ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিএনপির রাজনৈতিক নিদ্রাযাপন

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ৩ জুলাই ২০১৫

বিএনপির রাজনৈতিক নিদ্রাযাপন

কবি আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের পরিচিত মুখ। সদাস্মিত হাসির এই মানুষটি একাধারে কবি, উপস্থাপক ও অনবদ্য আবৃত্তিশিল্পী। সব ক্ষেত্রেই আলাদা করে চেনা যায় তাঁকে। স্বতন্ত্র বাচনভঙ্গি যেমন তাঁর উপস্থাপনা ও আবৃত্তিতে ভিন্নমাত্রা এনে দেয়, তেমনি আলাদা তাঁর কাব্যভাষাও। গেল শতকের সত্তরের দশকে আসাদ চৌধুরীর একটি কবিতা পাঠক হৃদয়ে দারুণ আলোড়ন তুলেছিল। কবিতাটির নাম সত্য ফেরারী। কবিতার শুরুতেই কবি প্রশ্ন করছেন, ‘কোথায় পালালো সত্য?’ এরপর কবি খুঁজছেন। কোথাও ‘সত্য’ পাচ্ছেন না। ‘দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো/ রেস্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে/গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে/টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে/নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।’ কিন্তু তাতে কবির অনুসন্ধান শেষ হচ্ছে না। তিনি আরও খুঁজে চলেছেন এভাবেÑ ‘কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই/রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই/পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই/ নাটকের কোন সংলাপে নেই/শাসনেও নেই, ভাষণেও নেই/আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই/রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই/উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই/লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই/পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই/হতাশায় নেই, আশাতেও নেই/প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই/এমন কি কালোবাজারেও নেই/কোথায় গেলেন সত্য?’ কবি আসাদ চৌধুরীর এই কবিতার মতোই দেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বিএনপিকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। কোথায় গেল বিএনপি? দীর্ঘদিন হয়ে গেল বিএনপিকে কোন রাজনৈতিক কার্যক্রমে দেখা যাচ্ছে না। সংবাদ মাধ্যমে বিএনপির নামে কোন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি নেই। নেতাদের মাঠ গরম করা বক্তৃতা নেই। নেই সরকার হটানোর নামে কোন হটকারী আন্দোলনের ডাক। বিএনপির তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রে কোন আলোচনা অনুষ্ঠান নেই। হোটেলে, রেস্টুরেন্টে কোথাও চায়ের কাপে বিএনপির নামে ঝড় উঠছে না। কোন আশার কথা উচ্চারিত হচ্ছে না বিএনপিকে নিয়ে। চলতি বছরের শুরু থেকে আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চালিয়েছে বিএনপি, তাতে রাজনীতির ব্যালান্সশিটে লাভক্ষতির হিসাবও করেনি দলটি। আগামী দিনে কী করতে চায় তা জানে না বিএনপির কর্মীরা। মাঠের কিংবা পদধারী অনেক শীর্ষ নেতাও জানেন না কোনপথে হাঁটছে বিএনপি। বিএনপির গন্তব্য দলপ্রধান নিজেও জানেন বলে মনে হয় না। তবে বিএনপির প্রতি কোমল মনোভাবাপন্ন যারা, তাঁরা কিছুটা হলেও আশাবাদী হয়ে ভাবতে পারেন সরকারবিরোধী আন্দোলন আপাতত বাদ দিয়ে রাজনীতিতে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে চায় বিএনপি। নেতাকর্মীদের জামিন যাতে ত্বরান্বিত হয়, এমন মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই ‘ঠা-া’ থাকার এই কৌশল বেছে নিয়ে রাজনীতির মাঠে কোন ‘গরম’ বক্তৃতা দেয়া থেকেও বিরত আছে দলটি। এই ভাবনাটি ইতিবাচক। কারণ, রাজনীতিতে সংঘাত বা অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে বা ফিরে এলে সরকার হার্ডলাইনে চলে যাবে। তাতে নেতাকর্মীদের জামিন পাওয়া কঠিন হবে। এসব ভাবনা যতই ইতিবাচক হোক না কেন বিএনপির সঙ্কট কিন্তু অন্যখানে। ঘরে-বাইরে নানামুখী সঙ্কটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে দলটি। দলের অনেক নেতাকর্মী প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশ নিতে না পারায় সংগঠন গোছানোই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে বিএনপির জন্য। