ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

একটি বিরল দৃষ্টান্ত

জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয় হলে ভাঙ্গন ঠেকিয়ে ভিটা ফসল রক্ষা পায়

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৮ জুন ২০১৫

জনপ্রতিনিধিরা সক্রিয় হলে ভাঙ্গন ঠেকিয়ে ভিটা ফসল রক্ষা পায়

সমুদ্র হক ॥ নদী তীর ও চরগ্রামে বর্ষার এই ভীতিকর সময়টায় মানুষ তখনই স্বস্তি পায় যখন সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের গতি সরাসরি দেখতে পায়। বগুড়ার যমুনা তীরের সারিয়াকান্দিতে তাই ঘটেছে। বলা হয় যমুনা ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ নদী। যুগ যুগ ধরে নদী শাসন করে বশ মানাবার চেষ্টা করেও বেশিরভাগ সময়ই ব্যর্থ। তারপরও মানুষকে রক্ষায় এগিয়ে আসে মানুষ। এভাবেই এবার যমুনাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলীদের সঙ্গে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরা যোগ দিয়ে সহযোগিতা করে বড় একটি এলাকার ভাঙ্গন ঠেকিয়ে বাঁধের নির্মাণ গতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। ভীতি কেটেছে এলাকার মানুষের। মানুষের জন্য নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সোচ্চার হলে কত দ্রুত দুর্যোগ থেকে এলাকার মানুষ জানমাল বাসস্থানের নিরাপত্তা পায় তাও পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। গত ১২ জুন অসময়ে যমুনার পানি অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে সারিয়াকান্দির কামালপুর ইউনিয়নের গোদাখালি অংশে নির্মাণাধীন বাঁধ ভেঙ্গে যায়। এলাকার লোকজন দুর্যোগের পূর্ব অভিজ্ঞতায় চরগ্রামের বাড়িঘর সরিয়ে নিতে থাকে। তারা বুঝতে পারে বাঁধ যখন ভেঙ্গেছে তখন এ বছর আর ঠিক হবে না বাড়ি ঘর নদীগর্ভে যাবে। ফের যদি কখনও জেগে ওঠে তখন ভিটা ফিরে পেলেও পেতে পারে। এই অবস্থায় ওই আসনের সংসদ সদস্য মোঃ আব্দুল মান্নান উত্তাল নদীতে নৌকা করে মানুষের বাড়িতে গিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে রাত জেগে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও পাউবোর প্রকৌশলীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দেন এবং সরকারের ওপর মহলে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করে যখন যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করেন। দশদিনের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে নির্মাণাধীন বাঁধের কাজ দ্রুতগতিতেই এগিয়ে যায়। এলাকার মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে আসে এই ভেবে এতকাল শুধু ভাঙ্গন দেখেছে, ক্ষতি দেখেছে। কি ভাবে কত দ্রুত তা ঠেকানো যায় এবার তাও দেখল। এর আগে ওই এলাকার ঘুঘুমারি রৌহদহ পয়েন্টে গত বছরের ভাঙ্গনে বাঁধ নদীগর্ভে চলে যায়। উপজেলার ৫ ইউনিয়নের বিস্তর ক্ষতি হয়। কুতুবপুর কামালপুর ও চন্দনবাইশা ইউনিয়নের শতাধিক কিলোমিটার কাঁচা-পাকা রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট ধসে যায়। যমুনায় তলিয়ে যায় রৌহদহ বাজারের শতাধিক দোকানপাট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মসজিদ ও কয়েক হাজার বাড়ি। বহু আবাদি জমির ফসল নষ্ট হয়। এই অবস্থায় সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান প্রকৌশলীদের সঙ্গে বসে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসা যমুনার গতি প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত দেন যমুনার পানি যাতে পশ্চিমে প্রবেশ করতে না পারে এ জন্য বিকল্প পন্থায় বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। যাতে যমুনা তার চেনা পথ খুঁজে না পায়। প্রসঙ্গত হার্ড পয়েন্ট নির্মাণের সময় দেশী-বিদেশী প্রকৌশলীরাও যমুনার চেনা পথ বন্ধে ব্যবস্থা নেয়। কারণ যমুনা চেনা পথ হারিয়ে ফেললে তা খুঁজতে অনেক সময় নেয়। ততদিনে প্রকৌশলীরা ঠিকমতো স্যাটেলাইট রিডিং নিয়ে যমুনার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বড় ধরনের ক্ষতি আর হয় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের মধ্যে অদৃশ্য এক বাঁধনে এই কাজ হয় না। সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান এবার এই জায়গাটির লাগাম টেনে ধরেছেন। যাতে কোনভাবেই কেউ নয়ছয় করতে না পারে। ভূমি হুকুমদখল বিষয়ক জটিলতা ও দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করলে বন্যার আগে বাঁধ নির্মিত নাও হতে পারে এমন ভাবনায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ের মতামত নিয়ে এবং সরকারের ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ নৌ বাহিনীকে বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়। কুতুবপুর ইউনিয়নের বড়ইকান্দি থেকে কামালপুর পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ মেলে ২০ কোটি টাকা। কাজের শুরুতেই বাঁধের পুরো সেকশনে ড্রেজার ও আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে স্থানীয় কৌশলকেও কাজে লাগানো হয়। বাঁধের কাজের শুরুতেই বাঁধের পুরো সেকশনে ড্রেজার ও আধুনিক যন্ত্রের সঙ্গে স্থানীয় কৌশলকেও কাজে লাগানো হয়। যাতে বাঁধের মাটির কম্পেকশন ঠিক থেকে সীপেজ না হয়। সীপেজ হলো কোনভাবে বাঁধে ছিদ্র বড় আকার ধারণ করে পানি প্রবেশ করে ঝরনার মতো অবস্থা হওয়া। এইসব ব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিক প্রকৌশল সমন্বয় করে বাঁধ নির্মাণের পূর্বের জিওটেক্সসহ সকল টেকনোলজি আধুনিকায়ন করা হয়। এভাবেই এগিয়ে যায় বাঁধ নির্মাণের কাজ। পাউবোর কর্মকর্তাগণ জানান, এবার বর্ষায় বৃষ্টির মাত্রা বেশি। তবে পানি বিপদসীমার নিচ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। কখনও বেড়ে গেলেও তা নাগালের মধ্যে থাকছে। বন্যার পানি যাতে বাঁধের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পারে তার সকল ব্যবস্থাই করা আছে। এই নির্মাণের ফলে শুধু সারিয়াকান্দি এলাকার মানুষ নয় পার্শ্ববর্তী যমুনা তীরের ধুনট ও সিরাজগঞ্জের বড় এলাকার মানুষ দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। এবারের উপলব্ধিতে এলাকার মানুষের কথা-ভোটে নির্বাচিত ব্যক্তি পাশে থাকলে এবং পাউবো ও ঠিকাদারের হরিহর আত্মার নয়ছয় বন্ধ করলে দুর্যোগও ভয় পায়।
×