ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনুবাদ : এনামুল হক

বাঘ নিয়ে কোটি কোটি ডলারের কালোবাজারি

প্রকাশিত: ০৪:২২, ২২ জুলাই ২০১৫

বাঘ নিয়ে কোটি কোটি ডলারের কালোবাজারি

শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রতীক রয়েল বেঙ্গল টাইগার আজ বিপন্ন। প্রাকৃতিক আবাসভূমি উজাড় হয়ে আসা, পরিবেশ বিপর্যয়, চোরাশিকার ইত্যাদি কারণে এদের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে চলেছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনে এখন রয়েল বেঙ্গলের সংখ্যা চার শ’ কী তারও কম। ভারতে এই সংখ্যা সোয়া দুই হাজারের মতো। নেপালে আছে দেড় শ’ থেকে আড়াই শ’ এবং ভুটানে ৭০ থেকে ৮০। অর্থাৎ পৃথিবীতে এখন এই বাঘের সংখা তিন হাজারের বেশি হবে না। আগেই বলা হয়েছে রয়েল বেঙ্গলের সংখ্যা হ্রাসের একটা বড় কারণ চোরাশিকার। চামড়া ও শরীরের অন্যান্য অঙ্গের বেআইনী রমরমা বাণিজ্যে উৎসাহিত হয়ে চোরাশিকারিরা এই প্রাণীটিকে হত্যা করতে করতে উজাড় হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে। মুনাফার প্রতি মানুষের লোভ-লালসার কারণে আজ রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিয়ে গড়ে উঠেছে শত শত কোটি ডলারের বিশ্ববাজার। বলাবাহুল্য, এ বাজারটি একটি কালোবাজার। এ কালোবাজারের ক্রমবর্ধমান চাহিদাই চোরাশিকারিদের বেপরোয়াভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নিধনে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক কালোবাজারে একটা আস্ত মরা বাঘের দাম ৫ হাজার ডলার। আর বাঘটা যদি জ্যান্ত হয় তার দাম দাঁড়ায় ৫০ হাজার ডলার। রয়েল বেঙ্গলের চামড়া কালোবাজারে বিক্রি হয় ৩৫ হাজার ডলারে। জ্যান্ত বাঘের বাজার দাম ৩২শ’ ডলার। একটা মরা বাঘের বিভিন্ন অংশ যেমন- চামড়া, হাড়গোড়, মাংস ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে ৭০ হাজার ডলারে বিক্রি হয়। এখন দেখা যাক, বাঘের শরীরের চামড়া বাদে আর কোন্ কোন্ অংশের চাহিদা আছে এবং কাদের কাছে আছে ও কেন? বাঘের মাংস চর্মরোগের চিকিৎসায় খাওয়া হয়। ভারতের কোন কোন অঞ্চলের কৃষকরা বুনো শুয়োর তাড়ানোর জন্য বাঘের মাংসের ছোট একটা টুকরো আগুনে পোড়ায়। বাঘের মগজ অলসতা ও ফুসকুরি দূর করার ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। কপাল সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি আনার ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাজে লাগে। ভ্রান্ত জাদুটোনার কাজে ব্যবহার করা হয় অশুভ শক্তিকে তাড়াতে ও দৈহিক শক্তিকে নিয়ে আসতে। বাঘের গোঁফ দাঁতের ব্যথা সারাতে ব্যবহার করা হয়। জাদুটোনার কাজেও লাগে। বাঘের সামনের পায়ের ডানদিকের থাবা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে ধারণা করা হয়। এটি গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে পান করলে মাথাব্যথা দূর হয়। দুষ্ট আত্মাকে তাড়িয়ে দেয়া যায়। বাঘের দাঁতও ফেলনা নয়। এর ছেদন দন্ত দিয়ে তৈরি হয় অলঙ্কার। তাছাড়া সৌভাগ্য আনা ও ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাজেও ব্যবহার করা হয় এগুলো। কামড়ের মতো চামড়ার উপরিভাগের ক্ষত চিকিৎসায় নাকের ব্যবহার আছে। শুধু কি তাই? বাঘের চর্বি, পিত্ত, নখ, হাড় এমনকি বিষ্ঠা পর্যন্ত, কিসের-ইবা ব্যবহার নেই। কৃষকরা বুনো শুয়োরের উৎপাত থেকে নিজেদের ক্ষেত-খামারকে রক্ষা করার জন্য ঘরে এক বোতল চর্বি রাখে। কুষ্ঠরোগ এবং বাতের চিকিৎসায় এর ব্যবহার আছে। মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত শিশুদের খিঁচুনি হলে সেই চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় বাঘের পিত্ত। অক্ষিগোলক মৃগী ও ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় লাগে। বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসায় বাঘের দুধের প্রচলন আছে। বাঘের হাড় এশিয়ায় সনাতনী চিকিৎসায় বাতের ব্যথা দূর করতে ব্যবহার করা হয়। এই হাড় দিয়ে তৈরি মদের যথেষ্ট কদর আছে চীনের