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে গত কয়েক মাসে দলটির দলীয় ফোরামের বৈঠক পর্যন্ত ডাকা হয়নি। গত সাড়ে পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে দলীয় ফোরামের কোন পর্যায়ের কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। প্রথম দফায় ৫ জানুয়ারির সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর সাড়ে তিন মাস বৈঠক হয়নি। এরপর তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন শেষ হয়েছে দেড় মাস আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মূলত নেতাকর্মীর অভাবে খালেদা জিয়া দলীয় কোন পর্যায়ের কোন বৈঠক ডাকতে পারেননি। রাজনীতির মাঠ থেকে প্রায় সরে যাওয়া বিএনপি নেতৃত্বের অনেকেই মনে করেন সংগঠন গোছানোই এখন দলটির প্রাধিকার হওয়া উচিত। বাংলাদেশের রাজনীতির অন্দরমহলের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন, পর পর দুটি ‘নিষ্ফল’ আন্দোলন এবং কূটনৈতিক লবিং থেকে কাক্সিক্ষত ফল অর্জিত না হওয়ায় বিএনপির সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে হতাশা। মাঠ থেকে শুরু করে দলের শীর্ষপর্যায় পর্যন্ত এই হতাশা বিরাজ করছে। তৃণমূলে আরও বেশি সংক্রমিত হয়েছে বিষয়টি। সেইসঙ্গে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সদস্যদের কথাবার্তাতেও হতাশার সুর লক্ষণীয়। বিএনপির মতো বাংলাদেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের কেন এ অবস্থা। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব পন্থা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে নজিরবিহীন ‘নাশকতা’ চালানোর ফলে বিএনপি কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে ৩ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের ‘নিষ্ফল’ আন্দোলন শেষে ৫ এপ্রিল গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয় থেকে খালি হাতে ঘরে ফেরেন খালেদা জিয়া। পর পর দুটি ব্যর্থ আন্দোলন ও দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া খালি হাতে ঘরে ফিরে আসার পর সরকার হটিয়ে ক্ষমতারোহণের স্বপ্ন ভেঙে যায় বিএনপির। এখন তৃণমূল থেকে শুরু করে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, নির্ধারিত সময়ের আগে মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচন আদায় করা বিএনপির পক্ষে সম্ভব নয়। অবশ্য দেশের মানুষও তেমনটি চায় না। দুটি ‘নিষ্ফল’ আন্দোলনের পর কূটনৈতিক লবিংয়ে বিএনপি সর্বশেষ ভরসা করতে চেয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বাংলাদেশ সফরে এসে চলমান সঙ্কটের একটা সুরাহা করে যাবেন, এমন আশায় ছিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত নরেন্দ্র মোদির সফর থেকে বিএনপি নেতৃত্বের নিশ্চয় এ বোধোদয় হয়েছে যে জোর তদবির চালিয়ে ঘণ্টা খানেকের বৈঠকই মোদির সফর থেকে বিএনপির একমাত্র অর্জন। এছাড়া নিজেদের জন্য তেমন কোন অর্জন নেই। খালেদা জিয়ার লিখিত ‘নালিশ’ কর্ণপাত না করা এবং জনভাষণ ও যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষ করে মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচনের ব্যাপারে কোন কথা না থাকায় যারপরনাই হতাশ বিএনপি নেতৃত্ব। উল্টো ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, ক্ষমতায় থাকাকালে ১০ ট্রাক অস্ত্রের অবৈধ চালান এবং বর্ধমান বিস্ফোরণে জামায়াত-বিএনপির সম্পৃক্ততা নিয়ে নরেন্দ্র মোদির তিন প্রশ্নে খালেদা জিয়ার বিব্রত হওয়ার খবর দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর বিএনপির মোদি-স্বপ্ন যে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা স্পষ্ট যে স্বাভাবিক রাজনীতিতে স্থিত হওয়ার কোন পথ এখন আর বিএনপির সামনে খোলা নেই। দেশের মানুষ শান্তি চায়। উন্নয়নে শেখ হাসিনা যেভাবে অবদান রেখে চলেছে, তাতে রাজপথে আন্দোলনের ডাক দিয়ে জনসমর্থন পাওয়া যাবে না। আশ্রয় নিতে হবে সন্ত্রাস ও সহিংসতার। কবি আসাদ চৌধুরীর সত্য ফেরারী কবিতার পঙক্তির অনুকরণে যে প্রশ্ন, ‘কোথায় গেল বিএনপি’ তার উত্তরে বলতে হয় বিএনপির এখন নিদ্রার সময়। শীতকালে বা শীতল পরিবেশে শীতল রক্তের প্রাণীরা নিষ্ক্রিয় জীবনযাপন করে। একে বলা হয়ে থাকে শীতনিদ্রা। বিএনপির এই ঘুমকে বলা যেতে পারে রাজনৈতিক নিদ্রা। বিএনপির এই রাজনৈতিক নিদ্রা কি আদৌ ভাঙবে নাকি বিএনপি ভেঙে খান খান হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাব পেতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। লেখক : অস্ট্রিয়া প্রবাসী ও মানবাধিকারকর্মী [email protected]
×