ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

স্যুয়ারেজ ড্রেনের পাশেই হাঁড়িপাতিল, টিকটিকি তেলাপোকার দৌড়ঝাঁপ

রাজধানীর নামীদামী হোটেল-রেস্তরাঁর ভয়াবহ চিত্র

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১১ জুলাই ২০১৫

রাজধানীর নামীদামী হোটেল-রেস্তরাঁর ভয়াবহ চিত্র

আজাদ সুলায়মান ॥ টিকটিকি ও তেলাপোকার দৌড়ঝাঁপ। মাছির গুঞ্জন, মশার ভনভনানি। কর্দমাক্ত মেঝে। পাশের টয়লেটের দরজাটাও খোলা। সেখান থেকে আসে উটকো গন্ধ। উপরে আছে পাশের একটি ছাউনি। সেখান থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি। পানি পড়ে তো, অন্য কোথাও নয়, ঠিক যেখানটায় রাখা হয় খাবারের হাঁড়ি। স্যুয়ারেজ ড্রেনের পাশেই হাঁড়ি পাতিল। এটি নাখালপাড়ার ঐতিহ্যবাহী হাজী হোটেলের রান্নাঘরের চিত্র। যার বাইরের চিত্রটা দেখেই মনে হয় এটা আসলেই একটা উন্নতমানের রেস্টুরেন্ট। কিন্তু এর রান্নাঘরের ভেতরের এমন নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখে বিস্মিত হয়ে পড়েন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ হেলাল উদ্দিন। রাজধানীর নাখালপাড়ার মতো শিল্প ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার এই রেস্টুরেন্টটি গত ত্রিশ বছর ধরে চলছে। এটি ওই এলাকার প্রথম হোটেল হিসেবে চিহ্নিত। ওই এলাকার বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অফিস ও পথচারীদের প্রথম চয়েস এই হাজির রেস্টুরেন্ট। বাইরে পরিপাটি চিত্র যার, ভেতরের চিত্রটা এতটা কুৎসিত ও নোংরা সেটা দেখার পর যারা খাবার খাচ্ছিলেন তাদেরও বমির ভাব। গত রবিবার ইফতারের আগ মুহূর্তে যখন গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে র‌্যাব-২এর অভিযান চালানো হয়- তখন বিপুলসংখ্যক কৌতূহলী পথচারী সেখানে ভিড় জমায়। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যে শুধু রান্নাঘরেই তা নয়। যিনি রান্না করেন, যিনি খাবার পরিবেশন করেন তাদের হাত-পা আরও নোংরা। হাতের নখ এতই বড় যে, তার ভেতরে ময়লার স্তূপ বেশ দূর থেকেই চোখে পড়ে। তাদের শরীরেও রয়েছে দাউদ, খুজলির মতো সংক্রামক ব্যাধি । এমনই অবিশ্বাস্য নোংরা আর অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় চলছে রাজধানীর নামীদামী হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলো। সাধারণ থেকে নামীদামী প্রায় সব খাবার হোটেলেরই চিত্র এটি। রমজানের শুরুতে পৃথক তিনটি অভিযানে ধানম-ি, নাখালপাড়া ও তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বিশটি হোটেলের মধ্যে সব কটাতেই এমন চিত্র দেখতে পান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, এদের সবাইকে জরিমানা করা হয়েছে। কেউ-ই বাদ যায়নি। এমনকি তেজগাঁও এলাকার শাকভাত নামের একটি রেস্টুরেন্টের পরিবেশ মানসম্মত ছিল, তারপরও ভেতরে যে জায়গাটায় খাবার রাখা হয় সেখানে কিছুটা দোষ ছিল। এজন্য এটাকেও মাত্র ৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। যাতে ভবিষ্যতে আর এ দোষটাও না থাকে। জানা যায়, প্রতিবারের মতো এই রমজানেও র‌্যাবের একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার হোটেল রেস্টুরেন্টে অভিযান চালায়। প্রতিটি অভিযানেই ধরা পড়ে রান্নাঘরের নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের চিত্র। এসব অভিযানে দেখা যায় অধিকাংশ রান্নাঘরেরই চিত্র একই প্রকৃতির। অভিযানের সময় দেখা যায়, রাজধানীর অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও নামীদামী হিসেবে পরিচিত সুপারস্টার হোটেলকেও একই দোষে জরিমানা করা হয়েছে। মঙ্গলবার ধানম-িতে নোংরা পরিবেশ ও ভেজাল ইফতার বিক্রির দায়ে স্টার হোটেল এ্যান্ড কাবাবসহ (রেস্টুরেন্ট) গ্রিল হাট নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ধানম-ির বিভিন্ন এলাকায় দেশের মান নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড এ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন। এ সময় সাংবাদিকদের আদালত পরিচালনাকারী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল কালাম জানান, ঢাকা সিটি কলেজ সংলগ্ন স্টার হোটেল এ্যান্ড কাবাবকে (রেস্টুরেন্ট) ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে । কারণ হোটেলটির খাবার তৈরির