ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেহানার বিয়ের দিন ঘিরে সংসদে শেখ হাসিনার চোখের পানি

রাজাকারের কবর অপসারণের সিদ্ধান্তে অভিনন্দন

প্রকাশিত: ০৬:১৮, ৯ জুলাই ২০১৫

রাজাকারের কবর অপসারণের সিদ্ধান্তে অভিনন্দন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় সংসদ ভবন চত্বর থেকে সবুর খানসহ অন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের কবর সরানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। বুধবার সংগঠনের সভাপতি বিচারপতি গোলাম রব্বানী ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ও সাধারণ সম্পাদক কাজী মকুল স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে সংগঠনটি সরকার ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে অভিনন্দন জানান। জাতীয় সংসদ ভবনের পাশ থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজ ও পাকিস্তানের যোগাযোগমন্ত্রী সবুর খান ও মশিউর রহমান যাদু মিয়ার কবর অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী (একনেক) কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংসদ ভবন ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে স্থপতি লুই আই কান যে নকশা করেছিলেন, সেখানে কবরের জন্য স্থান নির্ধারিত ছিল না। হঠাৎ করে তিনজনকে সেখানে কবর দেয়া হলো। সংসদ ভবনের ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি লুই কানের নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কবরগুলো যদি সরানোর দরকার হয়, তাহলে সরকার তাই করবে। বিবৃতিতে বলা হয়, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় দালাল ও যুদ্ধাপরাধী খান এ সবুরসহ অন্য স্বাধীনতাবিরোধীদের কবর জাতীয় সংসদের প্রাঙ্গণ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের মূল্যে অর্জিত বাংলাদেশের মহান জাতীয় সংসদে সবুর খানদের কবর দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মদানকে উপহাসের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করবার জন্যÑ যা ছিল বাংলাদেশেকে পাকিস্তানের রূপান্তরিতকরণের চক্রান্তের অন্তর্গত। দেরিতে হলেও প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের পরিবার বর্গসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার ধারক সর্বস্তরের নাগরিকদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। একই সঙ্গে উচ্চতর আদালতের নির্দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে খুলনাসহ অন্যান্য নগরের স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ সরকার কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতাবিরোধীদের মহিমান্বিত করার হীন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। এদিকে মঙ্গলবার সংসদে প্রধানমন্ত্রী জানান, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার বিয়ের সময়ে অর্থাভাবে যেতে পারেননি তাঁর বড় বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘দুটি সন্তান নিয়ে টিকেট কেটে লন্ডনে যাওয়ার মতো টাকা তখন আমার ছিল না। ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেখানে কোথায় থাকব, কী খাব এটিই ছিল বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তিন নারীÑ রুশনারা আলী, রূপা হক ও টিউলিপ রেজওয়ানা সিদ্দীক ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে তাদের ধন্যবাদ জানানোর জন্য আনীত প্রস্তাবের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই তথ্য দেন শেখ হাসিনা। এ কথা বলার সময় তাঁর কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে। তাঁর ২০ মিনিটের বক্তব্যের পুরোটাই ছিল আবেগঘন। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে চলা অধিবেশনে এ সময় ছিল পিন-পতন নীরবতা। স্মৃতিচারণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার এখনও মনে আছে জন্মের সময় টিউলিপ ছিল ছোট্ট ফুলের কুঁড়ির মতো। সেই ছোট্ট টিউলিপ এখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। এমপি হওয়ার পর হাউস অব কমন্সে তার বক্তব্য শোনার জন্য লন্ডন গিয়েছিলাম। অল্প সময়ে এত চমৎকার ও সাবলীলভাবে সে বক্তব্য রেখেছিল, দেখে গর্বে আমার বুক ভরে গিয়েছিল। আসলে রক্ত কথা বলে। টিউলিপের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেটি আবারও প্রমাণ হলো।’ তিনি বলেন, ‘১৯৭৫-এর ৩০ জুলাই রেহানাকে নিয়ে আমি জার্মানিতে যাই। কথা ছিল বাবা জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি আসবেন। তাঁর সঙ্গে আমরাও দেশে ফিরব। আমি বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী ছিলাম। চেয়েছিলাম রেহানাও সেখানেই পড়বে। সেজন্য জার্মানি যাওয়ার আগে আমি নিজে কলেজে গিয়ে রেহানার ফরম পূরণ করে দেই। রেহেনা ফিরে সেখানে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু সেটি আর হয়নি। মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে আমরা সব হারালাম। দেশে আসতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আসতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। নানা ধরনের কথা আর গুজবের ছড়াছড়ি, কেউ কেউ বলল মা আর রাসেল বেঁচে আছে। সঠিক কোন খবর পাচ্ছিলাম না। দেশে ফিরে আসার জন্য আমরা ব্যাকুল ছিলাম। ভাবলাম দেশে ফিরলে জানতে পারব কী ঘটেছে। দিল্লীতে যখন নামলাম, সেখানে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা হলো। জার্মানিতে আমরা সেখানে তখনকার রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তিনিই জানালেন কেউ বেঁচে নেই। সেই খবর সেদিন আমি রেহানাকে জানাতে পারিনি। মিসেস গান্ধী আমাদের দিল্লীতে থাকার ব্যবস্থা করেন।’ ঘটনার বর্ণনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দেশে ফিরতে চাই আর রেহানা সিদ্ধান্ত নিল সে লন্ডনে যাবে। আমার বাবা সৎ রাজনীতি করেছেন। বিদেশে রেহানার লেখাপড়া করার মতো আর্থিক সঙ্গতি আমাদের ছিল না। রেহানার বিয়ের বিষয়ে জিল্লুর রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) আগেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিলেন আইভি চাচির পরিবারের একজনের সঙ্গে। তখন আমাদের কেউ নেই, কিছু নেই, কোথায় যাব! এই অবস্থা। এ সময় জহুরুল ইসলাম চাচা আমাদের খবর পাঠালেন। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বরে রেহানা লন্ডনে গিয়ে চাচার বাসায় উঠল। বাবার একজন বন্ধু, যিনি নিজেও নির্বাসিত ছিলেন, তিনি রেহানাকে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। এভাবে রেহানা সেখানে থাকল, তার বিয়ে হলো। আমরা সম্পূর্ণ একা, মা-বাবা-ভাই হারা। সেসময় লন্ডনে অনেকেই রেহানার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আবার অনেকে আমাদের খবর নেয়নি।’ শেখ রেহানার জীবন সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বড় বোন বলেন, ‘নিজে চাকরি করে, কত কষ্ট করেছে রেহানা। ’৮২ সালে টিউলিপের জন্ম হয়। আমি তখন পাশে ছিলাম। ছোট্ট টিউলিপ, লেখাপড়া শিখেছে, চাকরিও করেছে। টিউলিপের বাবাও ভাল ছাত্র ছিলেন, রেহানার ছেলেরাও লেখাপড়ায় বেশ ভাল। লেখাপড়ার সঙ্গে টিউলিপ লেবার পার্টির রাজনীতিতে যুক্ত হয়। একটা ছোট্ট মেয়ে, কী যে কষ্ট করতে পারেÑ দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়ে যাই। সে তার নির্বাচনী এলাকার মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। প্রতিটি ঘরে ঘরে সে যায়। আমার বাবাও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রেহানাও প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে ছিল। আমি তিনবার প্রধানমন্ত্রী অথচ আমার বোন আগে যেমন ছিল, এখনও তেমনই। এখনও সে বাসে চড়ে, বাসে ঝুলে অফিসে যায়। শুধু নিজের ছেলেমেয়েকে নয়, আমার ছেলেমেয়েকেও রেহানাই দেখাশোনা করেছে। আমাদের পাঁচ বাচ্চার অভিভাবক রেহানাই ছিল। কত কষ্ট করে যে ওদের মানুষ করেছে!’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘টিউলিপ যেই আসনে জিতেছে, সেটি লেবার পার্টির আসন নয়। সেখানে এবার এক হাজার ১০০-এর বেশি ভোটের ব্যবধানে টিউলিপ জিতেছে। তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে থাকা খালেদা জিয়ার ছেলে (তারেক রহমান) সব চেষ্টাই করেছে টিউলিপ যেন জিততে না পারে। বাংলাদেশের একটি মেয়ে নির্বাচন করছে, সেটিও তাদের সহ্য হয় না। কারণ তারা তো বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। তারপরও আমি কৃতজ্ঞতা জানাই প্রবাসী বাঙালীদের প্রতি, তারা টিউলিপের পাশে দাঁড়িয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাই এই দেশের মানুষের প্রতি। আমরাও তো সব হারিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই পিতা-মাতা-ভাই-স্বজন হারানোর স্মৃতি ফিরে পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই। জাতির পিতা আমাদের যে আদর্শ দিয়ে গেছেন, সেই আদর্শেই সন্তানদের মানুষ করেছি। টিউলিপের যে যাত্রা শুরু, জীবনে যেন আরও সাফল্য পায়। তার জীবন যেন সুখী হয়, সবার কাছে সেই দোয়া চাই। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, তিন বঙ্গকন্যার নির্বাচিত হওয়া দেশের জন্যই গৌরবের। এই ব্রিটিশরাই দু’শ’ বছর আমাদের শাসন করেছিল। কাজেই এই তিন কন্যাই আমাদের গৌরব। তিন কন্যার জন্য দোয়া করি। বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ত্যাগ ছাড়া কিছু অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষ উন্নত জীবন পাক, বিজয়ের মুকুট সব সময় বাঙালী জাতির মাথায় শোভিত হোক। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস করতে সবার কাছে অনুরোধ রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
×