ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

যানজটে জান যায়

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২ জুলাই ২০১৫

যানজটে জান যায়

শান্তিনগরের পীরসাহেবের গলি থেকে অটোরিক্সায় মেয়েকে নিয়ে আগারগাঁয় যাচ্ছেন মোহন মাস্টার। গত রাতে ঢাকায় এসেছেন মেয়ের চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য। শান্তিনগরের মোড়ে আটকে আছেন অনেকক্ষণ। মালিবাগ-মৌচাক হয়ে মগবাজার মোড় আসতে ঘণ্টা পার। ১০টায় ইন্টারভিউ। তাই সকাল ৮টায় মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছেন। টানাপড়েনের সংসার। চাকরিটা হলে কিছুটা রক্ষা! কিন্তু যানজটের হাল দেখে হতাশ, সঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারবেন তো? বাংলামোটর-কারওয়ানবাজার হয়ে ফার্মগেট এসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন ৯টা ৩০ মি.। আঁৎকে ওঠেন মোহন মাস্টার। অনেকেই বাস থেকে নেমে হেঁটে চলেছেন। পেছনে একটি এ্যাম্বুলেন্স আর্তচিৎকার করে যেন বলছে ‘রোগীকে বাঁচাও।’ সে আর্তনাদ সবার কানে গেলেও কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশের ভোতা কানে পৌঁছাচ্ছে না। মোহন মাস্টার তাকিয়ে দেখেন নাকে অক্সিজেন লাগানো রোগী নিস্তেজ হয়ে আছে। পাশে বসা আত্মীয়স্বজনের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। ছোটবড় অসংখ্য গাড়ি পিঁপড়ার সারির মতো দাঁড়িয়ে যাত্রাপালার দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য যেন ঝুমুর তালে বিরামহীন ভেঁপু বাজিয়ে যাচ্ছে। পকেট থেকে রুমাল বের করেন শব্দ দূষণের হাত থেকে বুড়োকানকে রক্ষা করার জন্য। দুঃসহ গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। স্থবির হয়ে আছে রাজপথ। মানুষ আবিষ্কৃত যন্ত্রের কাছে মানুষই কত অসহায়! ফার্মগেট পার হয়ে ট্রাফিক সিগনালে লাল আলো দেখে মোহন মাস্টার হাফ ছেড়ে বাঁচেন এই ভেবে যে, সবুজ আলো জ্বললেই যাওয়া যাবে। কিন্তু একি! লাল-হলুদ-সবুজ আলো অনেকবার পরিবর্তন হলেও গাড়ির চাকা সচল হচ্ছে না। পাশে থাকা একটি বেরসিক বাস অনবরত কালো ধোঁয়া ছেড়ে মনের দুঃখ প্রকাশ করছে। বিষাক্ত সেই ধোঁয়া মোহন মাস্টারের অটোরিক্সার ভেতর আশ্রয় খুঁজছে যেন। কানে চেপে ধরা রুমাল এবার নাকে চেপে ধরেন তিনি। মেয়েকে ইশারায় বলেন, নাকে আঁচল দিতে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকলে তাঁর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাবে। নামার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাইরে তখন আষাঢ়ের ঢল। দেখতে দেখতে রাস্তায় জল জমে যেন চলনবিল। তাঁর মনে হলো বর্ষায় নৌকার পাল তুলে আমন ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে গ্রাম থেকে গঞ্জে যাচ্ছেন। রাস্তার অন্যপাশে একটি রিক্সা উল্টে স্কুলযাত্রী মা-মেয়ে কাকভেজা। ভারি দেহ নিয়ে ভদ্রমহিলা উঠতে পারছিলেন না। মেয়ে মাকে ওঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। রাস্তা খালি দেখে ড্রাইভারের কাছে জানতে চাইলেন গাড়ি ছাড়ছে না কেন? ড্রাইভার রসাল ভাষায় উত্তর দিল- ‘এই রাস্তা দিয়া রাজা আসে, রাজা যায়।’ মোহন মাস্টারের হাসি পেলেও বুঝতে পারলেন কোন মন্ত্রির গাড়ির বহর যাবে। আধুনিক নগরীতে যেখানে আয়তনের ২০ থেকে ২৫% রাস্তা থাকা দরকার; সেখানে ঢাকার রাস্তার পরিমাণ ৭ থেকে ৮%। তার ওপর বিআরটিএ লাগাম ছাড়া প্রাইভেটকারের পারমিশন দিয়েই চলেছে। ২ লাখ গাড়ি চলার আয়তনের রাস্তায় প্রতিদিন চলে প্রায় ১৫ লাখ গাড়ি। যেন অভিভাবকহীন এই নগরী। যান্ত্রিক এই শহরে নাগরিক সুবিধার চেয়ে বিড়ম্বনাই বেশি। যথাস্থানে পৌঁছে জানতে পারেন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে ইন্টারভিউ। ভেতরে জমে থাকা দুশ্চিন্তা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে গেল মোহন মাস্টারের। মনে মনে বললেন-যানজটের দুঃসহ যন্ত্রণার হাত থেকে নগরবাসীকে শান্তির বারতা দিতে পারবেন কী নতুন মেয়রদ্বয়? দীপ্ত টিভি, ঢাকা থেকে
×