স্থান নোংরা এবং ভিতরে বাসি তেল ও খাবার মজুদ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি এই বাসি খাবার ও ইফতার আইটেম তারা ক্রেতাদের কাছে বিক্রির জন্য রেখেছেন। এ অপরাধে বিশুদ্ধ খাদ্য অধিকার আইনে হোটেল কর্তৃপক্ষকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করেন ধানম-িতে পিৎজা হাটের একটি আউটলেটে। সেখানে উল্লেখযোগ্য কোন অপরাধ না পেলেও, খুঁটিনাটি ভুলত্রুটি পাওয়াতে তাদের ম্যাজিস্ট্রেট সতর্ক করে দেন। একই দিন কলাবাগানের গ্রিল হাট নামে একটি ফাস্ট ফুডের দোকানের সামনে ইফতারের বিভিন্ন আইটেম পরীক্ষা করে দেখা যায় সেখানে বাসি ইফতারি রয়েছে। পরে ভেতরে ঢুকে ম্যাজিস্ট্রেট রান্নঘরের নোংরা পরিবেশ, টয়লেটের কাছেই রান্না ঘর ও স্টাফদের থাকার জায়গা আবিষ্কার করেন। দোকানে বাসি পাউরুটিও বিক্রির জন্য সাজানো ছিল। সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পরে ভোক্তা অধিকার আইনে দোকান কর্তৃপক্ষকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে দুই মাসের জেল দেয়া হয়। এ অবস্থায় দোকান কর্তৃপক্ষ নগদ ২০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে কারাদ- থেকে অব্যাহতি পায়। সুপারস্টারের মতো নামীদামী হোটেলে দিনরাত ক্রেতার ভিড় থাকে। রাজধানীতে রয়েছে এর বেশ কয়েকটি শাখা। প্রতিটি শাখার বাইরের চিত্র খুবই পরিপাটি ও মনোরম। ভেতরের বসার স্থানও বেশ ঝকমকে। সুন্দর সাজানো গোছানো চেয়ার টেবিল ও থালা বাসন। এখানে বসলেই খাবারের রুচি হয়। কিন্তুু কয়েক গজ দূরেই রান্নাঘর ও অন্দরমহলের যে চিত্র সেটা দেখলেই আতকে ওঠার মতো। রান্না ঘরে যে জায়গাটায় ডেক ডেকচি রাখা হয়, যেখানে খাবার রান্না ও সংরক্ষণ করে রাখা হয়, সেটার মান কোনটাই গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবি করেন ম্যাজিস্ট্রেট হেলাল উদ্দিন। এসব হোটেলে অভিযানের পর কয়েকজন ক্রেতার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কি জানতে চেয়েছিলাম। বিমানের পাইলট আখতারুজ্জামানের বাসা বনানীতে। বাসার সামনেই স্টার কাবাব ও হোটেল। সেখানে তিনি অবসরে মাঝে মাঝে দুপুরে বিরিয়ানী খেতে যান। পরিবারের সদস্য তো বটেই বন্ধুদেরও নিয়ে সেখানে আপ্যায়ন করেন। বেশ গর্র্ব করেই সেখানে অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন। বলতেন, খান এখানকার খাসির বিরিয়ানিটা খুবই ভাল। বোরহানিও মজাদার। সে জন্যই এখানে কাস্টমারদের লাইন লেগেই থাকে। সিট মিলেনা। কিন্তু তাঁর আপ্ততৃপ্তি টুটে গেছে, যখন টিভিতে দেখলেন- র‌্যাব এই নামীদামী খাবার হোটেলটির ধানম-ি শাখায় হানা দিয়ে হাতেনাতে নোংরা পরিবেশে খাবার রান্নার প্রমাণ পেয়েছে। টেলিভিশনে এ নিউজ দেখে তার বমির অবস্থা। নিজের কাছেই প্রশ্ন- তাহলে এত দিন এমনই সব ভেজাল সব খাবার খেয়েছি। বিত্তবান পরিবারের কন্যা ইউল্যাবের ছাত্রী মিলির পছন্দ বাসার খাবারের চেয়ে বাইরের ফাস্ট ফুড। আর সুপার স্টারের কাবাব। ধানম-ির ক্যাম্পাসে যে দিন ক্লাসে যান সেদিন দুপুরে সহপাঠীদের নিয়ে লাইন ধরেন ওখানকার সুপারস্টারে। অনেকক্ষণ অপ্ক্ষোর পর যখন সিট পান তখনই আগে এক গ্লাস বোরহানি গোগ্রাসে পান করেন। তারপর বিরিয়ানি। তিনিও যখন দেখলেন- সেদিন ধানম-ির শাখার এ হোটেলটিতেও নোংরা পরিবেশে রান্না হয়-তখন ঘৃণায় মুখ থেকে থুথু ফেলে বলেছেন-সামনে এত সুন্দর বসার স্থান। তাদের মতো এমন শত সহস্র কাস্টমার এখন অবাক হচ্ছেন-স্টারের মতো এত নামীদামী রেস্টুরেন্টের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে আর কোথায় ভাল মিলবে। শুধু স্টার কেন? র‌্যাব এ পর্যন্ত রাজধানীতে একের এক অভিযান চালিয়ে ফাঁস করেছে তাদের ব্যবসার মূল গোমর। এ সব প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় রেস্টুরেন্টগুলোর খাবারের গুণমতমানের চেয়ে রসনাবিলাসের ওপর বেশি জোর দেয়া হয়। বাইরের চাকচিক্যময় ডেকোরেশন, ভেতরে বসার জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বাহারি প্লেট ও গ্লাসে সাজানো টেবিল। সেখানে বসলেই ভোজন রসিকরা নিজেদের সার্থক মনে করে। কিন্তু তারা রান্নাঘরের পরিবেশ কতটা নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর সেটা কস্মিনকালেও উঁকি দিয়ে দেখেননি। একবার যদি তারা কৌতূহল বশতও কিচেনের দিকে নজর দিতেন তাহলেও আতকে উঠতেন।
×