সংসদ রিপোর্টার ॥ প্রস্তাবিত বাজেটের কিছু অংশের কড়া সমালোচনা করলেন সরকারের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। সন্ত্রাসী দল হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীকে এখনও নিষিদ্ধ না করার সমালোচনা করে সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেন, এ ধরনের সন্ত্রাসী দল কখনই গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে পারে না। সব কূল হারিয়ে বিএনপি এখন রাজনৈতিক সমঝোতা চায়। তবে সমঝোতা করতে হলে বিএনপিকে আগে জামায়াতকে তালাক দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসতে হবে।
বুধবার জাতীয় সংসদে প্রথমে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং পরে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তাঁরা এসব কথা বলেন। বাজেট আলোচনাকালে অর্থমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতির ঘটনাতেও সমালোচনায় মুখর ছিলেন বেশ কয়েকজন সিনিয়র সংসদ সদস্য।
বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সরকারী দলের মন্ত্রী মোঃ ছায়েদুল হক, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, আবদুল মান্নান, ড. হাছান মাহমুদ, প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, হুইপ আতিউর রহমান আতিক, টিপু মুন্সী, সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, সিমিন হোসেন রিমি, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, এম এ মালেক ও শফিকুল ইসলাম শিমুল এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু, মোহাম্মদ ইলিয়াস ও নাসরিন জাহান রতœা।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বাজেটের সমালোচনা করেছেন। বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, ব্যাংকিং খাত, বিদ্যুত খাত ও শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করেন তিনি। জামায়াতে ইসলামী সন্ত্রাসী দল হিসেবে অভিযুক্তÑ এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ ধরনের দল গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে পারে না। জামায়াত নিষিদ্ধ এখন মানুষের দাবি।
বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করে মেনন বলেন, সমস্ত কূল হারিয়ে বিএনপি এখন রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলছে। সমঝোতা করতে হলে বিএনপিকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ফিরে আসতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে। তিনি বলেন, জামায়াত কেবল যুদ্ধাপরাধীর দল নয়, জামায়াতের ক্যাডাররাই আনসারুল্লাহ, জেএমবিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। জামায়াতের সমর্থন নিয়েই নিত্যনতুন সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে উঠছে।
জামায়াত নিষিদ্ধ না হওয়ায় সরকারের সমালোচনা করে বিমানমন্ত্রী বলেন, তারা সন্ত্রাসী দল হিসেবে অভিযুক্ত। এ ধরনের দল গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে পারে না। এই দল নিষিদ্ধ মানুষের দাবি। এ সম্পর্কিত আইন প্রস্তুত বলে আইনমন্ত্রী বেশ কয়েকবার বলেছেন। কিন্তু সেই আইন আলোর মুখ দেখছে না। কেন দেখছে না, সেটার কোন ব্যাখ্যা আমাদের জানা নেই। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ না নেয়ায় সমালোচনা করে মেনন খান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ধর্ষণের রঙ্গমঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে আমরা সঠিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারিনি। দেশের নারীর ক্ষমতায়নের কথা গর্ব করে বলা হলেও যে দেশের নারীরা রাত-বিরাতে তাদের চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করে না, সে দেশকে সভ্য দেশ বলে গণ্য করা যায় না।
ব্যাংকিং খাতের সমালোচনা করে তিনি বলেন, একদল লোক দেশের সম্পদ লুটে নিচ্ছে। অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে সোচ্চার। তবুও বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করা যাচ্ছে তিনি এদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অক্ষম। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির সুফলের সামনে দুর্নীতির বড় বাধা। বিশ্বব্যাংক বলেছে, দুর্নীতির কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধির আড়াইভাগ লস হয়। দুর্নীতি দূর হলে দারিদ্র্য ১১ শতাংশে নেমে আসবে। তিনি বলেন, হাওয়া ভবনের দুর্নীতি দেখেছি। আজ হাওয়া ভবন নাই, কিন্তু হাওয়া ভবনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন তারা ভোল পাল্টিয়ে সমাজে একইভাবে অবস্থান করছেন।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘাটতির সমালোচনা করে বলেন, বাজেট ঘাটতি বাড়তেই থাকলে দেশ কী সামনের দিকে সত্যিই এগোচ্ছে? এতবড় ঘাটতি বাজেট নিয়ে বাজেট বাস্তবায়নেই শঙ্কা তৈরি হয়েছে। মানি মার্কেটে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক থেকে যে ১০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হলো, সেগুলো কাদের টাকা? যারা লুটপাট করে গেল তাদের ধরার কোন উদ্যোগ নেই। অথচ এ বিষয়ে বাজেটে কোন বক্তব্য নেই।
তিনি বলেন, ব্যাংকের টাকা লুট হয়ে যাচ্ছে। আর ব্যাংকগুলোকে নিয়মিত ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। এভাবে চলতে পারে না। তিনি সুইস ব্যাংকে নিয়মিত বাংলাদেশীদের টাকা জমার পরিমাণ বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে ওই টাকা দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান। বাজেটের ওপর আলোচনাকালে অর্থমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত না থাকার কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, যাদের উদ্দেশে বলছি তারাই এখানে নেই। তাহলে আমরা কী শুধু সংসদে রেকর্ড রাখার জন্য আলোচনা করছি?
ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসংযোগ ও মানুষ পুড়িয়ে হত্যার সমালোচনা করে বলেন, মীরজাফর গোলাম আযম, জিয়াউর রহমানদের উত্তরসূরি বিএনপি-জামায়াত দেশকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। খালেদার নির্দেশে তারা সন্ত্রাস-নির্যাতন চালাচ্ছে। মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করছে। তারা ভূমি অফিসেও আগুন দিয়েছে। অগ্নিসংযোগকারীরা দেশের শত্রু উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা স্বাধীনতা ও মানবতায় বিশ্বাস করে না, তাদের আবার কিসের মানবাধিকার? কিসের মৌলিক অধিকার? দেশ ও জাতির স্বার্থে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বাল্যকালে খালেদা জিয়া আদর্শলিপি পড়েননি মন্তব্য করে বলেন, বাল্যকালে আমরা আদর্শলিপি পড়েছিলাম। এতে বলা ছিল অ-তে, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর। কিন্তু খালেদা জিয়া এ আদর্শলিপি পড়েননি। এজন্য তিনি অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করেননি। বাস্তবে খালেদা জিয়া অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করে জামায়াতকে তালাক দিলে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও পরিচ্ছন্ন হবে।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া জীবনে অনেক ভুল করেছেন। জীবনের শুরু থেকে ভুল করেছেন, এখন রাজনৈতিক জীবনেও করছেন। এখন তিনি বাড়িতে বসে বসে গান গাইছেনÑ ‘ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল।’ তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিল তা বাংলাদেশের শ্রমিক, পেশাজীবী, মুক্তিযোদ্ধাসহ সবাই মিলে প্রতিহত করেছি। খালেদা জিয়া বিজয় নিয়ে বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমরা তা প্রতিহত করেছি। বাংলাদেশ কখনই সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কাছে মাথানত করবে না বলে তিনি দাবি করেন।
অনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দাবি করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মোঃ ছায়েদুল হক বলেন, চীন, ভারতসহ প্রবৃদ্ধির হার বেশিরভাগ তালিকায় থাকা ৫টি দেশের একটি বাংলাদেশ। এই প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ২০২১ সাল নয়, ২০১৮ সালেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। সমুদ্র বিজয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, এই বিজয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরকারী দলের সিনিয়র সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র রক্ষা করেছেন, আর খালেদা জিয়া সেই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। জামায়াত নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার কারণেই খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ না নিয়ে সব হারিয়েছেন। পরে উনি শর্ত দিয়েছেন জামায়াতের নিবন্ধন ফেরত ও যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া সরকারের কাছ থেকে কোন দাবিই আদায় করতে না পেরে পরাজিত হয়ে ঘরে ফিরেছেন।
সরকারী দলের ড. হাছান মাহমুদ বলেন, যারা ঘাটতি বাজেট নিয়ে সমালোচনা করেন, তাদের উচিত সমালোচনার আগে সর্বাগ্রে এ নিয়ে পড়াশোনা করা। ভারত, জাপানসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ঘাটতি বাজেট থাকে। তিনি শিক্ষার্থীদের ওপর করারোপ এবং সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান।
বর্তমান সরকার টেলিকম খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন হয়েছে দাবি করে প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, সরকারের দূরদর্শী চিন্তাভাবনার কারণে টেলিকম খাতে বিশ্বের ৫ম বৃহৎ দেশ বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে আইসিটি পলিসি তৈরি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে টেলিকম নীতিমালা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে আইসিটি খাত হতে এক বিলিয়ন ডলার রফতানি আয় করা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
নির্বাচনী এলাকায় আনুপাতিক হারে বরাদ্দের দাবি জানান হুইপ আতিউর রহমান আতিক। তিনি বলেন, বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির বিষয়টি উপেক্ষা করলে শিক্ষা খাতে আমাদের অগ্রগতি মুখথুবড়ে পড়বে। তাই এই খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। তিনি বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর করারোপের প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি টিপু মুন্সী দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের সফলতার কথা তুলে ধরে বলেন, নতুন বেতন কাঠামো কার্যকর হলে বাজার ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হতে পারে। এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হতে হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: