ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নেপথ্য কাহিনী;###;১১ মাসে ৭ দুর্ঘটনা, শতাধিক প্রাণহানি

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়ক ॥ ১৭ কিমি কেন মৃত্যু ফাঁদ?

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২১ জুলাই ২০১৫

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়ক ॥ ১৭ কিমি কেন মৃত্যু ফাঁদ?

বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ ॥ সারা দেশের অনেক সড়কের তুলনায় বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কের মাত্র ১৭ কিলোমিটার রাস্তায় কেন এত বড় বড় দুর্ঘটনা তা নিয়ে গোটা দেশে হৈচৈ। ঈদ উৎসবসহ যে কোন বড় ধরনের উৎসবে সেতুর পূর্ব ও পশ্চিম সংযোগ সড়কে বড় দুর্ঘটনা ঘটবেই। সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কে ২০১০ সালে পাবনা থেকে নির্বাচিত জনপ্রিয় নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বকুলসহ এক সঙ্গে ৫০ জন নিহত হয়েছেন। নব দম্পতিসহ অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু দুর্ঘটনার মূল কারণ খুঁজে বের করে এর কোন সুরাহা করা হয়নি। গত রবিবার বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ সড়কে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক সঙ্গে ১৭ জন নিহত হয়েছে। ঈদের আগে ও পরের তিন দিনে একই সড়কে মোট ২৫ জন নিহত হয়েছেন। আর এর আগে ১১ মাসে ৭০ সড়ক দুর্ঘটনায় ১০২ শিশু-নারী-পুরুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাসের ছাদে যাত্রী ওঠানো, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, নেশাগ্রস্ত এবং ক্লান্ত শরীরে গাড়ি চালানো, অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক, ওভারটেকিং, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রীবহন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন মেনে না চলা, রোড ডিভাইডার না থাকা, চলাচলকারী যানবাহনের তুলনায় সড়ক প্রশস্ত না হওয়া এবং মহাসড়কে অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচলের কারণেই মূলত বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কের ১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটছে বলে তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে। বঙ্গবন্ধু সেতু উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেও সেতুর পূর্ব ও পশ্চিমপাড়ের সংযোগ সড়ক যাতায়াতকারী যানবাহনের যাত্রীদের অনেকের জীবনে অভিশাপ বয়ে এনেছে। এই মহাসড়কে প্রায়ই বড় আকারের দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক পরিবার দুর্ঘটনায় উপার্জনক্ষম এক মাত্র পিতা, কিংবা মাতা, অথবা স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। অনেকেই পঙ্গু হয়ে অসহায় জীবন যাপন করছেন। গত রবিবার ঈদের নামাজ আদায় করে সুদূর চট্টগ্রাম থেকে প্রিয়জনের সান্নিধ্য পাবার জন্য উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু ঘাতক মহাসড়ক তাদের যাত্রায় বাধা হয়েছে। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে ১৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। ঈদের আগে ও পরের তিন দিনে একই মহাসড়কে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। গত ১১ মাসে এ মহাসড়কে ৭০ দুর্ঘটনায় ১০২জন প্রাণ হারিয়েছে। আহত হয়েছে তিন শতাধিক শিশু-নারী-পুরুষ। কিন্তু আহতদের সুষ্ঠুভাবে সেবা দানের জন্য সিরাজগঞ্জের একমাত্র সরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান আড়াই শ’ শয্যার সিরাজগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কোন ইউনিট নেই। যে কোন সময় বড় ধরনের কোন দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা তাৎক্ষণিক মোকাবেলার জন্য কোন ইউনিট গঠন করা হয়নি। তবে সুখের বিষয়, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কের পাচিলায় যাত্রীদের নিরাপদে রাস্তা পারাপারের জন্য প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ ধরে সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগ একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। আগস্ট মাসের শেষভাগে এর নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার পর দেশের অন্যতম ব্যস্ত সড়ক হিসেবে পরিচিত এই সংযোগ সড়কটি। বঙ্গবন্ধু সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার যানবাহন চলাচল করে। ঈদ উৎসবে এর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়। অর্থাৎ ২২ থেকে ২৪ হাজারে ওঠে। এই মহাসড়কে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ২৪ মে পর্যন্ত ছোটবড় মিলিয়ে ৭০ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী-পুরুষ ও শিশু মিলিয়ে ১০২জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে তিন শতাধিক শিশু-নারী-পুরুষ। