সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বোঝাতে সাদা আর কালো, কখনওবা দিন আর রাতের উদাহরণ টানা হয়। কোন কোন বাবা-মা শিশুকে শেখায় : ‘মিথ্যা কথা বলবে না, মিথ্যা কথা বললে জিহ্বা টিকটিকির লেজের মতো খসে পড়ে।’ সরল শিশু বিশ্বাস করে তা। একদিন কৌতূহলের বশে ভয়ে ভয়ে মিথ্যা বলে দেখে, জিহ্বা খসে পড়েনি। সেই শুরু। কালোর ওপর একগাদা সাদা পাউডার মেরে সাদা করা আর হাজার বাতি জ্বেলে রাতকে দিন বানানোর দুর্দান্ত চেষ্টা আজ মানুষের।
আবদুল কাদের জিলানী (রা.) এর সত্যবাদিতার কাহিনী থেকে শুরু করে মিথ্যাবাদী রাখালের গল্প জানা আছে আমাদের। ইদানীং আবার রমজান মাসে মিথ্যা বলা না বলার প্রসঙ্গ শুরু হয়েছে।
চলন্ত পাবলিক বাসে এক যাত্রীর মোবাইল ফোনে আলাপ : রোজা রেখে মিথ্যা বলব না, আমি এখন গুলিস্তানে, অন্য সময় হলে বলতাম চিটাগাং।
টেলিভিশনের কল্যাণে জানা গেল : এক নেতা আর এক নেতাকে উদ্দেশ করে বলছেন : রোজা রেখে উনি অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন। অবশ্য উনি রোজা রাখেন কিনা...
এতে কারও কারও কাছে মনে হতে পারে, রমজান মাসে মিথ্যা বলা যাবে না, অন্য সময় যাবে। এ ধরনের ব্যাখ্যাকারদের সংখ্যা ইদানীং আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তারা ভাবছে, পাড়া মহল্লায়, অফিস আদালতে, ব্যবসাবাণিজ্যে সংঘাত এড়াতে দু’চারটে মিথ্যা কথা বলা যেতে পারে।
মহল্লার বড়ভাই সকলের সামনে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে স্কুল শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করালেন। ছোট বড় সবাই দেখল। কিন্তু সাক্ষ্য দেয়ার সময় একে একে সবাই কেটে পড়ল।
: স্যার, টাটকা মাছ, ৬৫০ টাকা করে কেনা, আপনি ৭০০ টাকা দেন। এটুকু না দিলে খাব কি?
: নারে ভাই, এই মাছ ৬০০ টাকা হলেই বেশি হয়। ৬০০ টাকা হলে দেন।
ক্রেতা চলে যেতে উদ্যত হতেই বিক্রেতার পেছন থেকে হাঁক।
: আসেন স্যার, আপনি বান্ধা কাস্টমার। আপনাকে কি ফিরাতে পারি?
: তাই বলে ৫০ টাকা লসে কেন দেবেন?
কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ক্রেতাও জানে আসলে কত দিয়ে মাছ কিনে এনেছে। লোকসান দিয়ে কেউ মাছ বেচে না, বিশেষ করে সকালবেলা।
এই যে মিথ্যাচার, এতে কেউ কিছু মনে করছে না। ভাবছে ব্যবসায়িক কৌশল।
সত্যকে নিজের সুবিধাজনক অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা করার এ প্রবণতা চলছে সুপ্রাচীনকাল থেকেই।
: আপনার ফাইলটা যে স্যারের রুমে ঢুকেছে, আর বের হচ্ছে না। স্যার ব্যস্ত মানুষÑ মিনিস্ট্রি, সেমিনার কত কি। স্যারের রুমে কেউ ঢুকতেই পারে না। আপনি এমন করে ধরেছেন, দেখি কি করা যায়।
ফাইল কিন্তু সই হয়ে গেছে। আছে যে বলছে তার টেবিলের গোপন ড্রয়ারে। শুধু কাক্সিক্ষত খামটি পাওয়ার জন্যই এত কথা।
এসব মিথ্যাচার থেকে বাঁচার জন্য চালু হয়েছে প্যাকেজ ডিল। কাজের ধরন অনুযায়ী নির্ধারিত রেটের সঙ্গে কিছু যোগ করে প্যাকেজ। বাড়তি কথা বলার দরকার নেই, বাড়তি টেনশন নেই। কাজ উদ্ধার। জন্মনিবন্ধন থেকে ভূমিনিবন্ধন, বিবাহনিবন্ধন থেকে মৃত্যুনিবন্ধন সর্বত্র প্যাকেজ ডিল।
এখন প্যাকেজ ডিলের দাতার ভূমিকায় বাড়তি যে পয়সা আপনি খরচ করলেন, তা যদি গ্রহীতার ভূমিকায় অন্য কোথাও থেকে আদায় করতে পারেন, তাহলে আপনি কথা বলবেন না জানি। সমস্যা হচ্ছে, যারা যোগাড় করতে পারছে না তাদের।
এক সময় বলা হতো মিথ্যা তিন প্রকার। মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর পরিসংখ্যান।
পরিসংখ্যান বিষয়টা পাকিস্তান আমলে এত ব্যাপকতা পায়নি। সে সময়ের কথা।
মহকুমা প্রশাসক অর্থাৎ এসডিও সাহেব বিকেলে তারবার্তা পেলেন : দুই দিনের মধ্যে মহকুমার ছাগলের সংখ্যা জানাতে হবে সদরে। এসডিও সাহেবের চিন্তা দূর করতে এলেন পেশকার সাহেব।
: কোন চিন্তা নাই স্যার। এই যে সামনের মাঠে দুইটা ছাগল চড়ছে। আমাদের কাজ হবে মহকুমার মোট আয়তনকে মাঠের আয়তন দিয়ে ভাগ করে তারপরে তাকে দুই দিয়ে গুণ করা।
এসডিও সাহেব রসিক ব্যক্তি। তিনি বলেছিলেন : সঙ্গে দুইটা যোগ কর।
জমির ক্ষেত্রফলকে কেন আয়তন বলা হয়, তা পেশকারের কাছে এসডিও সাহেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন কিনা, এ গল্প যার কাছে শুনেছি তিনি বলতে পারেননি।
যা হোক, এরপর চতুর্থ মিথ্যা হিসেবে যার নাম এলো, তা হচ্ছে প্রেস নোটস।
এরপরের তালিকা বানানোর দায়িত্ব পাঠকের।
সেই সত্য যা রচিবে তুমি... বলে রবীন্দ্রনাথ যে জগৎ সৃষ্টি করলেন, তার ব্যাখ্যায় আর যাব না। দেবদাস কোনকালে মদ খেয়েছিল কিনা আর আদৌ দেবদাস বলে কেউ ছিল কিনা, তাইবা কে জানে? মদ্যপ ব্যক্তিকে ঘৃণা করার সরল অঙ্ক তাই জটিল হয়ে যায়। আমরা দেবদাসকে ভালবেসে ফেলি। হাজার হাজার মিথ্যা চরিত্র আমাদের আপন হয়ে যায়Ñ পর হয়ে যায় সত্য।
সত্য হলো এডিডাস কোম্পানির তৈরি ফুটবলের মতো গোলাকার আর বায়ুপূর্ণ; হাজার লাথিতেও সে তার আকার পরিবর্তন করে না। সমাজভেদে মূল্যবোধের কিছু পরিবর্তন হয়; কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলো সব সমাজেই বিদ্যমান। সারা পৃথিবীর শিশুর কান্না যেমন এক, তেমনি এক সত্যের অবয়ব। গোলাপকে যে নামেই ডাকুন না কেন, তার সুগন্ধ একটুও কমে না।
সত্য করলার মতো তিতা; অনেকেই তাই খেতে চায় না। কিন্তু, একবার খাওয়ার অভ্যাস করলে বোঝা যায়, এতে ক্ষুধামন্দা দূর হয়, রক্ত পরিষ্কার হয়।
রবীন্দ্রনাথেই শেষ করি :
সত্য যে কঠিন
কঠিনেরে ভালবাসিলাম
সে কখনও করে না বঞ্চনা।