ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ

বিজয়ের ঝর্ণাধারায় এগিয়ে যাও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৫ জুলাই ২০১৫

বিজয়ের ঝর্ণাধারায় এগিয়ে যাও বাংলাদেশ

এ লেখা পড়তে পড়তে দ. আফ্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের একদিনের ক্রিকেট সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ দেখার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত থাকবেন। আজই বাংলাদেশ বনাম দ. আফ্রিকার মধ্যেকার ৩ ম্যাচের একদিনের ক্রিকেট সিরিজের ফয়সালা হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে একদিনের ক্রিকেট সিরিজে ১-১ সমতায় রয়েছে বাংলাদেশ। আজ ফয়সালা হয়ে যাবে সিরিজ কার ঘরে যাবে। বাংলাদেশের না প্রোট্রিয়াদের। সিরিজের প্রথম ম্যাচে হারলেও পরের ম্যাচে ৭ উইকেটের বড় জয় নিয়ে ঠিকই সিরিজে ফিরে এসেছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের এই জয়টা এসেছে ৩ ম্যাচ হারের পর। প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের আগে ২ ম্যাচের টি২০ সিরিজে হেরে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। এতে করে বাংলাদেশের ক্রিকেটানুরাগী দর্শকরা এতে করে অনেকটাই নাখোশ হয়েছিল। অবশ্য নাখোশ হওয়ারই কথা। বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে অমন নৈপুণ্যভাস্বর সিরিজ জয়ের পর এমন করে পর পর তিন ম্যাচে (ভারতের সঙ্গে শেষ ম্যাচসহ ৪ ম্যাচে) পরাজয় মেনে নিতে কষ্টই হয়। যদিও ভারতকে পাকিস্তানের মতো হোয়াইট ওয়াশ বা বাংলাওয়াশ যাই বলা হোক না কেন কোনটাই করা হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশের। স্রেফ ২-১ ম্যাচে সিরিজ জিতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে বাংলাদেশকে। যদিও সেটা ৩-০ ও হতে পারত বলে অনেকেই মনে করেন। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ জয় হলেও এ সিরিজ জয় বাংলাদেশের ক্রিকেটানুরাগী দর্শকদের মন ভরাতে পারেনি। এ দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা ছিল পাকিস্তানের মতো ভারতের বিপক্ষেও ৩-০ ম্যাচের একটা ক্লিন উইনিং সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। শুরুটা সে ভাবেই হয়েছিল বাংলাদেশের। কিন্তু শেষ ম্যাচের অপ্রত্যাশিত পরাজয় গোটা হিসেবটাই উল্টে দিল। বদলে গেল ছক। তবে এমনটা কেউ আশা করেনি। বাংলাদেশের শেষ ম্যাচের এ পরাজয়কে কেউ কেউ দেখছে ভিন্নচোখে। তারা মনে করছেন সিরিজ জয় হয়ে যাওয়ায় শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ অনেকটা গাছাড়া দিয়ে খেলেছে, যাতে করে ভারত জিতে যেতে পারে। ফলে শেষ ম্যাচে আগের দুই ম্যাচের বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। গত বিশ্বকাপের আগে থেকে যে বাংলাদেশকে সবাই দেখে আসছিল শেষ ম্যাচে সেই অল আউট বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কী ব্যাটিং, কী বোলিং সবখানেই সেই চির চেনা বাংলাদেশ অনেকটাই অনুপস্থিত ছিল। ভারতের সঙ্গে শেষ ম্যাচের আগের দিনেই ফেসবুক-টুইটারে বাংলাদেশের জয় নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতকে বাংলাওয়াশের হাত থেকে বাঁচাতেই বাংলাদেশের এই গাছাড়া খেলা। এ নিয়ে ম্যাচের আগে অনেকে ফেসবুকে স্টাটার্সও দেন। যদিও সেসব তাদের নিছক ভাবনার ফসল। যার কোন ভিত্তিই ছিল না। তবু তাদের সে সংশয় শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়ে যায়। হতে পারে মিরাকাল। হয় তো প্রতিপক্ষ ভারত বলেই এমন ভাবনা! যদি প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া অথবা অন্য কোন দেশ হতো তাহলে এমন ভাবনা কারও মাথায় আসত বলে মনে হয় না। