ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চরম ভোগান্তি ;###;ফুটপাথসহ বেশিরভাগ রাস্তা বেহাল ;###;দু’বছরের কাজ শেষ হবে পাঁচ বছরে ;###;সচিবকে মন্ত্রী বললেন কিছু একটা করুন, এভাবে দিনের পর দিন চলতে দেয়া যায় না

উড়াল সেতুর ৮ কিমিজুড়ে নির্মাণ সামগ্রীÑমাটির গর্ত ॥ দিনভর যানজট

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৫ জুলাই ২০১৫

উড়াল সেতুর ৮ কিমিজুড়ে নির্মাণ সামগ্রীÑমাটির গর্ত ॥ দিনভর যানজট

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মগবাজার থেকে নাবিস্কো পার হয়ে সাতরাস্তার দিকে গেলেই চোখে পড়বে বেহাল রাস্তা ও ফুটপাথের চিত্র। এর একটু সামনে এগিয়ে গেলেই দেখা যাবে ভারি ভারি যানবাহন শিল্পাঞ্চলের বিকল্পপথে চলাচলের চেষ্টা করছে। প্রাইভেটকারসহ অন্যান্য যানবাহন চলছে সোজাÑ তারপরও যানজট। চালকরা জানিয়েছেন, রাস্তা সরু তাই এ অবস্থা। বেগুনবাড়ি এফডিসি সিগন্যালে ফ্লাইওভারের কাজের কারণে রাস্তা দু’পাশে দুই লেন খোলা মাত্র। এখানেও দিনভর গাড়ির জটলা। সাতরাস্তা-মগবাজার পর্যন্ত ফুটপাথ বলতে কিছু নেই। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় গর্ত। অনেক সময় ভারি ভারি যানবাহনকে ঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ কাজ করায় আটকে থাকতে হয়। মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভার প্রকল্পের সোয়া আট কিলোমিটার রাস্তা ও ফুটপাথের চিত্র ঠিক এরকম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেহাল রাজারবাগ-মালিবাগ-মৌচাক-মগবাজার-মালিবাগ রেলগেট-রামপুরা রাস্তাটির। তবে প্রকল্পের পুরো অংশেই ফুটপাথের বেহাল দশা। প্রকল্পের অব্যবস্থাপনার কারণে যানজটের মাত্রা বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। ঈদ সামনে রেখে রাজধানীর যানজটের অন্যতম কারণ এই ফ্লাইওভার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজট ঠেলে এই রাস্তায় চলতে হচ্ছে। গভীর রাত পর্যন্তও এ যানজট লেগে থাকে। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারা, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি, সমন্বয়হীনতার পরেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। উল্টো মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলে প্রকল্প ঝুলিয়ে দিয়ে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করছে প্রভাবশালী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। নামমাত্র হলেও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী একাধিকবার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা বলছেন। সময়সীমার দেড় বছরের বেশি পেরিয়ে গেলেও কার্যাদেশ বাতিল করা হয়নি। ২০১৩ সালে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেরও স্থানীয় সরকার সচিব জানিয়েছেন, শেষ হতে সময় লাগবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মগবাজার থেকে সাতরাস্তা ক্রসিং পার হতে সকল পরিবহনকে সিঙ্গেল লেন ব্যবহার করে চলতে হচ্ছে। কারণ রাস্তা বন্ধ করে মৌচাক-মালিবাগ উড়াল সড়কের কাজ চলছে। অথচ এই রাস্তা দিয়ে মিনিটে অন্তত দুই শত যানবাহন চলাচল করে। মৌচাক মার্কেটের সামনে চার লেন রাস্তার মধ্যে দুই লেন বন্ধ করে কাজ চলছে মাসাবধি। এক লেন ব্যবহার করে দু’পাশের গাড়ি চলছে। মালিবাগ বাবুর্চি গলিতে একলেন খোলা রেখে তিন লেন বন্ধ করে চলছে নির্মাণ কাজ। রাজারবাগ গ্রীন লাইন পরিবহনের কাউন্টারের সামনে একপাশের রাস্তায় একটি গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রেখে পুরোটাই বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মালিবাগ চৌধুরীপাড়াতেও একই চিত্র। প্রকল্পজুড়ে পাইলিংয়ের মাটি না সারানোয় বৃষ্টিতে কাঁদা হওয়ায় রাস্তা চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে। রাস্তার উপর রাখা হয়েছে নির্মাণ সামগ্রীসহ যন্ত্রপাতি। সোয়া আট কিলোমিটার এই প্রকল্পের পুরো রাস্তাই এখন গর্তে ভরা। কোথাও জমেছে পানি। বৃষ্টির পানিতে গাড়ি উল্টে দুর্ঘটনা নিয়মিতই হচ্ছে। ফুটপাথের বেহাল। সব মিলিয়ে নগরীর ব্যস্থতম এই রাস্তাটি এখন ব্যবহারের করার মতো নয়। এসব কারণে মৌচাক-সাতরাস্তা-শান্তিনগর-কাকরাইল চার্চ-মগবাজার-মালিবাগ-রামপুরা-রাজারবাগ-বেইলী রোড পর্যন্ত রাস্তায় দিনভর যানজট লেগেই থাকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। আশপাশের রাস্তাগুলোতেও আছে অসহনীয় যানজটের ভোগান্তি। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের কারণে জনদুর্ভোগের ভিডিওচিএ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সবাই সহায়তা না করলে এই প্রকল্পের কারণে সামনের দিনগুলোতে আরও দুর্ভোগ বাড়বে। এ ব্যাপারে তিনি সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রকল্পের পুরো রাস্তাটি সংস্কারের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বি এম এনামুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, মৌচাক-মালিক ফ্লাইওভার নির্মাণ করছে এলজিইডি। ঈদ সামনে রেখে প্রকল্পের পুরো রাস্তাটি সংস্কার করা ফুটপাথ মেরামতের জন্য প্রকল্প পরিচালককে বলা হয়েছে। আমরা চাই যেভাবে আমাদের রাস্তাটি এলজিইডিকে হস্তান্তর করেছিলাম সেভাবেই আমাদের ফিরিয়ে দেয়া হোক। তাহলে আমাদের রাস্তা কিভাবে ঠিক রাখতে হয়, সে অনুযায়ী কাজ করব। তবে আমরা আশাবাদী ঈদের আগে পুরো রাস্তাটিই সংস্কার করে জনদুর্ভোগ কমানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরেজমিন প্রকল্প ঘুরে দেখা গেছে, রাজারবাগ এলাকায় স্তূপ আকারে রাস্তায় মাটি রয়েই গেছে। ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে নির্মাণ কাজের কারণে সরু হয়ে গেছে রাস্তা। গর্ত তো আছেই। বৃষ্টি হলে দুর্ভোগের মাত্রা বাড়ে কয়েকগুণ। গর্তে দুর্ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। ফুটপাথগুলো এখন আর ব্যবহারের উপযোগী নয়। ভাঙাচোরা ফুটপাত দিয়ে চলাও দায়। মালিবাগ মোড় থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত ফুটপাথের অবস্থা একই। মৌচাক পর্যন্ত একই অবস্থা। ড্রেনেজ ব্যবস্থাও খুব নাজুক। ময়লা জমে বন্ধ হয়ে গেছে ড্রেন। বৃহস্পতিবার বিভিন্ন স্থানে মাটি, বালুসহ নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে নেয়ার কাজ চলতে দেখা গেছে। ২০১২ সালে শুরু হয়ে প্রকল্প ২০১৩ সালের ডিসেম্বরেই শেষ হওয়ার কথা ছিল। অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার প্রায় দেড় বছর পেরোলেও কাজ হয়েছে মাত্র অর্ধেক। এদিকে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পক্ষ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত প্রকল্পের সময় বৃদ্ধিসহ নির্মাণ ব্যয় ৭৭২ কোটির পরিবর্তে প্রায় এক হাজার চার শ’ কোটি টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রকল্পে রয়েছে ২৬৫ পিলার। আছে আটটি লুপ। এর মধ্যে সোয়া পাঁচ কিলোমিটার প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৩৫ পিলার স্থাপনের কাজ শেষ করেছে তমা কনস্ট্রাকশন। বাকি তিন কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ করছে সিমপ্লেক্স। