ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তফা সোহেলের ৫ দিনের রিমান্ডের শুনানি আজ

ট্রানজিট রুট চট্টগ্রাম বন্দর, কোকেন নিয়ে তোলপাড়

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৩০ জুন ২০১৫

ট্রানজিট রুট চট্টগ্রাম বন্দর, কোকেন নিয়ে তোলপাড়

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দরে মাদক তরল কোকেন আটকের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ সংক্রান্তে গঠিত শুল্ক গোয়েন্দা ও অধিদফতরের গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। অপরদিকে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়া থেকে সূর্যমুখী ব্রান্ডের ভোজ্যতেলের সঙ্গে কোকেন আমদানিকারক হিসেবে অভিযুক্ত চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের খান জাহান আলী গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কক্সবাজারের প্রাইম হ্যাচারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক গ্রেফতারকৃত গোলাম মোস্তফা সোহেলকে ৫ দিনের যে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে এর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে আজ চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতে। এ মামলায় অপর আসামি খান জাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। তিনি বর্তমানে ঢাকায় আছেন বলে তার পারিবারিক সূত্রে জানানো হয়েছে। নুর মোহাম্মদ শুরু থেকেই বলে আসছেন তিনি এ ভোজ্যতেলের আমদানিকারক নন। তার প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র ব্যবহার করে প্রাইম হ্যাচারির ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেল এর সঙ্গে জড়িত। ইতোমধ্যে সোহেল গোয়েন্দা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন, লন্ডন প্রবাসী তার খালাতো বোনের স্বামী ফজলুর মাধ্যমে এ চালানটি এসেছে। কিন্তু ভোজ্যতেলের সঙ্গে একটি ড্রামে যে তরল কোকেন রয়েছে তা তিনি জানেন না। উল্লেখ্য, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ঢাকায় দুজনের বিরুদ্ধে পুলিশী অভিযান চলছে বলে জানা গেছে। উল্লেখ্য, গত ৭ জুন ইন্টারপোলের তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ সদর দফতরে অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক জাবেদ পাটোয়ারী এ ব্যাপারে সিএমপিকে হস্তক্ষেপ করার নির্দেশ দেয়ার পর ৮ জুন চট্টগ্রাম বন্দরে একটি কন্টেনারে আসা ১০৭ ড্রাম বোঝাই সানফ্লাওয়ার তেলের চালানটি আটক করা হয়। আটকের পর স্থানীয় পর্যায়ে নমুনা পরীক্ষা করার পর এতে কোন তরল কোকেনের অস্তিত্ব না মিললেও পরবর্তীতে ঢাকায় বিএসআইআর এবং বাংলাদেশ ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিতে পুনঃপরীক্ষায় ৯৬ নাম্বার ড্রামে তরল কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই ড্রামের মধ্যে ১৮৫ কেজি সানফ্লাওয়ার ভোজ্যতেলের সঙ্গে এই তরল কোকেন মিশ্রিত অবস্থায় রয়েছে। উল্লেখ্য, গত ৮ মে এমভি থর স্ট্রিম নামের একটি জাহাজযোগে আসা সানফ্লাওয়ার ব্র্যান্ডের ভোজ্যতেলের চালানটি বন্দরে খালাস হয়। এরপর থেকে কোকেন সন্দেহে পুরো চালানটি জব্দ করে সিলগালা করা হয় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের নির্দেশে। এদিকে, এ ঘটনা নিয়ে আগ বাড়িয়ে পুলিশের পক্ষে মামলা দায়েরের ঘটনা নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের কর্মকর্তারা বিস্মিত হয়েছে। তারা বলেছেন, এ ব্যাপারে মূল মামলা হবে এই অধিদফতরের পক্ষ থেকে। কিন্তু পুলিশ কেন আগেভাগে মামলা করে ফেলল তা তাদের জানা নেই। অপরদিকে, বন্দর পুলিশ জানিয়েছে, আদালতের নির্দেশে তারা মামলা দায়ের করেছে। ইতোমধ্যেই গোয়েন্দা পুলিশ সন্দেহজনকভাবে প্রাইম হ্যাচারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা সোহেলকে তাদের কাছে হস্তান্তরের পর ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। গত শনিবার এ সংক্রান্তে মামলায় তাকে শোন এরেস্ট দেখানো হয়েছে। তার সঙ্গে আসামি করা হয়েছে খান জাহান আলী গ্রুপের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদকেও। আজ মঙ্গলবার আদালতে গ্রেফতারকৃত সোহেলকে রিমান্ডে আনার ব্যাপারে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া তদন্ত সংক্রান্তে দিক নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দিন সেলিম জনকণ্ঠকে জানান, তাদের পক্ষ থেকে আদালতে যে আবেদন করা হয়েছে তাতে এই ১০৭ ড্রাম ভর্তি ভোজ্যতেল নতুন করে সিলগালা ও এর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পুনঃপরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। আদালত নির্দেশ দিলে তাদের এই পুনঃপরীক্ষার কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া জব্দকৃত ভোজ্যতেল বোঝাই ড্রামগুলো বন্দরের বন্ড হেফাজতে রাখা হবে। পুনঃপরীক্ষায় কোকেনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলে পরবর্তী কাজ চলবে আরও দ্রুত গতিতে। এ মুহূর্তে এই তদন্তে পুলিশের কোন অগ্রগতি নেই। তবে ইতোপূর্বে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের পক্ষ থেকে গ্রেফতারকৃত গোলাম মোস্তফা সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সোহেল