে আবার একজন সালাত আদায় করছে আর তাঁকে ইক্তিদা করে একদল লোক সালাত আদায় করছে। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু (এসব দেখে) বললেন : আমি মনে করি যে, এই লোকদের একজন কারীর (ইমামের) পেছনে একত্রিত করে দিলে সেটাই উত্তম হবে। এরপর তিনি উবাই ইব্নে কা’বের পেছনে সবাইকে কাতারবন্দী করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। পরে আরেক রাতে আমি তাঁর সঙ্গে বের হলাম। তখন লোকেরা তাদের ইমামের সঙ্গে সালাত আদয় করছিল। হযরত উমর রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু এটা দেখে বললেন : অপূর্ব সুন্দর এই নতুন ব্যবস্থা (বুখারী শরীফ)। হযরত উসমান (রা), হযরত আলী (রা), হযরত যুবায়র (রা), হযরত আবদুর রহমান ইব্নে আউফ (রা)-সহ সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিশ রাক’আত তারাবীহ্র সালাত আদায় করার ব্যাপারে সবাই ঐকমত্য পোষণ করে তা আমল করতে থাকেন। এখানে উল্লেখ্য যে, এই সালাতে যিনি ইমাম ছিলেন সেই হযরত উবাই ইব্নে কা’ব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু প্রখ্যাত মুফতী ছিলেন। কোরান মজীদ ব্যাখ্যার ব্যাপারে তিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। তিনি মদিনা সনদ লিপিবদ্ধ করেন। তাঁর পা-িত্যের তারিফ প্রিয়নবী (সা) করেছেন। তাঁরই ইমামতিতে কুড়ি রাক’আত তারাবীহ্্র সালাত আদয় হয়েছিল। সেই যে বিশ রাক’আত তারাবীহ্্র সালাত জামা’আতের সঙ্গে শুরু হলো রমাদান মাসে সমজিদুন নববীতে তা আজও আদায় হয়ে আসছে, মক্কার মসজিদুল হারামেও এই বিশ রাক’আত সালাতুত্ তারাবীহ্ পড়া হয়। পৃথিবীর সব দেশেই বিশ রাক’আতই পড়া হয়। তবে উপমহাদেশে সংখ্যায় খুবই কম একটি দল ৮ রাক’আত তারাবীহ্্র সালাত আদায় করে। তারা প্রধানত লা ময্হাবী নামে পরিচিত। তারা নিজেদের আহলে হাদিস বলে পরিচয় দেয়। অন্যদিকে মালিকী ময্্হাবের অনুসারীগণ ৩৬ রাক’আত পড়ে বলে জানা যায়। শীআ ফিক্্হ-এ রমাদান মাসে অতিরিক্ত এক হাজার রাক’আত সালাতের উল্লেখ আছে। তারাবীহ্্র সালাতে প্রত্যেক দুই রাক’আত শেষে একটা দরুদ শরীফ পাঠ করার রীতি রয়েছে আর তা হচ্ছে : আল্লাহুম্মা সাল্লিয়ালা সাইয়্যিদিনা মওলানা মুহম্মদ। তারাবীহ্্র সালাতের চার রাক’আত পরে বিরামকালে যে দু’আখানি পাঠ করা হয় তা হচ্ছে : সুবহানা যিল্্ মুল্্কি ওয়াল মালাকুতি সুবাহানা যিল্্ ইয্্যাতি ওয়াল আযমাতি ওয়াল হায়বাতি ওয়াল কুদরাতি ওয়াল কিবরিয়ায়ী ওয়াল জাবারুত, সুবহানাল মালিকিল হায়য়িল্লাযী লা ইয়ানামু ওয়ালা ইয়ামুতু আবাদান আবাদান সুব্বুহুন কুদ্দুসুন রব্বুনা ওয়া রব্বুল মালায়িকাতি ওয়াররূহ্্Ñ পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার রাজ্য ও রাজত্বের অধিপতি (রাজাধিরাজ), পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি তাবত্্ ইজ্জত্, মহত্ত্ব প্রতাপ-প্রতিপত্তি, শক্তিমত্তা, সৌকর্য ও মাহাত্ম্যের অধিপতি, পবিত্রতা ঘোষণা করছি