ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আগাম জামিন বিষয়ে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন খারিজ

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১০ জুলাই ২০১৫

আগাম জামিন বিষয়ে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন খারিজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আগাম জামিন বিষয়ে আপীল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ। বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেনÑ বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। বৃহস্পতিবার আদালতে রিভিউ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রায়ে বলা হয়, ‘আগাম জামিন মঞ্জুরের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বিবেচনা খুবই বিস্তৃত। এটা অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত যে, আইনী নীতির ভিত্তিতে বিচারিক বিচক্ষণতাবেষ্টিত হবে এবং স্বেচ্ছাচারী বিবেচনার ওপর ভর করে হবে না। অবশ্যই এজাহারের খুঁটিনাটি বিষয়ে বিচারকের চিন্তায় এবং আদেশে তার প্রতিফলন থাকবে যে, তাঁরা ঘটনাটি (ফ্যাক্ট) ও অভিযোগসমূহ সর্বোতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।’ রায়ে আরও বলা হয়, ‘কখনও কখনও কোন আবেদনকারীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ধরন গুরুতর হলে গ্রেফতারপূর্ব জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা জরুরী। কারণ, আদালত সব সময় এই অন্তর্দর্শন লালন করে যে, শেষ পর্যন্তও যেন অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায়। নইলে সভ্য সমাজের গঠন ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে। বিচারক কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্তের ও সামগ্রিকভাবে সমাজের স্বার্থের বিষয়ে অচেতন থাকতে পারে না। অভিযুক্তের জামিনের কারণে তদন্ত প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে এমন ক্ষেত্রে আগাম জামিন প্রদানের আগে অবশ্যই বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।’ শুনানির একপর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আগাম জামিন শুধু অত্যন্ত বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া দেয়া যেতে পারে না। ঢালাই আগাম জামিন হতে পারে না। আমরা এমনও দেখেছি, এক মিনিটে ১০০ ব্যক্তিকে জামিন দেয়া হয়েছে। এমনও লোক দেখেছি, নকল লোককে আগাম জামিনের লাইনে দাঁড় করা হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই চান না হাইকোর্টটা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে পরিণত হোক। তখন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, জামিন পাওয়াটা মানবাধিকার। এর উত্তরে বিচারপতি এএইচএম সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, গত কয়েক মাসে পেট্রোলবোমার ফলে যেসব মানুষ মারা গেছে এবং মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে তাদের পরিবারকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন। তাদের মতামত কী। মানবাধিকার শুধু আসামিদেরই নয়, মানবাধিকার সমাজের এবং অপরাধের ভুক্তভোগীদেরও। তাদের মানবাধিকারের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। বিচারপতি এএইচএম সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আদালতে বলেন, আগাম জামিন দেয়ার অর্থ হলো একটা আসামিকে রিমান্ড থেকে বাঁচিয়ে দেয়া এবং তদন্ত প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করা। রিমান্ড হলো ফৌজদারি তদন্ত প্রক্রিয়ার বিশেষ একটি অতি প্রয়োজনীয় অংশ। রিমান্ডে না নিলে পুলিশ অনেক তথ্য থেকে বঞ্চিত হয়, যার ফলে ন্যায়বিচার বিঘিœত হয় এবং আসামি আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায়। গত কয়েক মাস থেকে বোঝা যায় যে, রিমান্ড নেয়ার ফলে পুলিশ অনেক তথ্য পেয়েছে। পুলিশ আগের পুলিশ নেই। পুলিশ এখন আইনকে অনেক ভয় পায় এবং যেসব পুলিশ অন্যায় করেছে সেসব পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এরমধ্যে উচ্চপর্যায়ের পুলিশও রয়েছে। গত দুই বছরে ঘটনা দেখেন পুলিশ কিভাবে হরতালকারীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। ইট দিয়ে পুলিশের মাথা থেঁতলে দেয়া হয়েছে। অনেক পুলিশকে হত্যা করা হয়েছে। মারাত্মকভাবে আহত করা হয়েছে। এরপরও পুলিশের কোমরে পিস্তল থাকা সত্ত্বেও আত্মরক্ষার কারণে কাউকে গুলি করেনি। সুতরাং এ থেকে বোঝা যায়, পুলিশ আগের মতো নেই। তাছাড়া রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়েছে এমন কথা আজ সচরাচর শোনা যায় না। তখন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে উদ্দেশ করে বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করবেন না। দু-একজন খারাপ থাকতে পারে। পুলিশ শান্তি রক্ষায় অনেক কাজ করছে। পুলিশ ছাড়া সমাজে শান্তি টেকে না। তখন বিচারপতি এএইচএম সামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, জ্বালাও-পোড়াও করলে তাদের কি আগাম জামিন দেয়া উচিত হবে? এর উত্তরে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, তাদের ফাঁসি হোক। কিন্তু প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের বের করতে হবে। এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, জামিনের বিষয়টি সর্বসাধারণের। এজন্য জনস্বার্থের রিট আবেদন করেন সাধারণত নিরপেক্ষ মানুষ বা সংক্ষুব্ধ মানুষ বা বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলো। যেমন মনজিল মোরসেদ ও ইউনুছ আলী আকন্দের মতো লোকেরা। কিন্তু খন্দকার মোশাররফের মামলায় জামিনের বিষয়ে ওই আবেদন করেন সুপ্রীমকোর্র্ট আইনজীবী সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক, যাঁদের একজন একটি বিশেষ দলের পদে অধিষ্ঠিত। অন্যজন একজন বিশেষ ব্যক্তির উপদেষ্টা। তার মানে তাঁরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তির রিট আবেদন বা জামিনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যায় না। এই যুক্তিতে আপীল বিভাগ তাঁদের আবেদন খারিজ করেছেন। গত বছরের ১৮ জুন আইনজীবীদের অনুরোধে সুপ্রীমকোর্ট বার এ্যাসোসিয়েশন পুনর্বিবেচনার আবেদনটি করে। সুপ্রীমকোর্ট বারের পক্ষে সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন পুনর্বিবেচনার আবেদনের বাদী। হাইকোর্টের আগাম জামিন মঞ্জুরের ওপর শর্তারোপ করে আপীল বিভাগের দেয়া রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনটি (রিভিউ) গত ১৪ মে আপীল বিভাগের চেম্বার জজ বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন শুনানির জন্য ২৮ মে দিন নির্ধারণ করে আপীল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। আদালতে আবেদনটি উপস্থাপন করেন সুপ্রীমকোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। আগাম জামিন মঞ্জুরের ক্ষেত্রে গত বছরের ২০ মার্চ আপীল বিভাগ সাত দফা নির্দেশনাসহ রায় ঘোষণা করে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা অর্থ পাচারের মামলায় আগাম জামিন বাতিল করে আপিল বিভাগ রায়টি দেয়। সাত দফা নির্দেশনা সংবলিত এ গাইডলাইন অনুসরণ করতে গিয়ে হাইকোর্টে আগাম জামিন প্রায় বন্ধ অবস্থায় রয়েছে। আপীল বিভাগ রায়ে বলে, হাইকোর্ট (সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ) আপীল বিভাগের দেয়া নীতিমালা অনুসরণে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা কেবল এটাই বলছি, হাইকোর্ট বিভাগের ওই ডিভিশন বেঞ্চ পরিহাসমূলক (প্যারাডক্সিক্যাল) আগাম জামিনের আদেশ দিয়েছে। আপীল বিভাগ এই হতাশা ব্যক্ত করে আগাম জামিনের বিষয়ে সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছে। আপীল বিভাগের নির্দেশনাগুলো হলো ॥ হাইকোর্ট এখন থেকে চার সপ্তাহের বেশি আগাম জামিন দিতে পারবে না। হাইকোর্টকে অবশ্যই আগাম জামিনের কারণ উল্লেখ করতে হবে এবং সন্তুষ্টির দিকগুলোও লিপিবদ্ধ করতে হবে। আগাম জামিনপ্রার্থীর রাজনৈতিক পরিচয় অথবা তার সঙ্গে কারও বিরোধের প্রেক্ষিতে এই মামলার উদ্ভব হয়েছে- এ ধরনের দাবি মঞ্জুরের ক্ষেত্রে বিবেচ্য হতে পারে না। একই সঙ্গে আপীল বিভাগ মনে করে, নিম্ন আদালত বা ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা এখন আর সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নন। এ প্রসঙ্গে আপীল বিভাগ বলেছে, নিম্ন আদালত স্বাধীন নয় বা নিম্ন আদালতের বিচারকদের নির্বাহী বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করে- এ রকম ধারণাকে সুনির্দিষ্ট ধরে নেয়া যাবে না। দেশে আগাম জামিনের কোন আইন নেই। হাইকোর্ট তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতায় আগাম জামিন প্রদান করে থাকে। অতীতে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নেতাকর্মীদের (রাজনৈতিক কর্মসূচীকেন্দ্রিক ঘটনায় উদ্ভূত মামলায়) জামিনদানের ক্ষেত্রে হাইকোর্ট উদার মনোভাব দেখিয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে জরুরী অবস্থা জারির পর আগাম জামিন বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে রাষ্ট্র বনাম জাকারিয়া পিন্টু মামলায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপীল বিভাগ আগাম জামিন নিরুৎসাহিত করে একটি রায় দেয়। ওই রায়ে বলা হয়েছিল, জামিনের এখতিয়ার বিচারিক আদালতের। হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের এখতিয়ারের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। আগাম জামিন প্রদান করে নিম্ন আদালতকে পুনরায় জামিন দেয়ার জন্য হাইকোর্ট কোন নির্দেশনা দিতে পারে না। ওই রায়ের পর আগাম জামিন বন্ধ হয়ে যায়। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট নির্দিষ্ট সময় দিয়ে আসামিকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে আসছে। সম্প্রতি বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও জাফর আহমেদ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন একটি বেঞ্চ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে আগাম জামিন দেয়। আপীল বিভাগ ওই জামিন আদেশ বাতিল করে। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত আপীল বিভাগের বেঞ্চ আগাম জামিন প্রশ্নে সাত দফা নির্দেশনা দেয়। দুদক বনাম ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মামলার মূল রায়টি লেখেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মনিক। রায়ে বলা হয়, আগাম জামিন মঞ্জুরের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের বিবেচনা খুবই বিস্তৃত। এটা অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত আইনী নীতির ভিত্তিতে বিচারিক বিচক্ষণতাবেষ্টিত হবে এবং স্বেচ্ছাচারী বিবেচনার ওপর ভর করে হবে না। অবশ্যই এজাহারের খুঁটিনাটি বিষয়ে বিচারকের চিন্তায় এবং আদেশে তার প্রতিফলন থাকবে যে, তাঁরা ঘটনাটি (ফ্যাক্ট) ও অভিযোগসমূহ সর্বোতভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন।
×