ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

মৃতের জাগরণ

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ১৩ জুলাই ২০১৫

মৃতের জাগরণ

তোমার সমগ্র নিয়ে যখন ধেয়ে আসো, মৃত মানুষ জেগে ওঠে। সব মৃতের মৃত্যু ট্র্যাজেডি নয়, মৃতেরা অদৃশ্যে, ওদের ভাষার ধ্বনি চিরজাগ্রত। তোমাকে বলেছিলাম, আমি যখন হ্যাঁ-য়ের প্রত্যাখ্যানে না বলেছি, দিগন্তজুড়ে না প্রতিধ্বনিত (সি. পি. কাভাফিস। কনস্টানটিনোস পেটরৌ কাভাফিস। গ্রিক কবি। জন্ম ১৭ এপ্রিল ১৮৬৩। মৃত্যু ২৯ এপ্রিল ১৯৩৩। কনস্টানটিনে কাভাফি নামে গ্রিসের বাইরে পরিচিত)। সেই-কবে লেখা কবিতা (১৯০৩), ইংরেজি থেকে অনুবাদ করলে অনেকটাই এরকম, মনে পড়লো ৫ জুলাই ২০১৫ সালে, রাত দশটা ৪৬ মিনিটে। বার্লিনের শ্যোয়নেব্যার্গ জেলায় ভিটেনব্যার্গপ্লাতসের দুই পাশে দুই রাস্তা, এবং দুই রাস্তার ২৫ মিটারের মধ্যে বাস ছিল নোবেলজয়ী কবি নেলি জাকস্, লেখক ক্রিস্টোফার ইশারউড, নাট্যজন এরভিন পিসকাটোর (বারটোল্ট ব্রেখস্টের সহযোগী।)। ভিটেনব্যার্গপ্লাতস-সংলগ্ন নোলেনডোর্ফপ্লাতস (চত্বর)। নোলেনডোর্ফপ্লাতসকে নিয়েই এরিখ কার্স্টনারের বহুখ্যাত উপন্যাস, এমিলির গোয়েন্দাবাহিনী। ভিটেনব্যার্গপ্লাতস-নোলেনডোর্ফপ্লাতস থেকে দেড়-কিলোমিটার দূরে গ্রিম ভাতৃদ্বয়ের কবর। ভিটেনব্যার্গপ্লাতসেই পাশাপাশি দুটি গ্রিক রেস্তরাঁ (সাকুল্যে ২৫ মিটার দূরত্ব)। একটি পুরোনো, একটি হালের, বছর দুয়েকের। দুই রেস্তরাঁর সামনেই বিরাট টিভি-পর্দায় গ্রিসের ওক্সি (ইয়েস), নাইন (নো ) ভোটের রেজাল্ট সম্প্রচারিত, সরাসরি এথেন্স থেকে। দর্শক গ্রিকসহ জার্মান ও নানা দেশের। দেখলুম, নো-র ভোট যত বাড়ছে, দর্শকের উল্লাস। ফেটে পড়ছে উল্লাসে। সুনিশ্চিত জয়ে মহাফুর্তি। পটকা, আতশবাজিতে আকাশ আলোকিত। শুনলুম, ন্যয়কোলন জেলায় আনন্দমিছিল বেরিয়েছে। মিছিলে লিংক পার্টাই, গ্রিন পার্টির অনেকেই সামিল (জার্মান সংসদে এই দুই পার্টির আসন সংখ্যা ১২৩।) ট্রয়কা (ইউরোপীয় কমিশন, আইএমএফ, ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। হেড অফিস ফ্রাঙ্কফুর্টে)-র সঙ্গেই কেবল অস্টারিটি/বেলআউট নিয়ে গ্রিসের যুদ্ধ নয়, রণাঙ্গনে পয়লা জেনারেল জার্মানি। কামান দাগানোর দায়িত্বে। বলা হচ্ছে এখন, ট্রয়কা হারেনি, হেরেছে জার্মানি। শুরু থেকেই জার্মানি আলেক্সিস সিপ্রাস সরকারের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগেছে। কেননা, কমুনিস্ট। সিপ্রাসের