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ডিজাইনে ১৪৭টি পাইলের মধ্যে ১২২টির অবস্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে ঢালাই সম্পন্ন হওয়া ৩৫ পাইলের মধ্যে ১২টি পরিত্যক্ত হবে। কয়েকটি পিলারের অবস্থান ও দূরত্বে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ফ্লাইওভারটি কয়েকটি ভাগে নির্মাণ করা হবে। প্রথম পর্যায়ে তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে শুরু হয়ে এফডিসি ঘুরে মগবাজার রেলক্রসিং পার হবে। এর একটি ‘লুপ’ হলিফ্যামিলি হাসপাতালের কাছে গিয়ে শেষ হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাংলামোটর থেকে মগবাজার, মৌচাক, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে শেষ হবে। আরেকটি ধাপে রামপুরা রোড থেকে মৌচাক হয়ে শান্তিনগর গিয়ে শেষ হবে। মগবাজার ও মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের ওপর দিয়ে ফ্লাইওভারটি চলে যাবে। ফ্লাইওভারের ওপরে দুটি অংশ থাকছে। এর মধ্যে সাতরাস্তা থেকে আসা অংশটি নিচ দিয়ে ও বাংলামোটর থেকে মালিবাগের দিকে যাওয়া অংশটি ওপর দিয়ে যাবে। ঈদ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে মৌচাক-মালিবাগ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অনেকটা তোপের মুখেই পড়েন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী কর্তৃপক্ষের মধ্যে প্রায় সকলেই রাজধানীতে যানজট আর জনদুর্ভোগের অন্যতম কারণ হিসেবে প্রকল্পের অব্যবস্থাপনাকেই দায়ী করেন। এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেও। বৈঠকে মন্ত্রী স্থানীয় সরকার বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিবের কাছে প্রকল্পের সার্বিক বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। জবাবে সচিব আব্দুল মালেক মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারকে একটি মেগা প্রজেক্ট উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটি অংশ দুই দশমিত ১০ কিলোমিটার, যা ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শেষ হবে। ইস্কাটন-মগবাজার-রাজারবাগ পর্যন্ত অংশটি শেষ হতে সময় লাগবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত। মৌচাক-মগবাজার পর্যন্ত এক দশমিক এক কিলোমিটার ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে আরও দেড় বছর। তিনি জানান, সাত রাস্তা থেকে হলি ফ্যামেলি হাসপাতাল পর্যন্ত রাস্তাটির সিঙ্গেল লেন বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। গর্ত ভরাটের কাজ চলছে। মানুষের ভোগান্তি নিরসনে সর্বাত্মক চেষ্টার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, দুর্ভোগ যেন না বাড়ে সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। এর পর পরই সচিবকে উদ্দেশ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রকল্পের এই অবস্থা হওয়ার পেছনে পিডি ও ঠিকাদারদের অবহেলা আছে। তারা কথা দেয়, কিন্তু রাখে না। কত বর্ষায় এই রাস্তায় মানুষের যে কত ভোগান্তি হয়েছে তা বলার মতো নয়। এভাবে তো চলতে দেয়া যায় না। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখুন। জনদুর্ভোগ কমান। প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। সময়মতো কাজ না করতে পারলে কার্যাদেশ বাতিল করুন। ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করুন। সবাইকে জিম্মি করে দিনের পর দিন এরকম প্রকল্প চলতে পারে না।
×