ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঈদের আগেই ফিরছেন মালয়েশিয়ায় উদ্ধার ৭১৬ বাংলাদেশী

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১১ জুলাই ২০১৫

ঈদের আগেই ফিরছেন মালয়েশিয়ায় উদ্ধার ৭১৬ বাংলাদেশী

এইচএম এরশাদ, কক্সবাজার ॥ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা আসন্ন ঈদ-উল-ফিতরের আগে মালয়েশিয়ায় উদ্ধার হওয়া ৭১৬ জন বাংলাদেশীকে পর্যায়ক্রমে দেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। গত বুধবার মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরেন মানব পাচারের শিকার ৯৬ জন বাংলাদেশী। বৃহস্পতিবার রাতেও মালয়েশিয়া থেকে আরও ৯৪ জন বাংলাদেশীকে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। ৯৪ জনকে বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের ‘বিজি ০৮৭’ ফ্লাইট বৃহস্পতিবার রাত আটটায় হযরত শাহজালাল (রহ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদ ও সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত ১২টার দিকে বিমানবন্দর ত্যাগ করেন ওইসব বাংলাদেশীর। সরকারের সহযোগিতায় থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার কারাগার থেকে নতুবা ওই দেশ দুটির সাগর উপকূল থেকে উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশী নাগরিকদের দেশে ফেরত আনার কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশী যুবক-কিশোরদের পর্যায়ক্রমে সরকার দেশে ফিরিয়ে আনছে দেখে প্রতিবেশী দেশে পাচার হওয়া অন্যরাও ফিরে আসবে এ আশায় বুক বেঁধেছে নিখোঁজ যুবক-কিশোরদের স্বজনরা। গত বুধবার ফ্লাইটে দেশে ফেরত আসা কক্সবাজারের সাত যুবক ও কিশোর নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে এসেছেন। মানবপাচারের গডফাদার উখিয়ার সোনাইছড়ির ইসলাম মিয়ার পুত্র শামসুল আলম সোহাগের সিন্ডিকেট সদস্য ঈদগাঁওর দালাল জাফল আলম বিলুর মাধ্যমে তারা অপহরণ ও পরবর্তীতে মালয়েশিয়া পাচারের শিকার হয়েছিল। বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজার সদরের জালালাবাদে নিজ নিজ ঘরে ফিরে সাত কিশোর ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় পাচার হয়ে যাওয়ার পথে দীর্ঘ তিন মাসের নরক যন্ত্রণার বর্ণনা দেয় প্রতিবেশীদের কাছে। এসব শুনে স্থানীয়রা ক্ষোভে ফেটে পড়ছেন দালালের বিরুদ্ধে। জানা যায়, জালালাবাদ পূর্ব ফরাজি পাড়ার বোরহান ও রবি উল্লাহকে গত এপ্রিল মাসে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দেয় ঈদগাঁও এলাকার চিহ্নিত মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য জাফর আলম বিল প্রকাশ বিল দালাল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা বোরহান ও রবিউল জানায়, বলীখেলায় নিয়ে যাওয়ার নাম করে তাদের ঈদগাঁও বাস স্টেশনে নিয়ে যায় দালাল বিল। এরপর জোর করে চট্টগ্রাম নিয়ে গিয়ে দালালের বস্ নামে খ্যাত শামসুল আলম সোহাগের টোকেনে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে বোটে তুলে দেয়া হয়। লক্কর-ঝক্কর একটি কাঠের বোট চট্টগ্রাম থেকে শতাধিক মালয়েশিয়াগামী যাত্রী নিয়ে সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থানরত বড় জাহাজে তুলে দেয়। সেখানে ১৫ দিন অবস্থান করে আরও সাত শতাধিক যাত্রী বোঝাই করে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় জাহাজটি। সাগরে এক সপ্তাহ চলার পর থাইল্যান্ডের জলসীমায় এসে হঠাৎ করে বর্ডার গরম জানিয়ে জাহাজ ফেলে স্পিড বোট নিয়ে পালিয়ে