ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীর চোখই উপড়ে ফেলল পাষণ্ড

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৩ জুলাই ২০১৫

যৌতুক না পেয়ে স্ত্রীর চোখই উপড়ে ফেলল পাষণ্ড

শর্মী চক্রবর্তী ॥ যৌতুকের টাকা না দেয়ায় স্ত্রীর একটি চোখ উপড়ে ফেলেছে পাষ- স্বামী। অপর চোখটিও খুঁচিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করেছে পরিবারের অন্য সদস্যরা। পাষ- স্বামী রবিউল ইসলামের এই বর্বরতায় সুখী আক্তারের চোখের আলো চিরতরে হারিয়ে গেছে। ঈদের আগের দিন শুক্রবার এ ঘটনার পর সুখীকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। পঞ্চম তলায় নারী ওয়ার্ডের চিকিৎসাধীন সুখীর দু’চোখ ব্যান্ডেজে বাঁধা। চোখ হারিয়ে এখন অনেকটাই নির্বাক। একদিকে চোখ উপড়ানোর যন্ত্রণা, অন্যদিকে আর কখনও দেখতে না পারার আশঙ্কায় ভুগছেন তিনি। ২৬ বছর বয়সী সুখী জীবনে দুঃখ ছাড়া সুখের মুখ দেখতে পারেননি। দরিদ্র বাবার সংসার থেকে স্বামীর সংসারে গিয়ে ভালবাসার বদলে পেয়েছেন শুধু নির্যাতন। ১২ বছরের বিবাহিত জীবনে নির্যাতন ছাড়া আর কিছু ছিল না। অবশেষে হারাতে হলো চোখ। দেড় লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতেই রবিউল তার স্ত্রী সুখীর ডান চোখ তুলে নেয়। ব্যবসার টাকা যোগাড় করতে বড় ভাই ইদ্রিস আলী কিছুদিন ধরে রবিউলকে বলে আসছিল। টাকার জন্য রবিউল চাপ দিতে থাকে সুখীকে। বাবার কাছ থেকে টাকা এনে না দেয়ায় সুখীর চোখ উপড়ে ফেলে রবিউল। বাঁ চোখও তুলে নিতে চেয়েছিল সে। তখন এলাকার লোকজন ছুটে এসে সুখীকে উদ্ধার করেন। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইও) মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সুখীর চিকিৎসায় একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। মঙ্গলবার বোর্ডের সদস্য ও এনআইওর সহযোগী অধ্যাপক আনিসুজ্জামান জানান, সুখীর একটি চোখ অক্ষিগোলক থেকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। সেখানে প্লাস্টিকের একটি চোখ বসানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, বাঁ চোখের মূল স্নায়ুটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অক্ষিগোলক ঠিক থাকলেও চোখে আলোর উপস্থিতি বুঝতে পারছে না মেয়েটি। ওষুধ দিয়ে চোখটি সারিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। তবে এটি পুরোপুরি সেরে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই। খুব বেশি হলে কাছের জিনিস অস্পষ্ট দেখতে পারবে। আর ডান চোখটি এমনভাবে তুলে ফেলা হয়েছে যে, তা কোনভাবেই সারিয়ে তোলা সম্ভব নয়। ওই চোখে যেন তিনি দেখতে পান সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ঘটনার দিন (শুক্রবার) দুপুরে সুখী সাভারের কলমা জিঞ্জিরা এলাকার বাসায় খিচুড়ি রান্না করছিলেন। মাঝে একবার তিনি শয়নকক্ষ সংলগ্ন শৌচাগারে যান। এ সময় তিনি শুনতে পান তার স্বামী রবিউল ফোনে কথা বলছে। তার বক্তব্যের একাংশ ছিল এ রকম ‘তুই চিন্তা করিস না আখতার, দিলে তো একবারে জীবনের মতোই শ্যাষ কইরা দিমু। তোরা তাড়াতাড়ি চইলা আয়।’ সুখীর দেবরের নাম আখতার। এর ১০ মিনিটের মধ্যেই আখতার, তার বড় ভাই ইদ্রিছ আলী ও বোন ধলী বেগম এসে উপস্থিত হয় সুখীর বাসায়। তারা ঘরে বসে কথা বলছিল। রান্না করছিলেন সুখী। এরই মধ্যে তাদের সাত বছরের মেয়ে লুবনাকে কোমল পানীয় আনার বাহানায় দোকানে পাঠায় রবিউল। এর পরই সে স্ত্রীকে ঘরের ভেতর ডেকে নেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই রবিউল স্ত্রীকে জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। ঘরে থাকা আখতার, ইদ্রিছ ও ধলীও তাকে সাহায্য করে। তারা সবাই মিলে সুখীর হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর ইলেক্ট্রিক টেস্টার হাতে নিয়ে সুখীর বুকের ওপর চেপে বসে রবিউল। সে টেস্টার দিয়ে খুঁচিয়ে সুখীর ডান চোখ উপড়ে ফেলে। তার ভাই আখতার সুখীর বাঁ চোখে টেস্টার দিয়ে খোঁচায়। প্রচ- যন্ত্রণায় গগনবিদারী চিৎকার করে ওঠেন সুখী। তার চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে যান। নির্যাতনকারীরা দৌড়ে পালানোর