উচ্চবিত্ত সমাজে। বাঘের লিঙ্গের যৌন ক্ষমতাবর্ধক শক্তি আছে বলে চীনা ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলের মানুষের ধারণা। এটি নাকি পুরুষের যৌনাকাক্সক্ষা বাড়ায়। এটি ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাজেও লাগে। ইন্দোনেশিয়ার শামান জনগোষ্ঠী ব্ল্যাক ম্যাজিকের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঘের বিষ্ঠা দিয়ে চিকিৎসা চালায়। এর লেজও ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাজে লাগে। হাড়ের বিভিন্ন রোগ চিকিৎসার জন্য এশীয়দের কিছু অংশ বাঘের পিত্তথলি শুকিয়ে ট্যাবলেট বানিয়ে খায়। বাঘের চামড়া অনেকে আভিজাত্যের নিদর্শন হিসেবে ঘরের দেয়ালে টাঙ্গিয়ে রাখে। অনেকে আবার অশুভ আত্মা তাড়াতে অথবা ব্ল্যাক ম্যাজিকের কাজে এই চামড়া ব্যবহার করেন। বাঘের পায়ের তলা জাদুটোনার আচার-অনুষ্ঠানের কাজে লাগে। বাঘের নখ অনেকে গলায় মালার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, অজস্র কাজে ব্যবহার আছে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও অংশের। সেগুলোর দামও কম নয়। একটা মরা বাঘ বিক্রি করে ৫ হাজার থেকে ৭০ হাজার ডলার মিলতে পারে। তাই এগুলোর এত কদর চোরাশিকারিদের কাছে। স্থানীয় অসৎ চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে এরা নেপাল, তিব্বত হয়ে চীন পর্যন্ত তৎপরতা চালায়। এই চোরাশিকারিরা যাদের দিয়ে আসলে বাঘ নিধন করে, তাদের যে খুব বেশি অংকের অর্থ দেয় তা কিন্তু নয়। ভারতে এ কাজের জন্য দেয়া হয় এক হাজার থেকে পাঁচ হাজার রুপী। অথচ এরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঘ হত্যা করে। তা করতে গিয়ে অনেক সময় নিজেরাও মারা পড়ে। চোরাশিকারের বেশির ভাগ ঘটনা চোরাশিকারি, ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা এক বিরাট সংগঠিত নেটওয়ার্কের অংশ। ভারতের এই নেটওয়ার্কগুলো যথেষ্ট তৎপর। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বড় বড় শহরের মালদার ব্যবসায়ী যাদের সঙ্গে এই ব্যবসার বাহ্যত সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই। এমনি একজন কুখ্যাত আন্তর্জাতিক চোরাশিকারি ভীমা বাওয়ারিয়া অন্তত ৩০টি বাঘ হত্যার অভিযোগে গত বছরের জুন মাসে ধরা পড়েন। এর আগে ২০০২ ও ২০০৫ সালে বাঘের চামড়া ও শরীরের অন্যান্য অংশসহ হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন। কিন্তু দু’বারই তিনি কোন না কোনভাবে কারাদ- এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন। নিশ্চয়ই তিনি প্রায় এক দশক ধরে কারও না কারও প্রটেকশন পেয়েছিলেন। রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ বা বন বিভাগের ওপর মহলের সঙ্গে নিশ্চয়ই তার দহরম মহরম ছিল বা আছে। বাঘের চামড়ার তো সর্বজনস্বীকৃত মূল্য আছেই। তাছাড়া বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশের বা অঙ্গের আলাদা কদর আছে চীনাদের কাছে এগুলোর তথাকথিত ওষুধিগুণের জন্য। এমনিতেই রয়েল বেঙ্গলের বিভিন্ন অংশের মূল্য অত্যধিক। সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। চীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি নতুন কিছু নয়। সেই সনাতন আমল থেকেই চলে আসছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটায় এবং ব্যক্তিগত আয়ও বেড়ে যাওয়ায় এ জাতীয় ওষুধের মূল্যও বহুগুণ বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে এসেছে বাঘ ও অন্যান্য প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে এসব সনাতন ওষুধ তৈরির নতুন জোয়ার। ফলে বাঘের চাহিদা বেড়ে গেছে এবং সেই চাহিদার যোগান দিতে বৃদ্ধি পেয়েছে চোরাশিকার। অথচ রয়েল বেঙ্গলকে হত্যা করা মানে ইকোসিস্টেম তথা পরিবেশকে ধ্বংস করা। অর্থাৎ অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদের বিনাশ ঘটানো। সেই ধ্বংস ও বিনাশের পরিমাণ কী টাকার অংকে নির্ণয় করা যাবে? নিশ্চয়ই না। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে
×