যায় পাচারকারী দালালরা। স্পিডবোটটি তাদের জাহাজের সঙ্গেই ছিল। যাওয়ার সময় জাহাজের ইঞ্জিন বিকল করে দেয়ায় সাগরে ভাসতে থাকি আমরা। অবশেষে থাইল্যান্ডের নৌবাহিনী উদ্ধার করে সে দেশের কারাগারে পাঠায়। সেখান থেকে বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় বিমানে তুলে দেয়া হলে বুধবার বিকেলে ঢাকা শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছি। বৃহস্পতিবার সকালে বাড়িতে ফিরে আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত ৭ যুবক ও কিশোর। ট্রলারে অবস্থানকালীন খাদ্য-পানি না দিয়ে মানব পাচারকারীরা অমানবিক নির্যাতন করেছে বলে জানায় কিশোর রবি ও বোরহান। এ সময় প্রতিবাদ করায় অনেক নিরীহ লোককে সাগরে নিক্ষেপ করেছে দালাল চক্রের সদস্যরা। এদিকে পূর্ব ফরাজি পাড়ার মৃত কবির আহমদের পুত্র মানব পাচারকারী চক্রের অন্যতম সদস্য জাফর আলম বিলুর বিরুদ্ধে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। দালাল বিলু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেলেও ঈদগাঁও পুলিশ বিলু দালালের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এদিকে গত ৮ জুলাই বুধবার বিশেষ ফ্লাইটে থাইল্যান্ড থেকে ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ৯ জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে নিজ বাড়িতে আসতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত তারা। সম্প্রতি মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে গণকবরের সন্ধান মিললে পাচার হওয়াদের আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এদের অনেকের খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, শুধু ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সাগরপথে স্বপ্নের মালয়েশিয়া পাচার হওয়া ব্যক্তির চিন্তায় মগ্ন ছিলেন অসংখ্য পরিবারের গৃহকর্তাগণ। সম্প্রতি থাই সাগর উপকূলে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশীদের ফেরত পাঠাতে থাইল্যান্ড সরকার বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতা চাইলে সরকার উদ্ধার হওয়াদের তালিকা স্ব স্ব এলাকার পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে দেখেন। পুলিশ তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বাংলাদেশী নাগরিকদের সঠিক পরিচয় সংবলিত প্রতিবেদন প্রেরণ করে। পুলিশের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ফিরে আসা উক্ত সাত জন হচ্ছে জেলা সদরের ঈদগাঁও মধ্যম শিয়াপাড়ার আজহার মিয়ার পুত্র আবদুল আজিজ, ইসলামাবাদ গজালিয়ার নূরুল হকের পুত্র জাহেদুল ইসলাম, জালালাবাদ পূর্ব ফরাজী পাড়ার শামসুল আলমের পুত্র বোরহান উদ্দীন, পূর্ব ফরাজী পাড়ার ছগির আহমদের পুত্র রবিউল আলম, পশ্চিম পোকখালী ফরাজী ঘোনার খলিলুর রহমানের পুত্র রবি, পশ্চিম পোকখালীর খোরশেদ আলমের পুত্র নুর নবী, ইসলামপুর হাজিপাড়ার মোঃ হারুনের পুত্র মান্নান ও ভারুয়াখালী বড় চৌধুরী পাড়ার বদিউজ্জামানের পুত্র ছাবের আহমদ। থাইল্যান্ড থেকে ফিরে আসারা জানান, তারা দালালচক্রের নির্যাতন, গভীর সমুদ্রে প্রতিবাদমুখর বহু যাত্রীকে চোখের সামনে সাগরে নিক্ষেপ করা, অনাহারে ও অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করতে দেখেছে। ওইসব চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠলে এখনও তাদের চোখে ঘুম আসে না। নাড়িছেঁড়া পুত্রদের অবশেষে সরকারের সহায়তায় ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা স্বজনরা। তারা ফিরে আসায় প্রতিবেশী পাচার হওয়া অন্যরাও ফিরে আসবে এ আশায় বুক বেঁধেছে নিখোঁজ যুবক-কিশোরদের স্বজনরা। বদলি ঠেকাতে দারোগার তদ্বির ॥ কক্সবাজার সদর মডেল থানাধীন ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের টুআইসি মোর্শেদ আলমকে বদলি করা হয়েছে। বদলির আদেশ কক্সবাজার সদর থানায় পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন ওসি (তদন্ত) বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী। তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ মিনহাজ মাহমুদকে বদলি করা হলেও তিনি বদলির আদেশ ঠেকাতে দৌড়ঝাঁপ ও ব্যাপক তদ্বির করে চলছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগে জানা যায়, গত বছর সেপ্টেম্বরে ঈদগাঁও পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে যোগ দিয়েই বহমুখী ধান্ধায় জড়িয়ে পড়েন এস আই মিনহাজ। সখ্য গড়ে তুলেন মানবপাচারকারীদের সঙ্গে। পুলিশের গোপন মদদ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে কাজ চালিয়ে গেছে দালাল চক্র। মানব পাচার, ইয়াবা পাচার, বলীখেলার নামে জুয়ার আসর বসানো ও ব্যাপক চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ঘুষ ও অন্যান্য অনৈতিক আয় লেনদেনের ক্ষেত্রে যেন কোনভাবে হাতছাড়া না হয়, এ জন্য টাকা কলেক্শানে মিজান নামে এক রাইটারকে ব্যবহার করেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, এসআই মিনহাজকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ইসলামপুর জুমনগরে জঙ্গী কারখানা গড়ে তুলেছে আরএসও ক্যাডাররা। এক দালাল গ্রেফতার ॥ কক্সবাজারের চকরিয়ায় অভিযান চালিয়ে শীর্ষ মানবপাচারকারী ওসমান গণিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে খুটাখালী মেধাকচ্ছপিয়া এলাকায় পুলিশ এ অভিযান চালায়। ধৃত দালাল ওসমান ওই এলাকার জয়নাল আবেদিনের পুত্র। চকরিয়া থানার ওসি প্রভাষ চন্দ্র ধর বলেন, গ্রেফতারকৃত ওসমান গনির বিরুদ্ধে মানবপাচারের অভিযোগে থানায় মামলা রয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে হত্যা ও বায়তুশ শরফ নামের প্রতিষ্ঠানের জায়গা জবর দখলের অভিযোগেও কয়েকটি মামলা আছে। ধৃত শামসুলকে কক্সবাজারে না নেয়ার তদ্বির ॥ চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় গ্রেফতার হয়ে জেলে যাওয়া মানবপাচারের গডফাদার উখিয়ার সোনাইছড়ির ইসলাম মিয়ার পুত্র শামসুল আলম সোহাগকে কক্সবাজারে রিমান্ডে না আনতে পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের টাকায় ম্যানেজ করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে সম্প্রতি ধৃত শামসুল আলম সোহাগ মালয়েশিয়ায় মানবপাচার কাজে বড়মাপের গডফাদার। তার রয়েছে দেশব্যাপী মানবপাচারকারী সিন্ডিকেট। ওই শামসুল আলমের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়া বহু যুবকের খোঁজ এখনও মিলেনি। বড় দালাল শামসুল আলমকে উখিয়া অথবা কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া হলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা তার উপর হামলা চালাতে পারে, নতুবা মানবপাচার সংক্রান্ত বহু তথ্য উদঘাটন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পুলিশী রিমান্ডে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া ভিত্তিক অজানা তথ্যসহ থলের বিড়াল বেরিয়ে অসতে পারে সন্দেহে মানবপাচারের গডফাদার শামসুল আলম সোহাগকে কক্সবাজারে পুলিশের হাতে তুলে না দিতে অঢেল টাকা খরচ করে চলছে গডফাদার শামসুলের পক্ষে জনৈক ধনাঢ্য ব্যক্তি।
×