ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ঈদ ভাবনা

প্রকাশিত: ০৩:৫৩, ১৭ জুলাই ২০১৫

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ঈদ ভাবনা

আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে আল্লাহর কাছ থেকে। আসমানী বিধানও দিয়েছেন আল্লাহ। কোন বিধান সুস্পষ্ট বাক্য দ্বারা এসেছে আবার কিছু বিধান হযরত রসূল (সা.) আল্লাহর কাছ থেকে লাভ করে নিজে তা পালন করে উম্মতের মধ্যে বলবত করেছেন। সিয়াম বিধান নাযিল হয় ৬২৪ খ্রিস্টাব্দের ১৫ শা’বান তারিখে। ইরশাদ হয়েছে : ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের প্রতি সিয়াম বিধান দেয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীদের দেয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৩)। কখন এই বিধান কার্যকর হবে তার উল্লেখ করে ইরশাদ হয়েছে : রমাদান মাস যাতে নাযিল হয়েছে মানুষের জন্য দিশারী সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সৎ ও অসৎ পার্থক্যকারী আল কুরআন, সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস প্রত্যক্ষ করবে তারা এতে সিয়াম পালন করবে (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)। সেই তখন থেকে রমাদান এলে খুবই উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে বিশ্ব মুসলিম রমাদানে সিয়াম পালন করে আসছে। সিয়ামের অনুষঙ্গ তারাবি, সেহরি, ইফতার, শবে কদর, জুমু’আতুল বিদা পালন করে আসছে। রমাদান পূর্ণ হলে ঈদের চাঁদ দেখে এক আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ-উল-ফিতর পালন করে আসছে। হজের শেষে পালিত হচ্ছে ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ। ঈদ মুসলিম হৃদয়ে আনন্দ ও খুশির জোয়ার সৃষ্টি করে। ঈদ কেবলমাত্র আনন্দ উৎসব নয়, এ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। ঈদের দুই রাক’আত ওয়াজিব সালাত ছয় তকবিরের সঙ্গে আদায় করতে হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম মাহে রমাদানে মসজিদুন্নববীতে তওবার খুঁটির পাশে একটি টাঙ্গানো তাঁবুর ভেতর বিছানো বিছানায় অবস্থান করতেন। ২০ রমাদান থেকে শাওয়ালের চাঁদ উদয় পর্যন্ত ইতিকাফ করতেন। তাঁর পবিত্র বিবিগণ যার যার হুজরা শরীফে ইতিকাফ করতেন। চাঁদ দেখা আনন্দ বিভা বিম্বিত হলে হতো ফজরের সালাত। ভোর না হতেই তিনি জড়ো হওয়া গরিব মানুষদের মধ্যে ফিতরা বিতরণ করতেন। ইতোমধ্যে নিকটস্থ কূপ থেকে কয়েক ডোল পানি নিয়ে আসা হতো। তিনি গোসল করতেন অন্যদিনের চেয়ে কয়েক বেশী ডোল পানি ব্যবহার করে। ভালভাবে দেহ মুবারক সাফ করতেন। গোসল শেষে পোশাক পরিধান করে আতর মাখতেন এবং চোখে সুরমা লাগাতেন। এরপর কয়েকটা খেজুর বা খোরমা খেয়ে মসজিদে নববী হতে ৩০৫ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত খোলা ময়দানে ঈদের জামাতে শরিক হতেন। তিনি সারা পথ মৃদু আওয়াজে সুললিত উচ্চারণে পাঠ করতেন : আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ- আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই এবং আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান আর যাবতীয় প্রশংসা তাঁরই জন্য। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহার দিনে বের হয়ে ঈদগাহে পৌঁছে প্রথমে ঈদের জামাতে সালাত পড়তেন। সালাত শেষে তিনি দাঁড়িয়ে জনতার দিকে ফিরে খুতবা দিতেন। কাতারে কাতারে জনতা যার যার স্থানে বসে থাকতেন। তিনি তাঁদের উপদেশ দিতেন, নসীহত করতেন এবং নির্দেশ দিতেন। কোথাও সৈন্য প্রেরণের প্রয়োজন থাকলে তাদের বাছাই করতেন অথবা নির্দেশ দেয়ার থাকলে নির্দেশ দিতেন। তারপর গৃহে ফিরতেন (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। হযরত জাবের (রাদি.) হতে বর্ণিত আছে যে, ঈদের দিনে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে যে পথ দিয়ে যেতেন, ফিরতেন অন্যপথে (বুখারী শরীফ)। হযরত জাবের (রাদি.) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের কাছে আমি ঈদের দিন উপস্থিত ছিলাম। তিনি আযান ইকামত ব্যতীত খুতবার পূর্বে সালাত আরম্ভ করলেন। সালাত শেষে হযরত বেলাল (রাদি.) এর দেহে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন এবং আল্লাহর প্রশংসাবাদের পর লোকদের উপদেশ দিলেন, আল্লাহর স্মরণ করিয়ে দিলেন এবং আনুগত্যের প্রতি উৎসাহিত করলেন। অতঃপর বিলাল (রাদি.)-কে সঙ্গে নিয়ে মহিলাদের দিকে গেলেন, তাদের তাকওয়া অবলম্বনের নির্দেশ দিলেন এবং আল্লাহর যিকর করতে উপদেশ দিলেন (নাসায়ী শরীফ)। হযরত ইব্নে আব্বাস রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্হু থেকে বর্ণিত আছে যে, আমাকে একজন জিজ্ঞাসা করলেন : আপনি কি কখনও হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ঈদের সালাতে উপস্থিত ছিলেন? আমি বললাম, হ্যাঁ! হযরত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে বের হলেন, সালাত পড়লেন, অতঃপর খুতবা দান করলেন। অতঃপর তিনি মহিলাদের কাছে গিয়ে ওয়াজ নসীহত করলেন এবং দান-সাদাকা করার জন্য উপদেশ দিলেন। আমি দেখলাম মহিলাগণ যার যার গলা ও কানের দিকে হাত বাড়িয়ে গয়না খুলে খুলে বেলালের কাছে দিচ্ছে। অতঃপর তিনি বেলালকে সঙ্গে নিয়ে গৃহে ফিরলেন (বুখারী শরীফ, মুসলিম শরীফ)। একবার তাঁর দুই নাতি হাসান (রাদি.) ও হুসাইন (রাদি.) ঈদের দিনে তাঁর কাছে বায়না ধরল : নানাজী, অন্য ছেলেমেয়েরা ঈদের দিনে নতুন নতুন পোশাক পরবে। আমাদের তো নতুন পোশাক নেই। আমরা কি পরিধান করব। সেদিন প্রিয় নবী (সা.) এর কাছে পয়সা-কড়ি কিছুই ছিল না। তিনি আল্লাহর কাছে দু’আ করলেন, আল্লাহ জিবরাইল আলায়হিস সালাম দ্বারা দুই খ- সাদা কাপড় পাঠালেন। সেই কপড় পেয়ে প্রিয় নবী (সা.) বড় নাতিকে বললেন, নানু, তুমি কি রঙের কাপড় চাও? তিনি বললেন নীল। পানিতে ভিজানোর সঙ্গে সঙ্গে তা নীল রঙের হয়ে গেল। হযরত ইমাম হুসাইন (রাদি.) চাইলেন লাল রঙের। ভিজানোর সঙ্গে সঙ্গে তা লাল হয়ে গেল। ঈদ ইসলামের আনন্দ উৎসব। তা যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা, ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ
×