ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আত্মহত্যা ও সড়ক দুর্ঘটনাই মূল কারণ;###;আত্মহননের প্রবণতা টিনএজারদের মধ্যেই বেশি

সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে ॥ নিত্যদিন অপমৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২ জুলাই ২০১৫

সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে ॥ নিত্যদিন অপমৃত্যু

শর্মী চক্রবর্তী ॥ নুসরাত সামিয়া (৫) কথা বলছে না। তার স্কুলপড়ুয়া দুই ভাই কাঁদছে অঝোরে। কিন্তু নুসরাত স্তব্ধ। অন্যদিনের মতোই স্কুল থেকে মায়ের সঙ্গে রিকশায় ফিরছিল সে। মা আর ফেরেননি তার সঙ্গে। ফিরেছেন লাশবাহী গাড়িতে। নুসরাতকে স্তব্ধ করেছে এক ভয়াবহ স্মৃতি। রিকশা থেকে বাসের ধাক্কায় ছিটকে পড়ল মা আর সে। মা পড়ে গেলেন বাসের চাকার নিচে। অনেক রক্ত। চিৎকার। ভিড়। তারপর ফুটপাথে শুইয়ে রাখা হলো মাকে। রক্তভেজা। নীরব। ২০১৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কমলাপুরে ঘাতক বাস কেড়ে নিলো নুসরাত সামিয়া নামের শিশুর চোখের সামনে তার মা রোকসানা বেগম লায়লাকে (৩৭)। শুধু লায়লাই নয়, প্রতিদিন এমন অনেক অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এ যেন অপমৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল। এক একটি জীবনের সঙ্গে একেকটি স্বপ্ন লুকিয়ে থাকে। একটি মৃত্যু সব কিছু শেষ করে দেয়। অনেকে জীবনের মূল্য না বুঝে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়। আবার অনেকে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও জীবন তার কাছ থেকে ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। বর্তমানে নিজ ঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা কোথাও মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিনই মানুষ কোন না কোন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেকে আবার বিভিন্ন কারণে জীবনের প্রতি অনীহা এসে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এসব মৃত্যুই অপমৃত্যু হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে সারাদেশে এমন অপমৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছে। অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এমন একটি দিনও নেই। প্রতিদিনই অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে সব বয়সী মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের। ট্রেনে কাটা পড়েও মানুষের অপমৃত্যু ঘটছে। এছাড়া বিষপানে, গলায় ফাঁস লাগিয়ে, চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে, ঘুমের বড়ি খেয়ে, শরীরে আগুন দিয়ে এবং নদীতে ঝাঁপ দিয়ে অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আবার কোন কোন ঘটনায় খুন করে আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয়েছে বলে ঘাতক চক্র চালিয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের খুনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রহস্য উদ্ঘাটন হয় না। দেশে অপমৃত্যুর ঘটনা এভাবে বেড়ে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রে। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৬ বছরে ৯৫ হাজার ৩২৫টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১৫ হাজার ৩৭১টি, ২০১০ সালে ১৫ হাজার ৫৫১টি, ২০১১ সালে ১৫ হাজার ৩২৯টি, ২০১২ সালে ১৬ হাজার ১২০টি, ২০১৩ সালে ১৬ হাজার ২৩৮টি এবং ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৭১৬টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত ৬ বছরে ৯৫ হাজার ৩২৫টি অপমৃত্যু ঘটনার মধ্যে ৫৯ হাজার ৭৬০টি আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর ঘটনা। এর মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে ৩৩ হাজার ৪২৩টি এবং বিষপানে ২৬ হাজার ৩৭৭টি। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে সারাদেশে ফাঁস দিয়ে ১ হাজার ৭২১টি, বিষপানে ৮২৭টি এবং গায়ে আগুন লাগিয়ে ৫৮টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রাজধানীতে ফাঁস দিয়ে ১৯২টি, বিষপানে ৬৮টি এবং গায়ে আগুন লাগিয়ে ১৯টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গায়ে আগুন লাগিয়ে সারাদেশে যে ৫৮টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে তার সবই শিকার নারী বলে পুলিশ জানিয়েছে। নারীরা যৌতুক, স্বামীর পরকীয়াসহ দাম্পত্য কলহের জের ধরে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। সব মিলিয়ে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৩ মাসে অপমৃত্যুর ৪ হাজার ৫৫২টি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে পুলিশ কর্তৃক স্থানীয়ভাবে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ২ হাজার ২৩৭টি। ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে ২ হাজার ২২৫টি। ফরেনসিক পরীক্ষা হয়েছে ৪১৮টির ক্ষেত্রে। অপমৃত্যুর বিষয়ে মোট তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৫৩৩টি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ২ হাজার ৩৩৫টি ও ২০১৩ সালে ১৪৫টি এবং তারও আগের রয়েছে ৫৬টি মামলা। এসবের মধ্যে ২৪৪টি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট গৃহীত হয়নি। এছাড়া ১২১টি ভিসেরা পরীক্ষা হয়েছে। এদিকে তদন্তাধীন মামলার মধ্যে ১ হাজার ৩৩৫টি মুলতবি রয়েছে। এসব মামলা মুলতবি থাকার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ভিসেরা রিপোর্ট না পাওয়া, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন গৃহীত না হওয়া ও হিস্টোপ্যাথিক। আম্মু-আব্বু আমাকে মাফ করে দিও। আমি অন্যায় করেছি, আমার সাজা হওয়া উচিত। আমি আর কোন কিছু সহ্য করতে পারছি না। খুব অসহায় লাগছে। তুমিই তো বলোÑ আমার মতো মেয়ের দরকার নেই। আমি এভাবে তোমাদের কষ্ট দিতে চাই না। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি এ জীবন সহ্য করতে পারছি না। আমি একজনকে ভালবাসি। আমি খারাপ, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না। তাই আমি চলে গেলাম। পুলিশ ও নাঈমার বন্ধুরা জানান, তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল বাবু নামে এক সহপাঠীর। বিষয়টি নাঈমার মা-বাবা জেনে ক্ষুব্ধ হন তার প্রতি। ঈদের ছুটি কাটিয়ে গত ৮ আগস্ট কেশবপুরের বাড়ি থেকে ঢাকায় ফেরার আগে নাঈমার মোবাইলফোনটি কেড়ে নেন তারা। অন্যদিকে নাঈমার প্রেমিক বাবু তার সঙ্গে প্রতারণা করে। তারই সহপাঠীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। মানসিক এ চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় নাঈমা। প্রায় প্রতিদিনই এমন ঘটনা ঘটছে। সারাদেশে যেসব অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তার একটি বড় অংশই আত্মহত্যাজনিত কারণে হয়ে থাকে। জীবনের প্রতি অনীহা থেকে প্রতিদিন কেউ না কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিষণœতা, অস্থিরতা, মাদকাসক্তি, পারিবারিক অশান্তি, যৌতুকসহ মানসিক রোগের কারণেই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এ ধরনের প্রবণতা কারও মধ্যে দেখা দিলে দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব মনোরোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আমাদের দেশে টিনেজারদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তাদের এই সমস্যা থেকে বের করে আনতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিনই অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। একটি মৃত্যুর সঙ্গে একটি স্বপ্নেরও অপমৃত্যু ঘটে। নারী, শিশুসহ সব বয়সী ও শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। বুয়েটের এ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণা অনুযায়ী দেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় ৩৫ হাজার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও আহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণের হারও কম নয়। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোট ৬ হাজার ৫৮২ জন নিহত হয়েছে। এর আগের বছর নিহতের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ১৬২। এক বছরের ব্যবধানে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৪২ জন বা ২৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মহাসড়কে রিকশা, ভ্যান, নসিমন ও সিএনজি অটোরিকশার মতো ছোট যান চলাচলের কারণে। অপ্রাপ্তবয়স্ক চালক ও দুজনের অধিক চলাচলের কারণে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। কাঞ্চন বলেন, এক্ষেত্রে শুধু আমাদের পরিবহন ব্যবস্থাই দায়ী নয়, আমরা নিজেরাও দায়ী। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হলেও তার কার্যকারিতা অনেক কম। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত আইন থাকলেও তা অনেক দুর্বল। আবার যা আছে তারও যথাযথ প্রয়োগ নেই। দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, যুগোপযোগী আইনের অভাব, অপরিকল্পিত সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, সড়ক-মহাসড়কের পাশে হাট-বাজার, পর্যাপ্ত ট্রাফিক ব্যবস্থার অভাব, অদক্ষ চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো, বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ব্যবহার, সড়ক-মহাসড়কে অতিরিক্ত বাঁক, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো ও চলন্ত অবস্থায় মোবাইলফোনে কথা বলা বিভিন্ন কারণে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে, এ কারণে বাড়ছে অপমৃত্যু।
×