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম গোলচত্বর থেকে নলকা মোড় পর্যন্ত মহাসড়কের ১৭ কিলোমিটারেই ঘটেছে ১৯ দুর্ঘটনা। মহাসড়কে চলাচলরত যানবাহনের চালক, বাস মালিক সমিতি, পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে সময় দুর্ঘটনার নানা কারণ উঠে এসেছে। এর মধ্যে রাস্তায় ডিভাইডার ও ওভারব্রিজ না থাকা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বাসের ছাদে যাত্রী ওঠানো, অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, নেশাগ্রস্ত এবং ক্লান্ত শরীরে গাড়ি চালানো, অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক, ওভারটেকিং, অতিরিক্ত মাল ও যাত্রী বহন, ট্রাফিক আইন অমান্য ও হাইওয়ে এবং ট্রাফিক পুলিশের গাফিলতি দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে মালবাহী ট্রাকগুলো রাত-দিন বিরামহীনভাবে চালিয়ে আসার কারণে চালকরা ক্লান্ত থাকে, অনেক চালকের ঘুমের ভাব হলেও তারা বিশ্রাম নেয় না। এতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। এছাড়াও পাঁচ টনের গাড়িগুলো ১০ থেকে ১৫ টন মাল বহন করলেও কর্তৃপক্ষের সেদিকে কোন নজর নেই বলে অভিযোগ করেন অনেকেই। অন্যদিকে, বাসের ছাদে যাত্রী বহন, সিএনজি চালিত অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক ও ভটভটির বেপরোয়া গতিকেও দায়ী করেন অনেকে। সিরাজগঞ্জ বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গাড়ি চালকদের নানা অনিয়ম ও গাফিলতির কথা স্বীকার করে বলেছেন- ঈদের আগে মহাসড়কে যানজটের কারণে গাড়ি চালকরা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। তবে রোড চওড়া এবং ডিভাইডার করা জরুরী; না হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে না। সিরাজগঞ্জ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মহাসড়কের চারটি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান চিহ্নিত করে সেখানে সাইনবোর্ডসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। যাত্রীদের নিরাপদে রাস্তা পারাপারের জন্য মহাসড়কের পাচিলায় প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করা হচ্ছে। পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহমেদ বেপরোয়া গতি ও ক্লান্ত শরীরে গাড়ি না চালিয়ে মালিক এবং শ্রমিকদের রাস্তায় চলাচলে আরও দায়িত্ববান হবার আহ্বান জানিয়ে বলেছেনÑ উত্তরাঞ্চলসহ ২১ জেলার যানবাহন চলাচল করে এই মহাসড়কে। স্বাভাবিক সময়ে যানবাহনের সংখ্যা প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার হলেও যে কোন উৎসবে এর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়। এ জন্য মহাসড়কে চাপ পড়ে বেশি। তাই দ্রুত মহাসড়কটি দুই লেন থেকে চার লেনে উন্নীত এবং উঁচু ডিভাইডার দরকার। এছাড়াও কিছু ট্রাফিক আইনের সাইন বোর্ড জরুরী। কিছু সাইনবোর্ড দেয়া আছে। আরও কিছু সাইনবোর্ড দেয়া হবে, যেগুলো রাতে জ্বলজ্বল করবে। সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোঃ বিল্লাল হোসেন জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড়ের মহাসড়ক সেতু বিভাগের অধীনে। সড়কটি মসৃণ হওয়ায় চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে। সড়কটিতে ডিভাইডারের প্রসঙ্গ টেনে সেতু বিভাগের সচিবের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি এও বলেছেন- দুই লেনের সড়কে ডিভাইডার আইন সঙ্গত নয়। এজন্য ডিভাইডার দেয়া সম্ভব নয়। তবে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করা জরুরী। বিষয়টি সেতু বিভাগকে জানানো হয়েছে। রবিবারের দুর্ঘটনার কারণ নির্ণয়ের জন্য নিয়মমাফিক একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। তদন্ত শেষে কমিটি রিপোর্ট জমা দিয়ে কিছু সুপারিশও করেছে। ভবিষ্যতে এর বাস্তবায়ন হবে বলেও তিনি আশা করেন।
×