ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাগ্যবিড়ম্বিত রাষ্ট্রহীন জাতিরা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৯ জুন ২০১৫

ভাগ্যবিড়ম্বিত রাষ্ট্রহীন জাতিরা

দুই জনগোষ্ঠী। রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতোই যেন তাদের অবস্থা। প্রতিবার পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। আবার সেই ভস্ম থেকেই নতুন জীবনধারণ করে। এই উভয় জনগোষ্ঠীর শিকড় রয়েছে আধুনিক গ্রুপের ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও তুরস্কের অশান্ত, অস্থির, টানমাটালপূর্ণ সংযোগস্থলে। যুগ যুগ ধরে এই দুই জনগোষ্ঠীর ইতিহাস একে অপরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। তারপর তা পরস্পর থেকে একেবারেই ভিন্ন পথ পরিগ্রহ করে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর আরব প্রাধান্যপুষ্ট যেসব দেশ গঠিত হয় তাদের হাতে এরা নানাভাবে নির্যাতিত-লাঞ্ছিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনীতির উত্থান-পতনের শিকার হয়েছে দুটো জনগোষ্ঠীই। তথাপি তাদের একটি- কুর্দীরা হয়ত তাদের নিজস্ব রাষ্ট্র অর্জন করতে চলেছে। অপর জনগোষ্ঠী হলো আসিরীয় বা সিরিয়াক। এরা প্রকৃতপক্ষে আরামাইকভাষী খ্রিস্টান, যাদের প্রাচীন রাজধানী হলো নিনেভে। এদের রাজনৈতিকভাবে একেবারে কোণঠাসা করে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে ইসলামী স্টেট এদের নিশ্চিহ্ন করতে হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছে। তারপরও এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব স্বাধীন আবাসভূমির স্বপ্ন দেখে। সিরিয়ার সিরিয়াক ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতা বাসাম ইসহাক বলেন, ‘আমরা এমন এক স্থানের স্বপ্ন দেখি, যেটাকে আমাদের একান্ত নিজস্ব বলে দাবি করতে পারব।’ ইতিহাসের গতিপথ বড়ই বিচিত্র। আগে থেকে কোন ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। কুর্দীরা বর্তমানে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা ভোগ করছে। এই অবস্থানকে পূর্ণ সার্বভৌমত্বে উন্নীত করতে পারলেই শেষ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব দেশ বা রাষ্ট্র হবে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময়জুড়ে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদীদের নিজস্ব আবাসভূমির স্বপ্ন এক সময় নিতান্তই আকাশকুসুম কল্পনা ছিল। তারপরও তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে। তেমনিভাবে অনেক বিপর্যয়, অনেক ট্র্যাজেডির পর কুর্দীরা হয়ত আজ নিজস্ব রাষ্ট্র অর্জনের কাছাকাছি হয়েছে। তথাপি অন্যদের দ্বারা পদদলিত অনেক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আছে, যাদের এমন সম্ভাবনা আপাতত কেন, দূর অতীতেও নেই। তাদের একটি হলো আসিরীয়রা। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করে। সংখ্যালঘু হলেও কোন জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন এক জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে বসবাস করলে তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে নিজস্ব রাষ্ট্র লাভের অধিকারবোধ জাগ্রত হয়। যেমনÑ ইরাকের উত্তরাঞ্চলের কুর্দীরা। কিন্তু আসিরীয়দের বেলায় ব্যাপারটা তা নয়। এদের বসবাস বিক্ষিপ্ত। এরা সর্বাধিক মাত্রায় এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে সিরিয়ার উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে। গৃহযুদ্ধে তারা আরও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে গেছে। একই অবস্থা ক্রিমিয়ার তাতারদের। শত শত বছর ধরে তারা ক্রিমিয়া উপদ্বীপে বসবাস করে আসছিল। পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অটোমান সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে তাদের খানেত নামে নিজস্ব রাষ্ট্রও ছিল। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ক্রিমিয়া রুশ সাম্রাজ্যভুক্ত হলে সেখান থেকে অনেক তাতার চলে যায় আধুনিক তুরস্কে। স্ট্যালিনের আমলে ক্রিমিয়ার গোটা তাতার জনগোষ্ঠীকে হিটলারের সঙ্গে সহযোগিতা করার অপরাধে মধ্য এশিয়ায় নির্বাসিত করা হয়। সেখানকার বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে উজবেকিস্তানে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করতে থাকে। এদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র লাভের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সংখ্যালঘুরা যে এলাকায় দীর্ঘদিন বা যুগ যুগ ধরে বসবাস করে সেই ভূখ-ের ওপর তাদের একটা ন্যায়সঙ্গত দাবি থাকে। রাষ্ট্র গঠনের জন্য এমন দাবির প্রয়োজন আছে। ভৌগোলিক অবস্থাও একটা ভূমিকা পালন করে সেই জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ব্যাপারে। যেমনÑ ইরাকী কুর্দীরা বলে যে, তাদের এলাকা পাহাড়-পর্বতময় বলেই হানাদারদের হাত থেকে নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতি রক্ষা করা সহজতর হয়েছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা বন্ধুর বা দুর্গম না হলে আশপাশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সহজেই তাদের গ্রাস করে নেয়। আর্মেনীয় ও চেচেনদের কথাই ধরা যাক। প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্য তাদের কচুকাটা করেছিল। পরে আর্মেনীয়রা একটি ক্ষণস্থায়ী রাষ্ট্র গঠন করতে সক্ষম হয়। আরও পরে বলশেভিকরা এই রাষ্ট্রকে গ্রাস করে নেয়। তবে যেহেতু এরা ছিল সোভিয়েতের একটি প্রজাতন্ত্র, তাই ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙ্গে ফেলে এরা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হতে সক্ষম হয়। যা আগে ছিল অর্থহীন অভ্যন্তরীণ সীমান্ত, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় আন্তর্জাতিক সীমান্ত। অন্যদিকে চেচেনদের ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়ে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। দু’দুবার রক্তক্ষয়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াই সত্ত্বেও তারা রাশিয়ার অধীনেই রয়ে গেছে। রক্তপাত এবং দুঃখ-কষ্ট, দুর্ভোগ জাতীয় আশা-আশাক্সক্ষার অপমৃত্যু ঘটাতে পারে। সিরকাসীয় জনগোষ্ঠীর কথাই ধরা যাক। রাষ্ট্রহীন এই জাতিটির উৎপত্তি উত্তর ককেশাসে। ১৮৬৪ সালে জারের সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার জন্য লাখ লাখ সহায়-সম্বলহীন সিরকাসীয় কৃষ্ণসাগর অতিক্রম করে পালিয়ে যায়। এ জন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হয়। বিপুল বৃদ্ধ, নারী ও শিশু পথে মারা পড়ে। এরা তুরস্ক ও অন্যান্য দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র লাভের কোন সম্ভাবনাই নেই। তথাপি ওদের কেউ কেউ রাশিয়ার মধ্যে স্বায়ত্তশাসন, এমনকি স্বাধীনতারও স্বপ্ন দেখে। তারপরও যেখানে দুঃখ, দুর্দশা, যন্ত্রণা, বঞ্চনা জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসনের আকাক্সক্ষা মুছে ফেলতে পারে না, সেখানে উল্টো এগুলোর কারণেই সেই আকাক্সক্ষা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। দুর্ভোগ ও বঞ্চনা থেকে মানুষের মনে সৃষ্টি হয় এগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার সুদৃঢ় সঙ্কল্প। এই সঙ্কল্প থেকেই জাতীয়তাবাদীরা স্বদেশবাসীকে সংগঠিত করে সংগ্রামে শামিল হয়। নির্বাসন ও উদ্বাস্তু জীবন অনেক সময় জনগোষ্ঠীর জীবনে স্বাধীনতা চেতনার জন্ম দেয় এবং একে তীব্রতর করে তোলে। সেই জনগোষ্ঠী তখন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি স্বপ্ন লালন করে। সেই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকে। তবে এসবে কিছুই আসে যায় না যতক্ষণ পর্যন্ত না ধারক রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য বা সরকার ধসে পড়ে। যেমনটি ঘটেছে ইরাকের বেলায়, তারও আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটিশ, অটোমান ও অস্ট্রোহাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে। কিংবা আরও ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই জনগোষ্ঠী বিচ্ছিন্নতার পথে পা বাড়াতে চায়। সোভিয়েত ভেঙ্গে অনেক স্বাধীন রাষ্ট্র হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী রাশিয়াও ভেঙ্গে পড়তে পারে। তখন চেচেনদের মতো জাতিগুলোর স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। চীন রাজনৈতিক ভূখ-গতভাবে না ভাংলেও গণতন্ত্রায়নের প্রবল চাপে এক সময় হয়ত তিব্বতী ও উইঘুরীয়দের নিজস্ব রাষ্ট্রসত্তার পথ উন্মুক্ত করে দেবে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রেরও আরেক দফা পুনর্বিন্যাস অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সিরিয়ার পতন ঘটলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আসিরীয়রা আবার একত্রিত হওয়ার সুযোগ পাবে। তাদের সামনেও উন্মোচিত হতে পারে নতুন পথ। সেটা অবশ্য অনেক দূরের সম্ভাবনা। তথাপি আশা তো সর্বদাই করা যেতে পারে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×