সময় তারা রবিউলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। উপস্থিত লোকজন উপড়ে ফেলা চোখসহ সুখীকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সুখীর মা লায়লা বেগম জানান, মেয়ের বিয়ে হয় ১২ বছর হয়েছে। তখন রবিউল রিক্সাভ্যান চালাত। পরে সে দুবাই যায়। সে সময় সুখীর বাবা তিন লাখ টাকা দেন। গত রমজান মাসের শুরুতে দুবাই থেকে দেশে ফেরে রবিউল ইসলাম। তখন সুখী ছিলেন বাবার বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। রবিউল সরাসরি নবাবগঞ্জে গিয়ে সুখীকে নিয়ে নিজের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে যায়। এর তিন দিন পর সে সুখীকে বলে, সে আর দুবাই যাবে না। দেশে সে ব্যবসা করবে। এ জন্য তার দেড় লাখ টাকা দরকার। শ্বশুর-শাশুড়ির কাছ থেকে সেই টাকা এনে দিতে বলে। সুখী এতে আপত্তি করেন। কারণ এর আগে বিদেশে যাওয়ার সময় তাকে তিন লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছিল। এসব বলায় ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রীকে মারধর করে রবিউল। খবর পেয়ে সুখীর বাবা নূর মোহাম্মদ ও মা লায়লা আক্তার সেখানে যান। পারিবারিক সালিশে রবিউল ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। তবে সুখীকে নবাবগঞ্জে ফিরিয়ে আনেন তার বাবা-মা। এরপর মোবাইল ফোনে সুখীর কাছে ক্ষমা চায় রবিউল। সে স্ত্রীকে বলে, দু’জনে মিলে পোশাক কারখানায় কাজ করবে। সাভারে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকবে। আর কখনও নির্যাতন করবে না। একইভাবে শ্বশুর-শাশুড়ির কাছেও ক্ষমা চায়। সুখীর বাবা নূর মোহাম্মদ নবাবগঞ্জে কৃষিকাজ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে রাজি হই নাই। তয় পরে মাইয়া (সুখী) স্বামীর কাছে যাইতে চাইলে আমরা বাধাও দেই নাই। পরে ঘটনার দিন খবর পাইয়া আমরা ছুইটা গিয়া দেহি এই অবস্থা।’ সুখীর মেয়ে লুবনা আক্তার এখন রয়েছে তার মামার বাড়ি নবাবগঞ্জে। মায়ের জন্য সেও দুশ্চিন্তায় রয়েছে। মাঝে-মাঝেই সে কাঁদছে আর নানা-নানির কাছে জানতে চাইছে, ‘আম্মু ঠিক হইব তো?’ এদিকে সুখীকে আইনী সহায়তা দেবে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। সমিতির আইনজীবী শাহীন মমতাজ বলেন, মেয়েটিকে সুবিচার পেতে ও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব সহায়তাই করা হবে। সোমবার বিকেলে হাসপাতালে সুখীকে দেখতে যান বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক আফরোজা মোয়াজ্জেম। তিনি সুখীর চিকিৎসার জন্য তার মায়ের হাতে ১০ হাজার টাকা তুলে দেন। এ সময় তিনি জানান, তার নরওয়ে প্রবাসী মেয়ে প্রকৌশলী ফারহানা হক এই টাকা পাঠিয়েছে। এ ঘটনায় সুখীর ভাই মহসীন বাদী হয়ে রবিউল ও তার দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাভার থানায় মামলা করেছেন। পুলিশ হেফাজতে রবিউল দাবি করে, অন্য কারও সঙ্গে তার স্ত্রীর প্রেমের সম্পর্ক থাকায় ক্ষিপ্ত হয়ে সে এ ঘটনা ঘটায়। সাভার থানার ওসি কামরুজ্জামান জানান, রবিউল জনতার পিটুনিতে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেদিন তাকে রিমান্ডে নেয়া যায়নি। সুস্থ হলে তাকে রিমান্ডে নেয়া হবে। রবিউল এখন কারাগারে রয়েছে। মামলায় অভিযুক্ত অপর দু’জনকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি। মামলার তদন্ত সূত্রে জানা যায়, বড় ভাই ইদ্রিস আলীর ব্যবসার টাকা যোগাড় করতে রবিউল তার স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালায়। সম্প্রতি ইদ্রিস তার ছোট ভাই রবিউলকে বলে, তোমার বউকে বলো তার বাবার কাছে টাকা নিয়ে আসুক। চাপ দাও তাহলেই টাকা আসবে। বড় ভাইয়ের উস্কানিতে আরও বেপরোয়া হয় রবিউল। টাকা না আনায় সুখীকে বেশ কয়েকবার মারধরও করে সে। মুখ বুজে সব সয়ে যান সুখী। তারপরও বাবা-মাকে এ বিষয়ে কিছুই জানাননি তিনি। সুখীর বাবা নূর মোহাম্মদ বলেন, সবার কাছে দোয়া চাই। আমার মেয়ে সুখী যেন অন্তত এক চোখে দেখতে পায়। আর নির্যাতনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন তিনি। সুখীর বড় ভাই মহসিন আলীও বোনের নির্যাতনকারীদের বিচার দাবি করেন।
×