সিরিজা দলের সঙ্গে আরো পাঁচটি বামদল জোট সরকারে। চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি সিপ্রাস সরকার গঠনের পরেই জার্মানি ও ফ্রান্সের মগজ চক্কর দেয়, ঘিলু ওলোটপালট হয়? কমুনিস্ট সরকারকে পদে-পদে বিপদে ফেলার ফন্দি পাকা করে। বেলআউটের নামে শর্তের পর শর্ত আরোপ। বিগত সরকারের (সামারাস, পাপানদ্রর) বেলায় এতটা নয়? ওঁরা তো জিগরি দোস্ত। নো ভোটে জার্মানি কাহিল, মুখ থুবড়ে দিশেহারা। বহুল প্রচারিত দৈনিক বিল্ড (প্রচার সংখ্যা সাড়ে তিন মিলিয়ন) প্রশ্ন তুলেছে, চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের ব্যঙ্গ কার্টুন ছেপে, হোয়াট ইজ দ্য নেকস্ট? ইউরোপে মেরকেলের পরাজয়। মনে রাখি, ট্রয়কা নয়, জার্মানি তথা ইউরোপে ফ্রাউ মেরকেলই দেবী চৌধুরানী। তাঁর পরাজয় কী মান্য? অসম্ভব। বলা হচ্ছে, ২০ জুলাইয়ের মধ্যেই বেলআউটের নতুন ফাঁসে সিপ্রাস সরকারের অন্নপ্রাসনের ঘ্যাঁট বেরুবে পেট থেকে? ছয় মাসেই নতজানু হবে। আগামী বছর জানুয়ারি মাসে গ্রিসে সাধারণ নির্বাচন (লোকসভা)। লোকে ভুল বুঝতে পারবে, বামদলকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবে। আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। বাধ্য হয়ে তখন ইউরোমুদ্রার বদলে দ্রাকমা চালু করবে আবার। অর্থনীতির মুরুব্বি, প-িত বলছেন, দ্রাকমা ফিরে এলে, ইউরোমুদ্রার তুলনায় দ্রাকমার অবমূল্যায়ন, পর্যটক বাড়বে বিস্তর? অর্থনীতির বাড়ন্ত। অবশ্য কতদিন। প্রশ্ন সেটাই। গ্রিসের অর্থনীতির ধস এতটাই, গত বছর এথেন্সে গিয়ে টের পাই। হোটেলের ভাড়া অর্ধেক। খাবারের দামও কম। ক্রেডিট কার্ড কোনও রেস্তরাঁ নিতে নারাজ, চাই নগদ। রাস্তার বেশ্যারাও বলে, খুচরো নয়, নোটে কারবার। আপনারা যারা গ্রিসে গিয়েছেন, এথেন্সে, নিছকই ভ্রামণিক, অ্যাক্রোপোলিস, দেলফি মন্দির কিংবা কয়েকটি ঐতিহাসিক জায়গায়, দেখেছেন বিস্তর ভিড়। এসব টুরিস্ট এলাকা। যদি ক্রেটা (ক্রিট) বা অন্য দ্বীপে যান, টের পাবেন না গ্রিসের ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়। ফিরে আসুন রাজধানী এথেন্সে, মানুষ দিব্যি স্ফূর্তিতে পাগলপারা। নগরীর কেন্দ্রস্থল সিনট্যাগমাস্কয়ার, যেখানে নো ভোটে মানুষের আনন্দ-হৈচৈ-হুল্লোড়, দেখবেন, কৃচ্ছ্রসাধন সত্ত্বেও প্রাণের স্পন্দন। ওই স্পন্দনের দোলায় এখনো আন্দোলিত, গ্রিকরা ট্র্যাজেডিতেও জীবন্ত। কবি কাভাফি যেমন বলেছেন। লেখক : কবি, বার্লিন থেকে
×