ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

কিছু অর্বাচীনের জন্য লাখ লাখ তরুণ শিক্ষার্থীর এই দুর্ভোগ

জাকারিয়া স্বপন

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৩ জুলাই ২০১৫

জাকারিয়া স্বপন

১. লেখালেখি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলা। কারণ বাংলাদেশ এখনও এমন জায়গায় এসে পৌঁছায়নি যে, লেখালেখি করে সমাজ পরিবর্তন করে ফেলা সম্ভব। আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমসে কিংবা ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশ হলে কিংবা একটি সম্পাদকীয় ছাপা হলে সমাজে এবং সরকারের ভেতর যে তোলপাড় হয় বাংলাদেশে তার কিছুই হয় না। উপরন্তু লেখার বিষয়বস্তুকে দূরে রেখে ব্যক্তি লেখককে রাজনৈতিকভাবে শায়েস্তা করার তোড়জোড় শুরু হয়। এটাই বাংলাদেশ। সব সময় যে সরকার এই কাজটি করে তা কিন্তু নয়। সরকারের আশপাশে অনেক স্বার্থপর গোষ্ঠী থাকে, যাদের কাজই হলো সরকারকে দেখানো তারা খুব ভাল কাজ করছে। এবং সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে তারা সীমাহীন সীমা ক্রস করে যান। একটা সময় গিয়ে সরকারকে বিব্রত করেন। আবার অনেক লেখকও যে একচোখা লেখা লেখেন না তাও নয়। তারাও কারও না কারও মতকে সামনে আনার জন্য উঠেপড়ে লেগে থাকেন। উদ্দেশ্য একটাই, সরকারের কিছু সুবিধা নেয়া। লেখালেখি করে সমাজ পরিবর্তন করতে বাংলাদেশে অনেকটা পথ যেতে হবে। বাংলাদেশে যে লেখালেখি করে সমাজের তেমন একটা পরিবর্তন হয় না, তার মূল কারণ, আমরা এখনও বুদ্ধিবৃত্তিক জাতি হয়ে উঠতে পারিনি। আমরা মনে মনে স্বপ্ন দেখি কিংবা ভাবার চেষ্টা করি যে, আমরা মনে হয় ওপরে উঠে গেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এখনও লাঠিই সবচেয়ে উত্তম পন্থা। আমরা গোষ্ঠী হিসেবে এখনও লাঠির যোগ্যতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সম্পাদকীয় কিংবা কলাম প্রকাশ হলে সমাজের মানুষ লজ্জা অনুভব করে, যে ইস্যুটা নিয়ে কলাম লেখা হয়েছে সেটাকে ঠিক করার চেষ্টা করে। এটাই সভ্য সমাজের বোঝাপড়া। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক উল্টো। যার ওপর কলাম লিখবেন কিংবা যেই ইস্যুতে কথা বলবেন সেই ইস্যুর সঙ্গে জড়িত মানুষগুলো আরও বড় গলায় সমাজে ঘুরে বেড়াবে, টিভিতে বক্তৃতা করে বেড়াবে। তাই এই সমাজে লেখার চেয়ে পেশির শক্তি বেশি। আমার যেহেতু পেশি নেই, তাই লেখাটা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি বলা যায়। তারপরেও মাঝে মাঝে লিখি, যখন মনে হয় কিছু মানুষকে তো বিষয়টি জানিয়ে যাই! ২. চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখতে পেলাম কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে কিভাবে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা এবং তাদের পরিবারগুলো ঝামেলার ভেতর পড়েছে। নিদারুণ মানসিক কষ্টে পড়েছে। যার বিজ্ঞানে পড়ার কথা তাকে দেয়া হয়েছে বাণিজ্যে, যার কলাতে পড়ার কথা তাকে দেয়া হয়েছে বিজ্ঞানে। যার ঢাকা কলেজে পড়ার ইচ্ছা তাকে না জানিয়েই রেখে দেয়া হলো নিজের স্কুল সংলগ্ন কলেজটিতেই। আমি ভর্তি হব, কিন্তু আমাকে না জানিয়েই স্কুল কর্তৃপক্ষ কিংবা যে আমার রোল নাম্বার জানে সে গিয়ে ঠিক করে দিয়েছে আমার ভবিষ্যত। ভাবতেই আমার শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কলেজে পড়া হলো প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আমি যদি ঢাকা কলেজে পড়ার সুযোগ না পেতাম তাহলে আজকে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তা হতো না। একটি কলেজ শিক্ষার্থীর জীবনকে ঠিক করে দেয়। এর ওপর নির্ভর করেই ঠিক হবে তার রেজাল্ট এবং কোন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে তার ঠিকানা। কিন্তু আমাদের কিছু মানুষের খামখেয়ালি কিংবা অজ্ঞতার জন্য কম্পিউটার নামক যন্ত্রের দোহাই দিয়ে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতকে ল-ভ- করা হয়েছে। শুধু যে ল-ভ- করেই ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়। তারা