ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্ট

প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য দায়ী এমন বিশ কর্মকর্তা শনাক্ত

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১১ জুলাই ২০১৫

প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য দায়ী এমন বিশ কর্মকর্তা শনাক্ত

বিভাষ বাড়ৈ ॥ তদন্ত কমিটির কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পাওয়ায় এবার কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে ব্যাপক রদবদল শুরু করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আলোচিত প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার কারণে ইতোমধ্যেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকসহ তিন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করেছে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি। দায়িত্বে অবহেলাসহ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে অন্তত ২০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। শীঘ্রই এদের বিরুদ্ধে বদলিসহ বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা। কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে, কারিগরি বোর্ডে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য একটি সিন্ডিকেট জড়িত। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী সিন্ডিকেটের সদস্য হলেও এর সঙ্গে আছে বাইরের ব্যক্তিরাও। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও কারিগরি বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে বোর্ডের কর্মকর্তারা ছাড়াও কয়েকটি বেসরকারী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষরা জড়িত। এরা প্রত্যেকেই সরকারী চাকরি করেও গোপনে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন নিয়ে ব্যবসা করছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা নিজেদের নামে প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেননি। নিজের স্ত্রী, ভাই বা নিকট আত্মীয়স্বজনের নামে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনুমোদন নিয়ে এরা ব্যবসা করছে। প্রশ্ন ফাঁসের এই চক্রটির সংশ্লিষ্টতার কথা বলছেন কর্মকর্তারা। বেসরকারী পলিটেকনিকের শিক্ষকরা এমন একটি অভিযোগ তুলছিলেন বহুদিন ধরেই। প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় গত ২৯ জুন বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং সপ্তম পর্বের সমাপনী পরীক্ষার ডিজাইন অব স্ট্রাকচার-২ বিষয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। পরীক্ষার একদিন আগেই ঘটনা টেক পেয়ে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছিল। প্রথমে একজন শিক্ষার্থী ফেসবুক থেকে প্রশ্ন নিয়ে নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অফিসে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র জমা দেন। পরে বিষয়টি বোর্ডের সকলের নজরে আসে। বিষয়টি তদন্তের জন্য কারিগরি বোর্ডের সচিব আব্দুল হক তালুকদার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী ও বোর্ডের উপ-পরিচালক (গবেষণা ও মূল্যায়ন) রাজু মোঃ শহীদুল ইসলামের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কারিগরি বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ের প্রশ্ন বিজি প্রেসে ছাপা হলেও অন্যান্য স্তরের প্রশ্নগুলো বোর্ডের অভ্যন্তরীণ প্রেসে ছাপানো হয়। এক্ষেত্রে বোর্ডের গোপনীয় থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সর্বক্ষণিক গোপনীয় শাখার দায়িত্বে থাকেন একজন উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। তদন্ত কমিটির কাছে প্রথমেই তিন কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। বৃহস্পতিবার সেই তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বদলিপূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম মীরকে ঢাকা কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের আঞ্চলিক পরিচালক, উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (গোপনীয়) শেখ মফিজুর রহমানকে কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরে সংযুক্তি দেয়া হয়েছে। এছাড়া পরিচালক (কারিকুলাম) মোঃ আব্দুর রাজ্জাককে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়েছে। নরসিংদী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ সুশীল কুমার রায়কে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ শামসুল আলমকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পরিচালক (কারিকুলাম) করা হয়েছে। এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয় বোর্ডের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থ্ ানেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শীঘ্রই এ লক্ষ্যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্তত ২০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংখ্যার কথা উল্লেখ না করলেও তদন্ত কমিটিতে থাকা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি উপ-সচিব সুবোধ চন্দ্র ঢালী জানিয়েছেন, ইতোমধ্যেই যাদের বদলি করা হয়েছে তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। সরকার প্রশ্ন ফাঁসে কোন ছাড় দেবে না। যারা জড়িত শীঘ্রই তাদের সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারা ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত? এ প্রশ্নে মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার সঙ্গে অনেক ব্যক্তি জড়িত। এ সংখ্যা অনেক। জানা গেছে, প্রশ্ন ছাপানোর শাখা যতটা সংরক্ষিত ও গোপনীয়তা থাকার কথা তার ব্যতয় ঘটেছে। কর্মকর্তাদের অবহেলা, দায়িত্বহীনতা পরিলক্ষিত হয়েছে কমিটির কাছে। তিন সদস্যের কমিটি হলেও টেকনিক্যাল বিষয়ের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের পরিচালক পর্যায়ের একজনের সহায়তা নেয়া হয়। কর্মকর্তারা জানান, গাজীপুর থেকে একজন ফেসবুকে প্রশ্ন আপলোড করেছে, তাকে মোটামুটি চিহ্নত করতে পেরেছে তদন্ত কমিটি। ফাঁস এড়াতে তিন সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া প্রশ্নপত্র তৈরির কম্পিউটারে ইউসবি পোর্ট-কেবল বিচ্ছিন্ন, প্রিন্টার উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতরে স্থানান্তর, সিসি ক্যামেরা দিয়ে মনিটরিং করার সুপারিশ করা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখার তালাচাবি পরিবর্তন, প্রশ্নপত্র কম্পোজের কাজে নিয়োজিতদের বোর্ড থেকে নির্ধারিত পোশাক দেয়ার সুপারিশ করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান ও বোর্ডের সচিব আবদুল হক তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, যাদের বদলি করা হয়েছে তারা সরাসরি জড়িত নয়, তবে তাদের দায়িত্বে অবহেলা ছিল। সচিব বলেন, অনেকেই গোপনে বেসরকারী কারিগরি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। প্রশ্ন ফাঁস হলে তাদের লাভ আছে। কারিগরি বোর্ডে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য একটি সিন্ডিকেট সক্রিয়। বোর্ডের কিছুৃ কর্মকর্তা-কর্মচারী সিন্ডিকেটের সদস্য হলেও এর সঙ্গে আছে বাইরের ব্যক্তিরাও। এদের সকলকে চিহ্নিত করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কাজ করছে।
×