ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বৃষ্টি সত্ত্বেও ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর কেরানীগঞ্জ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৮ জুন ২০১৫

বৃষ্টি সত্ত্বেও ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর কেরানীগঞ্জ

রহিম শেখ, কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে ॥ আষাঢ়ের টানা বর্ষণেও থেমে নেই কারিগরদের কর্মব্যস্ততা। দিন-রাত কারখানায় সেলাই মেশিন চলছে। তৈরি হচ্ছে বাহারি রং ও ডিজাইনের প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, থ্রি-পিসসহ বাহারি সব পোশাক। যেদিকে চোখ যায় কেবলই বাহারি পোশাকের দোকান। বৃষ্টি উপেক্ষা করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাইকাররা আসছেন। ঘুরে ঘুরে কিনছেন পছন্দসই পোশাক। বর্ষার এই দিনে দোকানে বেচাকেনাও বেশ। শুধু মর্কেট কিংবা দোকান নয়, ফুটপাথও বাদ যায়নি বেচাকেনার এই আয়োজনে। বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষা কেরানীগঞ্জের পোশাক পল্লীর এমন দৃশ্য এখন চোখে পড়ার মতো। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে পাইকরাদের ভিড়। এই বেচাকেনার হাট সরগরম থাকবে ঈদের চাঁদ রাত পর্যন্ত। তবে পাইকারদের আনাগোনা কমে যাবে ২৫ রমজানের পর। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার মার্কেটগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৫০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। তবে ঈদে স্বাভাবিক সময়ের বেচাকেনার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। জানা গেছে, দেশের সর্ববৃহৎ পোশাক তৈরির পাইকারি বাজার হিসেবে খ্যাত কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ, আগানগর ও শুভাঢ্যা এখন সারাদেশের ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর। পোশাক তৈরির পাইকারি বাজার হওয়ার কারণে এ এলাকার বাজার জমতে শুরু করে শব-ই-বরাতের পর থেকেই। কেরানীগঞ্জের ব্যবসায়ীদের প্রায় ৫০ শতাংশ বেচাবিক্রি রমজান শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়। আগামী ২৫ রমজান পর্যন্ত পাইকারি বিক্রি ও চাঁদ রাত পর্যন্ত খুচরা বিক্রি করেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। বর্তমানে এখানে ছোট-বড় মিলিয়ে হাজার দশেক কারখানা এবং দুই হাজারের মতো শোরুম রয়েছে। এসব কারখানা ও শোরুমে অন্তত দুই লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার নারী শ্রমিক রয়েছেন। অবশ্য এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি, তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ লোকের কর্মসংস্থান করতে পেরেছেন। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মফস্বল শহরগুলোর বিপণিবিতান তো বটেই, রাজধানীর অভিজাত শপিংমলগুলোতেও এখন বিদেশী কাপড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রেতাদের হাতে উঠছে এখানকার তৈরি পোশাক। পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, স্যুট-ব্লেজারসহ সব ধরনের শীতবস্ত্র, শিশুদের কাপড় থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গার্মেন্টস আইটেম পাওয়া গেলেও এই ক্ষুদ্র গার্মেন্টপল্লী বিশেষভাবে বিখ্যাত জিন্স ও গেভাডিন প্যান্ট ও ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবির জন্য। কেরানীগঞ্জের জিলা পরিষদ মার্কেট, তানাকা মার্কেট, এস আলম সুপার মার্কেট, নুর সুপার মার্কেট, চৌধুরী মার্কেট, আলম সুপার মার্কেট, ইসলাম প্লাজা, আনোয়ার সুপার মার্কেট, কদমতলী গোলচত্বর এলাকার লায়ন সুপার মার্কেট, জিঞ্জিরার ফ্যামিলি শপিং মলসহ বেশ কয়েকটি পাইকারি