তাদের এই অপকর্মের জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জা অনুভব করেননি। মানুষের কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাননি। তারা উল্টো দাপটের সঙ্গে মিডিয়াতে বলে বেড়াচ্ছেন এগুলো ছাত্রছাত্রীদের ইনপুট ভুল। আরও বলছেন, বড় কোন কাজ করতে গেলে এমন ছোটখাটো ভুল নাকি হতেই পারে! এটা নাকি ছোটখাটো ভুল। অবস্থা বেসামাল হয়ে গেলে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য প্রেস ব্রিফিং করে ভুল স্বীকার করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। কিন্তু তাঁর আশপাশের মানুষগুলোর দম্ভ তো এখনও কমেনি। যেই বুয়েটের ওপর পুরো বিষয়টি চাপিয়ে দেয়া হলো সেই বুয়েট কর্তৃপক্ষ একটিবারের জন্য বলেনিÑ আমরা দুঃখিত। তারা বলেনি, কারণ তারা দুঃখিত নয়। তারা আমাদের সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে শিক্ষা বোর্ড থেকে কোটি টাকার চেকগুলো ঠিকই পকেটে ঢুকিয়েছে। এটা নিয়ে কিছু মিডিয়া সোচ্চার হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কারও তো কোন টনক নড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। আমরা আসলে এখনও অসভ্য জাতিতেই আছি। কিন্তু তারা অনেক স্মার্ট। তারা ধরেই নিয়েছেন আমাদের এই দুর্ভোগে তারা ফেলতেই পারেন! দেশটা তো তারা ইজারা নিয়ে নিয়েছেন, তাই না? ৩. কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত যে জটিলতা তার মূল কারণ কী আমরা তা জানি। মিডিয়াতে অনেকবার এসেছে। বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞানের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি খোঁজ নিয়ে যেটুকু জেনেছি তার মূল কারণ কতিপয় ব্যক্তির ম্যাজিক দেখানোর উচ্চাভিলাষ। তারা শেষ মুহূর্তে এসে অনলাইনে আবেদনপত্র নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং সরকারকে দেখাতে চান যে, দেশ ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। কিন্তু এই ধরনের একটি কাজ করতে গেলে যে পরিমাণ প্রস্তুতি নেয়ার প্রয়োজন ছিল তা নিতে পারেনি। এবং বুয়েটও টাকার লোভ সামলাতে পারেনি। তারাও অনুরোধে ঢেকিটা গিলতে গিয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। সব গুবলেট পাকিয়ে গেছে। এবারে পাঠকদের কিছু প্রশ্ন করি। আচ্ছা বলুন তো বুয়েট কবে থেকে সফটওয়্যার বানায়? কিংবা বুয়েটের কোন্ সফটওয়্যারটা বাংলাদেশের কোন্ সমস্যা সমাধান করেছে? একটা-দুটো উদাহরণ দিতে পারবেন কেউ? পাঠকদের বোঝার জন্য বলছি, বুয়েট কিংবা যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বাণিজ্যিক পণ্য তৈরি করা নয়। তাদের কাজ ভালভাবে ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে, গবেষণা করে ভবিষ্যতের বিশেষজ্ঞ তৈরি করা। তাদের কাজ পড়ানো এবং গবেষণা করা (যদিও সেই কাজটিই তারা ভাল করে করছে না)। বুয়েট সম্পর্কে আরও দুটো বিষয় পাঠকের জানা প্রয়োজন। বুয়েটে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ নামে একটি বিভাগ রয়েছে, যেখানে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিগ্রী দেয়া হয় (এবং এই অধমেরও বুয়েটের সেই ডিগ্রী একটা রয়েছে বটে!); তারা কখনই কোন পণ্য তৈরি করে না। পাশাপাশি বুয়েটে একটি আলাদা ইনস্টিটিউট রয়েছে, যারা বাইরের কাজ করে থাকে। তবে তাদের মূল কাজ হওয়া উচিত কনসাল্টেন্সি, পণ্য তৈরি করা নয়। অন্যের তৈরি করা পণ্য তারা যাচাই-বাছাই করে দিতে পারে। পণ্য তৈরি করা এবং তা পরীক্ষা করার ভেতর অনেক ফারাক। যে কারণে বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা পাস করে ইন্টেল, মাইক্রোসফট, সিসকো, ওরাকল, গুগল, লিঙ্কডইন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে এবং তারা কেউ বুয়েটের সেই ইনস্টিটিউটে চাকরি নিয়েছে বলে শুনিনি। কিন্তু যেই বুয়েটের এ ধরনের কাজের কোন দক্ষতা নেই তাদেরই দেয়া হয়েছে সেই কাজ, যেন ভুল-ক্রটি হলেও কেউ এটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে। এই হলো আমাদের ঔদ্ধত্য। পুরো জাতিকে আমরা বুড়ো আঙ্গুল