ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চালক ও হেলপারের অবমাননাকর ভাষা শুনতে হয় ৪৮% নারীকে ;###;বিআরটিসির মহিলা বাস অপর্যাপ্ত

গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের ভোগান্তি ॥ সংরক্ষিত সীমিত আসনও থাকে না বেশিরভাগ বা

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ৭ জুলাই ২০১৫

গণপরিবহনে নারী যাত্রীদের ভোগান্তি ॥ সংরক্ষিত সীমিত আসনও থাকে না বেশিরভাগ বা

শমী চক্রবর্তী ॥ গণপরিবহনে প্রতিনিয়তই ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হয় নারী যাত্রীরা। সরকারী-বেসরকারী বাসে তাদের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকেও যেন নেই। নারী-শিশু-প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি সিট বরাদ্দ থাকার কথা থাকলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে চার সিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ওই আসন অনেক সময়ই পুরুষ যাত্রীদের দখলে থাকে। সংরক্ষিত আসন উদ্ধার করতে গিয়ে পুরুষ যাত্রীদের বিরূপ আচরণে নারীদের অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। এমনকি সংরক্ষিত নয়টি আসন ছাড়া অন্য আসনে বসলেও পুরুষ যাত্রীরা শুরু করেন তর্কবিতর্ক। যানবাহনে ওঠার ক্ষেত্রে নারী শিশুদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে তা খুব বেশি একটা নজরে পড়ে না। কর্মজীবী নারী ও শিক্ষার্থীদের গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করে পুরুষদের পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কি করে দাঁড়িয়ে, বাসের পা-দানিতে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে। অফিস কর্ম সময়ে যখন পরিবহনে চাপ বেশি থাকে তখন বহু বেসরকারী বাসে ‘সিট নেই’ বলে নারীদের উঠতে দেয়া হয় না। পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহনে উঠতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানিসহ নানারকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে নারীরা। যানবাহন স্বল্পতাও রয়েছে। অন্যদিকে সরকারীভাবে পরিচালিত বিআরটিসি মহিলা বাস সার্ভিসের সেবাও অপর্যাপ্ত। নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার ঘোরটোপে মহিলা বাস সার্ভিসের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নগরীর মহিলা যাত্রীরা। ভোগান্তির শিকার যাত্রী এবং সংশ্লিষ্টরা বলেন, শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বেড়েছে। নগরীতে বসবাসরত কয়েক লাখ নারীকে প্রতিদিন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কর্মস্থলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু সেই অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে যানবাহনে চড়তে গিয়ে পুরুষদের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হচ্ছে নারীদের। বাসে সংরক্ষিত সিট ফাঁকা না থাকায় উঠতেও পারছেন না অনেকে। বাসে উঠতে এবং নামতে শরীরের বিভিন্ন অংশে লাগছে হেলপারের হাত। কিছু পুরুষ যাত্রী ইচ্ছা করে নারী যাত্রীদের গায়ের ওপরে পড়ে যান কিংবা অপ্রয়োজনে গায়ে হাত দেন। ২০১৪ সালের অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের নিরাপদ নগর কর্মসূচীর ভিত্তিমূলক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নারীরা গণপরিবহনসহ বিভিন্ন জায়গায় যৌন হয়রানির শিকার হন। ৪৮ শতাংশ নারীর বাসের চালক বা ভাড়া আদায়কারীর মুখে অবমাননাকর ভাষা শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যৌন হয়রানি বা সহিংসতা এড়াতে কৌশল হিসেবে জরিপে অংশ নেয়া নারীদের ১৩ শতাংশ গণপরিবহন ব্যবহার করা বন্ধ করেছেন বলেও জানান। তিন শতাংশ নারী বলেন, আত্মরক্ষায় তারা অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখেন। নারীদের ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের জন্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) ১৯৯০ সালে প্রথম ঢাকা শহরে দুটি রুটে নারীদের জন্য আলাদা বাস সার্ভিস চালু করে। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক হওয়ায় মাত্র ৮ মাস পরেই তা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০০১ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে তা চালু হয়। বিআরটিসি তথ্যমতে, রাজধানীতে বিভিন্ন সড়কপথে মোট ১৬টি বাস নারীদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। নারী যাত্রীদের মতে, রাজধানীতে কর্মজীবী নারীর তুলনায় মাত্র ১৬টি বাসের সংখ্যাটি খুব কম। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় কম বাস, নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে না চলা, মহিলাদের জন্য নির্ধারিত বাসে পুরুষ যাত্রীদের বহন করার জন্য দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে বিআরটিসির মহিলা বাস সার্ভিসের যাত্রীদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে ক্রমাগত লোকসান হওয়ার কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাসের সংখ্যা বাড়ানো যাচ্ছে না। অনুসন্ধানে নিয়ম ভেঙে বিআরটিসির বাসগুলোতে পুরুষ যাত্রী বহন করতেও দেখা গেছে। এ বিষয়ে বিআরটিসির পরিচালক (অপারেশন) মোঃ রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, বাসগুলোতে সকাল ও বিকেলে চাপ থাকলেও অন্য সময় চাপ থাকে না। সে সময় যাত্রী না থাকায় তেলের খরচ পুষিয়ে নিতে পুরুষ যাত্রী বহন করা হয়। বিআরটিসির তথ্যে জানা যায়, বর্তমানে মতিঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া, খিলগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন রুটে মোট ৮টি মহিলা বাস চলছে। এর মধ্যে কল্যাণপুর রুটে এ সেবা চালু করা যায়নি। ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জ-কাঁচপুরে আরেকটির চলাচলের কথা থাকলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। মহিলা যাত্রীদের অভিযোগ, বাসগুলো পথে অকারণে প্রচুর সময় নষ্ট করে। এক মহিলা যাত্রী অভিযোগ করেন, সময় মেনে বিআরটিসির বাসগুলো ছাড়ে না। এজন্য এতে সব সময় চলাচল করা যায় না। তবে এ বাসগুলো শুধু নির্দিষ্ট রুটে এবং সময় মেনে চলাচলের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বহু নারী এ বাসগুলোতে ভ্রমণ করতে পারেন না। আবার অনেক নারী আছেন যারা এ বাস সার্ভিস সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতালে একজন সহকারী নাদিয়া ইসলাম সোমা বলেন, কখনও ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠতে গেলে বিভিন্ন কটূক্তিসহ অশোভন আচরণ সহ্য করতে হয় বাসের হেলপার থেকে শুরু করে সহযাত্রী অনেক শিক্ষিত লোকের কাছ থেকেও। এ সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, ‘নারীদের যাতায়াত সমস্যা দূর করতে বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সিভিল নাগরিকদের সচেতন হতে হবে। নারীদেরও নিজের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে। পুরুষরা যদি নিজের বোন কিংবা মেয়ে মনে করে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন তাহলে নারীদের যাতায়াতের সমস্যা অনেকটা কমবে।’
×