সেই মহান সত্তার যিনি মালিক চিরঞ্জীব, যাঁর কোন নিদ্রা নেই, যাঁর কোন মৃত্যু নেই, তিনি বর্তমান চিরদিন চিরকাল, তিনি মহিমাময় পবিত্র, তিনিই আমাদের রব্্ এবং ফেরেশতাদের ও আত্মার রব্্। এই দু’আ পাঠ শেষে মুনাজাত করতে হয়। তারাবীহ্্র সালাতের মুনাজাত হিসেবে বহুল প্রচলিত মুনাজাতটি হচ্ছে : আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকাল জান্নাতা ওয়া নাউযুবিকা মিনান্নার, বিরাহমাতিকা ইয়া আযীযু ইয়া গাফ্ফারু ইয়া কারীমু ইয়া সাত্তারু ইয়া রাহীমু ইয়া জাববারু ইয়া খালিকু ইয়া র্ব্রাু, আল্লাহুম্মা আর্জিনা মিনান্নারি ইয়া মুজীরু ইয়া মুজীরু বিরাহ্্মাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীনÑ হে আল্লাহ্্! যে জান্নাত ও দোযখের স্রষ্টা, আমরা আপনাদের নিকট চাচ্ছি জান্নাত এবং আশ্রয় চাচ্ছি দোযখের আগুন থেকে। আপনার রহমত কামনা করছি, হে প্রিয়, হে মহাক্ষমাশীল, হে মহামান্য দয়াবান, হে দোষ গোপনকারী, হে মহাপরাক্রমশালী, হে মহান স্রষ্টা, হে মহাহিতকারী, আপনি আপনার রহমত দ্বারা আমাদের দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করুন, হে রক্ষাকারী, হে রক্ষাকারী, হে রক্ষাকারী। হে পরম করুণাময় দয়ালু দাতা। জানা যায়, বিশ রাক’আত তারাবীহ্্র সালাতের সুবিধার্থে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফ্্ফান রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হু ৩০ পারা কোরান মজীদকে ৫৪০ রুকুতে বিভক্ত করেন, যাতে প্রত্যেক দিন বিশ রাক’আত তারাবীহ্্র সালাতে ২০ রুকু পাঠ করে ২৭ রমাদানের অর্থাৎ লায়লাতুল কদরে এক খতম কোরান হয়। রমাদানুল মুবারকের এই খাস সালাতে কোরান মজীদের তিলাওয়াত শোনা মুস্তাহাব। এই সালাত একাকী গৃহে আদায় করা যায়, তবে জামা’আত আদায় করা উত্তম। হাদিস শরীফে আছে যে, প্রত্যেক রমাদানে হযরত রসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু ’আলায়হি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরাঈল ’আলায়হিস্্ সালামকে সেই রমাদান পর্যন্ত নাযিল হওয়া কোরান মজীদ শোনাতেন এবং নিজে শুনতেন। সালাতুত্্ তারাবীহ্্র জামা’আতকে ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের প্রশিক্ষণ বললে অত্যুক্তি হবে না। মাহে রমাদানেই এই সালাত আদায় করতে হয়, যে কারণে এর গুরুত্ব ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অপরিসীম। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী কুতবুল আলম হযরত মওলানা শাহ্্ সুফী আলহাজ তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহ ’আলায়হি বলেছেন : দিবসে সিয়াম পালন করার মাধ্যমে যে দৈহিক ও মানসিক শুদ্ধতা অর্জিত হয়, রাতে তারাবীহ্্র নামাজ পড়ে দেহ-মন প্রশান্ত হয়ে যায়। লেখক : পীরসাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) সাবেক পরিচালক ইসলাামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×