নানা কথা বললেও মামলার পর নিয়োজিত আইও নতুন করে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর যে তথ্য বেরিয়ে আসবে সে অনুযায়ী তদন্ত কাজ এগিয়ে যাবে। এদিকে, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, এ চালানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র জড়িত। চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সময়ে চোরাচালানের পণ্য আটক করা হলেও তরল কোকেন আটক হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। আকাশচুম্বী মূল্যের কোকেনের ব্যবহার এই অঞ্চলে তেমন নেই বললেই চলে। কোকেনের অধিক ব্যবহার রয়েছে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে। কিন্তু এসব দেশে কোকেন প্রবেশে এতই কড়াকড়ি রয়েছে যে কারণে বাংলাদেশকে কোকেন পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তরল কোকেন ধরা পড়ার পর এখন নানা প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট সকল সংস্থার কাছে উঠে এসেছে। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা জানান, কোকেন একটি হাইকোয়ালিটির মাদক। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় কোকেনসহ বিভিন্ন মাদক উৎপাদন হয়। যা গোল্ডেন ক্রিসেন্ট নামে পরিচিত। পাশাপাশি লাউস মিয়ানমার থাইল্যান্ড নিয়ে যে গোল্ডেন ট্রায়েঙ্গেল রয়েছে তাতেও এ ধরনের মাদকের উৎপাদন হয়ে থাকে। এ জাতীয় মাদক উৎপাদনে তাদের যাবতীয় প্রক্রিয়া এতই উন্নতমানের যে, যা নিয়ে এ জাতীয় মাদক সেবনকারী ও পাচারে জড়িত মাফিয়া চক্র এর মূল ক্রেতা। কিন্তু ধনী যেসব দেশে এসব মাদকের চাহিদা ব্যাপকভাবে রয়েছে সেখানে এ পণ্য প্রবেশে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে থাকায় মাদক পাচারকারীরা সোজা পথে না গিয়ে ট্রানজিট হিসেবে বিভিন্ন দেশকে ব্যবহার করছে। যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। বাংলাদেশে ইতোপূর্বে পাউডার কোকেন ধরা পড়লেও তরল কোকেন ধরা পড়ার ঘটনা এই প্রথম এবং এ ঘটনা প্রমাণ করেছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাদকসহ চোরাচালানের পণ্য আসছে এবং পুনরায় তা রি-এক্সপোর্ট হয়ে চলে যাচ্ছে। এ জাতীয় পণ্যের আগমন ঠেকাতে দেশে যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বলতে গেলে অকার্যকর। যে কারণে ভোজ্যতেল থেকে নমুনা সংগ্রহ করার পর চট্টগ্রামে কাস্টমস হাউজ ও নৌবাহিনীর ল্যাবরেটরিতে কোকেন নেই বলে বলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ঢাকার দুটি ল্যাবরেটরিতে পাওয়া গেল কোকেনের আলামত। বর্তমানে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগ, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা যার যার আঙ্গিকে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনও কোন সংস্থার পক্ষ থেকেও বলা যাচ্ছে না কি পরিমাণ কোকেন ভোজ্যতেলের ওই ড্রামে রয়েছে। কারণ এই তরল কোকেন ভোজ্যতেল থেকে বিভাজন করে পরিমাপ করার কোন ব্যবস্থা এখনও এদেশে গড়ে উঠেনি। যে কারণে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জাতিসংঘের সহায়তা পেতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। জানা গেছে, অতি শীঘ্রই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে দুটি তদন্ত দল এ সংক্রান্তে বাংলাদেশে আসছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে ১২০ কেজি পর্যন্ত কোকেনের অস্তিত্ব রয়েছে। যদি তা শেষ পর্যন্ত সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয় তা হবে চাঞ্চল্যকর একটি ঘটনা। কারণ কি পরিমাণ কোকেনের মূল্য শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এদিকে, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বন্দরের বন্ড এলাকায় নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের হাত এতই লম্বা যে এরা এই কোকেন যে কোন মূল্যে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চালাতে পারে। অপরদিকে, শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতর যে ড্রামটিতে কোকেনের আলামত পেয়েছে তাছাড়াও অপরাপর ড্রামে থাকা ভোজ্যতেল পুনঃপরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, একাধিক সংস্থার ল্যাবরেটরিতে একাধিক পরীক্ষার ফলাফল প্রমাণ করবে কোকেনের অস্তিত্ব এবং এর পরিমাণ কি হতে পারে তার জন্য বিদেশী বিশেষজ্ঞ দল আনা হচ্ছে। কোকেন ধরা পড়ার এই ঘটনা দেশ জুড়ে এতই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে যে, ইতোপূর্বে যা আর দেখা যায়নি। অথচ কারা এই চালানটি এনেছে। বন্দরে এই চালান কিভাবে নেমেছে। আমদানির এলসি কারা করেছে এ নিয়ে রয়েছে ধূম্রজাল। কেননা, যে প্রতিষ্ঠানের নামে সানফ্লাওয়ার ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে সে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে তাদের কাগজপত্র জালিয়াতি করে চালানটি আনা হয়েছে। অথচ আমদানি করার প্রক্রিয়া প্রধান যে বিষয়টি রয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি করা সেটিই এক্ষেত্রে অনুপ্রস্তুত। অথচ চালানটি এসেছে এবং এতে মাদক তরল কোকেন রয়েছে এটাই এ পর্যন্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
×