দেখাব; কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারবে না। বুয়েটও টাকার লোভ সামলাতে পারেনি। তারাও কাজটি নিয়েছে। এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের ছেলে-মেয়েদের এমন শিক্ষাই দিয়েছে যে, আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলের গ-ি পার হয়েই বুঝে ফেলেছে এই দেশে সঠিকভাবে কিছু হয় না, আমরা সঠিকভাবে কিছু করতে পারি না। তারা তাদের এই তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েই এখানে লেখাপড়াটা শেষ করবে। তারপর যারা পারবে পঙ্গপালের মতো এই দেশ ছেড়ে চলে যাবে। তারপর আর কোনদিন এইদিকে পা বাড়াবে না। এটাই হলো আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ! ৪. বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যত পরিবর্তন আনা হয়েছে তার সবগুলো খুবই আনাড়ি সিদ্ধান্ত। ইচ্ছে হলো, চলো সব জিপিএ করে ফেলি। সারা বিশ্ব করে, আমরা না করলে পিছিয়ে গেলাম। ধুম করে চালু করে দিলাম। আজকে কারও ইচ্ছে হলো, চলো সৃজনশীল পরীক্ষা ব্যবস্থা করি; আমাদের ছেলে-মেয়েরা কোচিং সেন্টার থেকে বাইরে চলে এসে অনেক বেশি সৃজনশীল হয়ে উঠবে। করে ফেললাম। ভর্তি পরীক্ষা ডিজিটাল করতে হবে, চলো কাল থেকেই করে ফেলি। এই জাতির তো ভোগান্তি ছাড়া কিছু হয় না। তো বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ক্ষতি কী! আর আমাদের অনেকের অনেক আইডিয়া। সেগুলো বাস্তবায়িত না হলে তো আর আমরা জামার কলার নাচিয়ে বলতে পারি না যে, দেখেছেন এটা আমি করেছি! আমাদের তো কারও কারও নেতা হতে হবে! এক সময় মন্ত্রীও হতে চাই! কিন্তু কেউ ভাবে না ছাত্রছাত্রীদের ওপর এ ধরনের ইচ্ছামতো কিছু চাপিয়ে দেয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী! আমরা নিজেরা যা বিশ্বাস করি সেটাই যুক্তিতর্ক দিয়ে মানুষকে বোঝাতে থাকব এবং সেটা করে গুবলেট হলে কাউকে তো কোন জবাব দিতে হচ্ছে না। সাধারণত যে কোন পরিবর্তন আনার আগে প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন হয়। কারও একদিন ঘুম থেকে উঠে মনে হলো এটা একটা দারুণ আইডিয়া; তারপর আমরা সবাই সেটা ইমপ্লিমেন্ট করতে নেমে গেলামÑ তা হওয়াটা ঠিক নয়। যে কোন পরিবর্তনের অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। সেগুলোকে এড্রেস করার জন্য অনেক গবেষণা এবং সময়ের প্রয়োজন হয়। অনেক ক্ষেত্রে পাইলট করে ফলাফল দেখা হয়। তারপর ধীরে ধীরে সেটা প্রয়োগ করা হয়। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে তত সময় নেই। আমরা এক বছরেই সব কাজ করে ফেলতে চাই। তার কারণ হলো, আমাদের নিজেদের ছেলে-মেয়েরা তো এখানে পড়ছে না। মরে মরুক না গরিবের দল। আমার তাতে কী! ৫. বাংলাদেশে একটি বড় গোষ্ঠী দাঁড়িয়েছে, যাদের ব্যাকগ্রাউন্ড কম্পিউটার বিজ্ঞান নয়; কিন্তু তারাই সবচেয়ে বেশি ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে। চিৎকার করে সব সমস্যার ডিজিটাল সমাধান বের করে ফেলেন। এর মূল কারণ হলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি এবং তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় সাহেব যেহেতু আন্তরিকভাবে চান দেশে তথ্যপ্রযুক্তির একটি বিপ্লব হোক, তাই তাদের খুশি করার জন্য কিছু অতি চালাক মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশ শব্দটাকে ব্যবহার করে যা ইচ্ছে তাই করতে পারছেন। এটা যদি আজকে স্বাস্থ্যবিষয়ক কোন প্রোগ্রাম হতো তাহলে ডাক্তারগোষ্ঠী কিংবা ফার্মাসিউটিক্যাল প্রফেশনালরা এটাকে নেতৃত্ব দিতেন। এবং এই ধরনের ফালতু লোকগুলো এসে উটকো ঝামেলায় ফেলতেন না। আমি যতটা শুনেছি, কলেজে ভর্তি নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছে তা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী দু’জনই বিব্রত হয়েছেন। মানুষের কষ্ট এবং দুর্ভোগ তাঁদের স্পর্শ করেছে। আশা করি, এরপর কোন অর্বাচীনের পাগলামির জন্য পুরো জাতিকে এভাবে ভুগতে হবে না। ১০ জুলাই ২০১৫, ঢাকা লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং প্রধান নির্বাহী, প্রিয়.কম
×