ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজিজুর রহমান

জনসংখ্যা বিস্ফোরণ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ১১ জুলাই ২০১৫

জনসংখ্যা বিস্ফোরণ  প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

বিশ্বের জনসংখ্যা ৭১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে কয়েক বছর আগে। এই সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৮০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। অথচ অর্ধশতাব্দীকাল আগেও বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২৫০ কোটি। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৮০৪ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। এই সংখ্যা দ্বিগুণ হতে সময় লেগেছিল ১২৩ বছর। অর্থাৎ ১৯২৭ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ কোটিতে। এরপর মাত্র ৩২ বছরে ১৯৫৯ সালে বেড়ে ৩০০ কোটিতে পৌঁছায়। ১৫ বছর পর ১৯৭৪ সালে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০০ কোটিতে। বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটিতে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আরও কম। মাত্র ১৩ বছরে ১৯৮৭ সালে সংখ্যাটি ৫০০ কোটিতে পৌঁছায়। এরপর প্রতি ১২ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা বেড়েছে ১০০ কোটি করে। ১৯৯৯ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০০ কোটিতে আর ২০১১ সালে তা ৭০০ কোটিতে পৌঁছায়। এই হারে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১ হাজার কোটি এবং চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ ২১০০ সালে গিয়ে দাঁড়াবে ১ হাজার ১০০ কোটিতে। বিস্ফোরণের মতো জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দায়ী মূলত অশিক্ষা, দারিদ্র্য, অসচেতনতা, পিছিয়ে পড়া সমাজ ব্যবস্থা; সেইসঙ্গে কুসংস্কার, কুশিক্ষা, ধর্মীয় মূর্খতা এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা ও অবহেলা। এ সমস্যাগুলো নিয়েই এগিয়ে যেতে হচ্ছে বিশ্বকে। আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যত পৃথিবীকে বাসযোগ্য করতে হলে জনসংখ্যাকে পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতার মধ্যে সীমিত রাখা অতি জরুরী। এই বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার কিছু ইতিবাচক অর্জনও আছে। ১৯৫০ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ বছর। ১৯৫০ সালে প্রতি হাজারে শিশু মৃত্যুর হার ছিল ১৩৩ জন, এখন তা কমে ৪৬ জনে দাঁড়িয়েছে। তারুণ্যের জয়জয়কার এখন বিশ্বজুড়ে। বিশ্বে এখন ২৫ বছরের কম বয়সী তরুণের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি হলেও এই বৃদ্ধিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এই জনসংখ্যায় নারীর পূর্ণ ক্ষমতায়ন ঘটলে সমাজের সর্বস্তরে বৈপ্লবিক অগ্রগতি হবে। আর নতুন প্রযুক্তির সহায়তায় তরুণ প্রজন্ম পাল্টে দেবে বিশ্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ২১০০ সালে জনসংখ্যা ১ হাজার ১০০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছলেও এই জনগোষ্ঠীর খাদ্য যোগানোর জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি জমি বিশ্বের বুকে রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বা জনসংখ্যার বিস্ফোরণ কোন কোন দেশের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিকই আবার জনসংখ্যা কমে যাওয়াও কোন কোন দেশের ভবিষ্যতের জন্য সর্বনাশের বার্তা দিচ্ছে। বাড়তি জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করে একটি জাতিকে যে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড় করানো যায় তার এক বিরল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৯৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট ভূখ- বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম। ২০২৫ সালে এ দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭ কোটি ৭৯ লাখে। বর্তমানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৯৩ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭ শতাংশ। দেশে পুরুষের গড় আয়ু ৬৫.৭ বছর এবং নারীর ৬৮.৩ বছর। ১৯৭০ সালের তুলনায় বর্তমানে দেশের প্রজনন হার ৬০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে ’৭০-এর দশকের চেয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার হ্রাস, বয়স কাঠামো, কম বয়সী জনগোষ্ঠীর প্রাধান্য এবং এক শ্রেণীর সক্ষম দম্পতির মধ্যে অপেক্ষাকৃত ধীরগতিতে প্রজনন হার হ্রাসের কারণে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৃহত্তম প্রজননক্ষম অংশ হচ্ছে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী। এরা মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে এদের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। বাল্যবিবাহ ও অল্প বয়সে গর্ভধারণের প্রবণতাও এদের মধ্যে বেশি। এদেশে পরিবারের আকার ছোট হচ্ছে; কিন্তু সংখ্যা বাড়ছে। এর কারণ শিশুর মৃত্যুর হার কমছে। পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা সর্বোচ্চ ২০ কোটি ১৯ লাখ হয়ে তারপর আবার ধীরে ধীরে কমে ২১০০ সালে ১৮ কোটি ২২ লাখে নেমে আসবে। এই জনশক্তিই বদলে দিচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে পুঁজির প্রাথমিক স্বল্পতা কাটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে। একই পথে রয়েছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনাসহ স্বল্পোন্নত ২৬টি দেশ। যাদের প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি। গত ৬ দশকে ২০০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা বেড়েছে ভারত ও চীনে। সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে এই রাষ্ট্র দুটি এগিয়ে যাচ্ছে শিল্প বিপ্লবের দিকে। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ বাংলাদেশকে কত উচ্চতায় নিয়ে গেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’-এর প্রতিবেদনে। গত ৫ বছরে বাংলাদেশের জিডিপির ধারাবাহিক বৃদ্ধির প্রশংসা করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশটি দরিদ্র জনসংখ্যার হার কমিয়ে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, চলতি উদ্বৃত্ত মুদ্রার রিজার্ভ, রাজস্ব আহরণ, কর প্রবৃদ্ধির হার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) ও টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি পেয়েছে।’ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করে পত্রিকাটি বলছে, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করেছিলেন, সেই দেশটি এখন অর্থনৈতিকভাবে তার সামর্থ্যরে স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। লেখক : গবেষক
×