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে অনৈতিকভাবে জিতেছিল ভারত। বাংলাদেশের সে পরাজয়ের একটা দাঁতভাঙা জবাব দেয়ার মোক্ষম সুযোগও এসেছিল। কিন্তু শেষ ম্যাচটি না জেতায় সেটা ষোলকলা পূর্ণ হতে পারল না। প্রথম দুই ম্যাচের অমন মন ভরানো জয়ের পর শেষ ম্যাচটায় এমন হার খুব একটা সঙ্গতিপূর্ণ মনে হয়নি। এ নিয়ে অনেকের মনে একটা খটকা থাকলেও থাকতে পারে। তবে একটা কথা না বলে পারছিনে, ‘সুযোগ বারবার আসে না।’ ভারতকে হোয়াইট ওয়াশ করার এমন সুযোগ যে বারবার আসবে না সে কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়া যায়। অনেকে মনে করেন, টসে জিতে আগে ব্যাট না করাটা বাংলাদেশের জন্যে বুমেরাং হয়েছে। পরে ব্যাটিংয়ের চেয়ে আগে ব্যাট করার অনেক সুবিধা। আর একটু চেষ্টা করলে বাংলাদেশ সে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারত। এই না পারার আফসোসটা আমাদের অনেকদিন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। ভারতের সঙ্গে পরাজয়ের সে রেশটা চলতে থাকে দ. আফ্রিকার বিপক্ষের সিরিজের প্রথম ৩ ম্যাচ পর্যন্ত। ২ ম্যাচের টি২০ সিরিজে বাংলাদেশের ছেলেরা হেরেছে বাজেভাবে। প্রথম একদিনের ম্যাচেও ঘটে হারের পুনরাবৃত্তি। যদিও প্রতিপক্ষ হিসেবে পাকিস্তান ও ও ভারতের চেয়ে দ. আফ্রিকা অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেকে বলতে পারেন, ভারত ২ বার ও পাকিস্তান ১ বার বিশ্বকাপ জিতেছে আর প্রোটিয়াসরা তো এ পর্যন্ত বিশ্বকাপের ফাইনালেই উঠতে পারেনি। তাদের দৌড় তো সেমি-ফাইনাল পর্যন্ত! আমি মানছি ওরা বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেনি। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানসহ যারা একাধিকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তাদের বারবার হারাবার ক্ষমতা রাখে স্প্রিংবকরা। দ. আফ্রিকা দ. আফ্রিকাই।বাংলাদেশের ক্রিকেটের নবজাগরণ ২০১৪-রর মাঝের দিক থেকে। বিশেষ করে নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর থেকে। এরপর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অভাবনীয় সাফল্য, পাকিস্তানের বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে ৩-০ ও টি২০ ক্রিকেটে ১-০ তে সিরিজ জয় এবং ভারতের বিপক্ষে একদিনের ক্রিকেটে ২-১-এ সিরিজ জয় পর্যন্ত বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা বিজয়ের যে ঝর্ণাধারা অব্যাহত রেখেছে তাতে করে বাংলাদেশ দলকে অবশ্যই ক্রেডিট দিতেই হবে। আগে বাংলাদেশ একটা ম্যাচ বা একটা সিরিজ জিতলে পরের তিনটেতে ফ্লপ করেছে। এখন আর সেই বাংলাদেশ দল নেই। এখন বলা যায় বাংলাদেশ অনেকটাই পরিণত ও পরীক্ষিত একটি দল। একটা ম্যাচ হারলেও পরের ম্যাচে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস আছে। আজ তারা যে কোন জায়গায় যে কোন দলকে বলে-কয়ে হারানোর ক্ষমতা রাখে। সেই বাংলাদেশ যখন পর পর টে ম্যাচে হেরে বসল তখন বিষয়টি নিয়ে না ভেবে পারেনি ক্রিকেটপাগল দর্শকরা। কেননা সামনে রয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। সেখানে অংশ নিতে হলে রয়েছে অনেক সমীকরণ। তাই বাংলাদেশের দ. আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচের এই জয়টা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাসটা অনেকখানি বেড়েছে। এখন বদলে যেতে শুরু করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটচিত্র। আর সেটার পূর্ণতা পেয়েছে বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার পর। ভারতের কাছে অনৈতিকভাবে হারার পর বাংলাদেশের ছেলেদের জিদটা আরও বেড়েছে। ফলে আরও ধারালো, আরও পরিশীলিত হয়েছে বাংলাদেশ দল। যে কারণে বিশ্বকাপে জ্বলে ওঠা টাইগারদের বহ্নিশিখায় আত্মাহুতি দিতে হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের। ভারত কোন ক্রমে বেঁচে গেলেও পাকিস্তানকে হতে হয়েছে হোয়াইট ওয়াশ। সবার প্রত্যাশা ভারতের মতো দ. আফ্রিকার বিপক্ষেও একদিনের ক্রিকেটের সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ। এখন একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের জয়ের ধারাবাহিকতা আছে। সেটা ধরে রাখতে পারলে আর আমাদের নিরাশ হতে হবে না। হয়ত তৃতীয় ও শেষ একদিনের ম্যাচেও জিতবে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা শেষ ম্যাচ জিতুক বা হারুক, ফলাফল যাই হোক সেটা বড় কথা নয়। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এটাই বড় কথা। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ এমন একটি দলকেই তো চেয়েছিল। আর একটা কথা এবারের জয় কেবলমাত্র জয়েই সীমাবদ্ধ নেই। জয় ছাড়াও বাংলাদেশের অর্জন অনেক কিছু। অধিনায়ক মাশরাফির চমৎকার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ দল পেয়েছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে তামিম, মুশফিক, সাব্বির, সৌম্য, রিয়াদ, নাসিররাও বুঝিয়ে দিয়েছে, এখন আর জেতার জন্যে সাকিবের একার ওপর দলকে নির্ভর করে থাকতে হবে না। আর এ বোলিংয়েও পেসার মুস্তাফিজুর, তাসকিনদের ওপর দল আস্থা রাখতেই পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্ধকার রাত কেটে গেছে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন নতুন দিনের শুরু। সেই নতুন দিনের কান্ডারি রিয়াদ, সৌম্য, নাসির, সাব্বির, লিটন দাসরা এরই মধ্যে প্রমাণ করেছেন সাকিব-তামিম-মুশফিকদের অনুপস্থিতিতে তারাও দলের হাল ধরার ক্ষমতা রাখেন। অন্যদিকে বোলিংয়েও মাশরাফি-রুবেলদের দুর্ভাবনা কমিয়ে তরুণ বোলার তাসকিন-মুস্তাফিজ, আরাফাত সানী, সোহাগ গাজীরা উঠে আসছেন। লিটন দাশের আগমনে মুশফিকেরও বোঝা কমেছে। সব মিলিয়ে এখন আমরা পেয়েছি একটি নতুন বাংলাদেশ দলকে। যেখানে কারও জন্যে কিছু পড়ে থাকবে না। সর্বোপরি যে বড় কাজটি হয়েছে সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশের ছেলেদের ভয় ভেঙে গেছে। এখন আর বাংলাদেশের ছেলেরা কাউকে ভয় করে না। এখন তারা বুঝে গেছে, ‘আমরাও পারি।’ আমাদের ছেলেরা এই ‘আমরাও পারি’টা যদি সব সময় ধরে রাখতে পারে তাহলে তাদের অজেয় কোন কিছু থাকবে না। এমন কী পরের বিশ্বকাপও না। সব শেষে বাংলাদেশের এ জয়ের নেপথ্য কারিগরদের কথা বলতেই হয়। বাংলাদেশ দলের শ্রীলঙ্কান কোচ চন্দ্রিকা হাতুরাসিংহে, সহকারী আরেক শ্রীলঙ্কান কোচ রুয়ান কালপাগে, ফার্স্ট বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক, ফিল্ডিং কোচ রিচার্ড হালসাল, ট্রেনার মারিও ভিলারানসহ কোচিং স্টাফদের কথা না বললেই নয়। বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশ গড়ার পেছনে এদের বড় ভূমিকা রয়েছে। এর সঙ্গে একদিনের ক্রিকেটের অধিনায়ক মাশরাফির নেতৃত্বে দল ঐক্যবদ্ধ হওয়াও জয়ের অন্যতম কারণ। এর আগে কোন অধিনায়ক দলকে এমনভাবে সুসংগঠিত করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। এই ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ দল থাকলে বিজয়ের এই ঝর্ণাধারা অব্যাহত থাকবে বলে সবার আশা। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে তারুণ্যের জয়গানে মুখরিত এ দলটিই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সমৃদ্ধির পথে সেটাই সবার প্রত্যাশা। লেখক : ক্রীড়ালেখক, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সংগঠক ব-সধরষ : ংুবফসধুযধৎঁষঢ়ধৎাবু@মসধরষ.পড়স
×