ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলামী চিন্তাবিদ গবেষকদের অভিমত

যাকাত ধনীর সম্পদে গরিবের হক, উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ১২ জুলাই ২০১৫

যাকাত ধনীর সম্পদে গরিবের হক, উদ্দেশ্য দারিদ্র্য বিমোচন

জসিম উদ্দিন ॥ যাকাত ধনীর সম্পদে গরিবের অধিকার। তা গরিবের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে দায়িত্বমুক্ত হবে ধনী। অবশ্যই এর উদ্দেশ্য হবে দারিদ্র্য বিমোচন। এটাই ইসলামের বিধান বলে মত দেন ইসলামী গবেষকরা। তবে, এর কোন ভিন্ন পন্থা ইসলাম সমর্থন করে না বলেও জানান তাঁরা। যাকাতদানের নামে লোক দেখানোর উদ্দেশে মাইকিং করে লোক ডেকে নেয়া এবং পদদলিত হয়ে হতাহতের কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। একে ‘হত্যাকা-’ অভিহিত করে এসব হত্যার বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তাঁরা। প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ভোরে ময়মনসিংহ শহরের শামীম তালুকদারের নূরানী জর্দা ফ্যাক্টরিতে যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মারা যান ২৭ জন। আহত হন প্রায় অর্ধশত নারী-পুরুষ। এ ধরনের ঘটনা প্রায় বছরই বাংলাদেশে ঘটে থাকে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রশীদ জনকণ্ঠকে বলেন, যাকাত কাকে দিতে হবে সূরা তওবার ৬০ নম্বর আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত, ওই আয়াতে বর্ণিত যাকাত গ্রহণকারীর আটটি গুণ হলো নিঃস্ব ব্যক্তি, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি, যাকাত আদায়কারী (সদকা ভা-ার পরিচালনাকারী), সদ্য ইসলাম গ্রহণকারী, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহ্র পথে জিহাদকারী ও মুসাফির। এর যে কোন একটি যে মুসলমানের মধ্যে পাওয়া যাবে, তিনি যাকাত গ্রহণ করতে পারেন। যাকাত দেয়ার প্রচলিত প্রক্রিয়া সম্পর্কে অধ্যাপক আব্দুর রশীদ বলেন, ইসলাম তিনটি বিষয়ের ওপর যাকাত ফরজ করেছে। তা হলো সোনা, রুপা ও টাকা। আর প্রত্যেকটির যাকাত এসব উপাদান দিয়ে দেয়াই উত্তম। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, সোনার যাকাত সোনা আর টাকার যাকাত টাকায় পরিশোধ করা ভাল। তবে, টাকা দিয়ে পরিশোধ করলেই যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হাসিল হবে। তিনি বলেন, যাকাত হলো আল্লাহ নির্ধারিত গরিবের অধিকার আর ধনীর দায়িত্ব হলো তা তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া। যাকাত হিসেবে কাপড় দেয়ার অধিকার কে দিয়েছে? এই কাপড় থেকে বিক্রেতাও লাভ করে; যা মূলত যাকাতের টাকা। দরিদ্রের অধিকার। নিম্নমানের এসব কাপড় দিয়ে তো দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। বরং আয়বর্ধক এমন কিছু দিতে হবে যাতে যাকাত গ্রহণকারী নিজেকে এস্টাবলিশ করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কোন দুস্থ লোককে সেলাই মেশিন বা দুধের গাভি দেয়া যেতে পারে। বর্তমান যাকাত দেয়ার পদ্ধতি সরাসরি কোরান, সুন্নাহ এবং ইসলামী শরিয়তের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। অধ্যাপক রশীদ বলেন, এখন যেভাবে লাইন ধরিয়ে যাকাত দেয়া হয়; ইসলামে এ ধরনের যাকাত দেয়ার চর্চা নেই। ইসলামের নিয়ম হলো ধনী যাকাতের টাকা নিয়ে গরিবের বাড়ি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, দরিদ্র তা গ্রহণ করে ধনীকে তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করত। যাকাত দেয়ার পদ্ধতিটা হলো ডান হাত যাকাত দিলে বাঁ হাত তা জানবে না, এতটাই গোপনীয়তা অনুসরণ করা হবে। এখন হয়েছে উল্টো। তিনি বলেন, ধনীরা এখন গরিবকে অপমান করার জন্য তার বাড়ি ডেকে আনে। লাইন ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। ফটোসেশন করা হয়। আর এই যাকাত নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে মানুষ মারা যায়। এটা হত্যাকা-। এর বিচার হওয়া উচিত। শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ বলেন, যাকাত দেয়ার নামে ৫০ হাজার টাকায় ১০০ শাড়ি না কিনে পুরো টাকাটাই একজন গরিবকে দেয়া উচিত; যাতে সে ওই টাকা বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হতে পারে। পরের বছর ওই ব্যক্তি নিজেই যেন যাকাত দিতে পারে। মিরপুরের জামিউল ফাত্তআহ খাজা মসজিদের খতিব মাওলানা মুহাম্মদ মীর হুসাইন বলেন, লোক দেখানোর উদ্দেশে গরিবদের দাঁড় করিয়ে শাড়ি-কাপড় বিতরণ করলে যাকাত আদায় হবে না। শরিয়তের বিধান হলো, যাকাত যিনি পাবেন তার কাছে এটা পৌঁছে দেয়া। ধনবান ব্যক্তিকে নিজের ব্যবস্থাপনায় এই যাকাত পৌঁছে দিতে হবে। যাকাত দেয়ার বর্তমান পদ্ধতির কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। যাদের কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে এদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। তিনি বলেন, পবিত্র কোরানে সূরা নিসার ৯৩ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে- ‘কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মুমেনকে হত্যা করলে তার ঠিকানা জাহান্নাম।’ এদিকে সঠিক পদ্ধতিতে যাকাত আদায়ের আহ্বান জানিয়ে সরকারী যাকাত বোর্ডের দেয়া বিবৃতিতে বলা হয়, পবিত্র কোরানের নির্দেশনামতে যাকাত বিতরণ নিশ্চিত করতে ‘সরকারী যাকাত ফান্ডে’ আপনার যাকাত দিন। যাকাত ফান্ড অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুযায়ী গঠিত ‘সরকারী যাকাত ফান্ড’ কোরান নির্দেশিত আটটি খাতে এসব অর্থ ব্যয় করে থাকে।
×