মার্কেটে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানকার মার্কেটগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ৫০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। তবে ঈদে স্বাভাবিক সময়ের বেচাকেনার সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে জেলা পরিষদ মার্কেটের জিতু গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মোঃ জানে আলম বলেন, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জ থেকে জিন্সের ঝুট ফেব্রিক্স সংগ্রহ করে এনে আমাদের কাছে বিক্রি করেন স্থানীয় সরবরাহকারীরা। আমরা মণপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ঝুট সংগ্রহ করে সেগুলোকে প্রথমে সাইজ, মান ও রং অনুযায়ী ভাগ করি। তারপর সেগুলো বিদেশী প্যান্টের আদলে কেটে দক্ষ দর্জিদের দিয়ে সেলাই করে আনি। সেলাই শেষে প্রয়োজনে সেগুলোকে আবার রং করানো হয়। তিনি বলেন, আজকাল কেউ কেউ আবার সরাসরি বিদেশ থেকেও এক্সসরিজ আমদানি করছেন। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ অবশ্য পৃথিবীর নামী-দামী ব্র্যান্ডেরও কপি করেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। তবে গুটিকয়েক লোকজন গোপনে এমনটা করে থাকতে পারেন বলে জানালেন মমতাজ ফ্যাশন প্লাসের মালিক নজরুল ইসলাম। এসএস গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী সগীর হোসেন জানান, তার দুটি কারখানা ও শোরুম মিলিয়ে কমপক্ষে ২০ জন শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। তার কারখানায় শুধু শার্ট তৈরি করা হয়। এগুলো বিক্রি হয় ১৭০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। নিউ বস্ত্র গার্ডেনের স্বত্বাধিকারী শাহাদত হোসেন জানান, এবার তিনি শুধু বাচ্চা ছেলেদের জন্য শার্ট তৈরি করেছেন। এগুলোর পাইকারি দাম ২৭০ থেকে ৪৮০ পর্যন্ত। সুমন গার্মেন্টসের বিক্রয়কর্মী মাহবুব হোসেন জানান, তারা মেয়েদের ‘কিরণমালা’ ও ‘ফ্লোরটাস’ নামে নতুন যে দুটি পোশাক এনেছেন তার দাম হাজারের ওপরে পড়ছে। এবারের ঈদে ছেলেদের প্যান্টের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলছে কলকাতা নাইট রাইডার্স, পিকে, ব্যাং-ব্যাং, হিমেশ, রোমিও, বিকিং, বেনসন, প্রোমা, ডিসকভারীÑ এসব নামের প্যান্ট, এছাড়া গেঞ্জির মধ্যে রয়েছে কেএনজি, গিফিনি, জিকিউ, সিকেসহ ফ্যাশনেবল গেঞ্জি ও বাহারি ডিজাইনের সব পাঞ্জাবি। কালিগঞ্জ, আগানগর ও শুভাঢ্যার বিভিন্ন কারখানায় ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার তৈরি পোশাকের বাজারে এখনই ভিড়তে শুরু করেছেন ঈদের পোশাক বিক্রির পাইকাররা। শনিবার দুপুরে দেশীয় তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় এ মার্কেটে কথা হয় বরিশালের বানারীপাড়া থেকে পোশাক কিনতে আসা দুই ব্যবসায়ী মোঃ জসীম উদ্দীন ও ইউসুফ আলীর সঙ্গে। এই দুই বন্ধুর জননী ক্লথ স্টোর নামে তৈরি পোশাকের একটি দোকান আছে বানারীপাড়ার বাইশারী বাজারে। মোঃ ইউসুফ আলী জানান, বছর সাতেক আগে তারা দোকানটি শুরু করেন। সেই থেকে জিন্স ও গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট, শার্ট ও বাচ্চাদের কাপড়চোপড় কেরানীগঞ্জ থেকেই সংগ্রহ করেন। এবার এসেছেন ঈদের আগের কেনাকাটার জন্য। তার মতে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পাইকারি মার্কেট হিসেবে কেরানীগঞ্জ অদ্বিতীয়। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি শেখ আবদুল আজিজ বলেন, এবারও রোজা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘন ঘন লোডশেডিং শুরু হয়েছে। দিনে পাঁচ-ছয়বার বিদ্যুত আসা-যাওয়া করে। তিনি বলেন, কাপড় ওয়াশ করার সময় বিদ্যুত চলে গেলে ওই কাপড়ের বাকি অংশ ওয়াশ করতে না পারায় রং নষ্ট হয়ে বিক্রির অযোগ্য হয়ে পড়ে।
×