ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৃষ্টির বাগড়ায় বাংলাদেশই এগিয়ে

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২৪ জুলাই ২০১৫

বৃষ্টির বাগড়ায় বাংলাদেশই এগিয়ে

মোঃ মামুন রশীদ, চট্টগ্রাম থেকে ॥ সাগরিকায় খেলতে শুরু করেছে বৃষ্টি! প্রথমদিন নির্বিঘেœ কাটলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যে চলমান প্রথম টেস্টে বাগড়া দিচ্ছে প্রকৃতি। তবে এর মধ্যেই আলোর ঝলকানি দেখিয়েছে বাংলাদেশ দল। বোলারদের পর ব্যাট হাতেও ক্রিকেটাররা দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। সে কারণে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে ৩শ’ রানের ইনিংস পেয়েছে বাংলাদেশ। আগের দিন তামিম ইকবাল ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের জোড়া হাফসেঞ্চুরি আশা জাগিয়েছিল বড় ইনিংস গড়ার। ৪ উইকেটে ১৭৯ রান নিয়ে শেষ করে তৃতীয় দিনে সাকিব আল হাসান ও তরুণ লিটন দাসের ব্যাটে ৬ উইকেটে আরও ১৪৭ রান যোগ করে। ৩২৬ রানে প্রথম ইনিংস শেষ করে ৭৮ রানে লিড নেয় বাংলাদেশ। তবে আগের দিন ব্যর্থ হলেও এদিন ডেল স্টেইন ঝড় তুলে তিন উইকেট শিকার করেছেন। সেজন্যই বড় লিড নিতে পারেনি টাইগাররা। আর দ্বিতীয় ইনিংসে বৃষ্টির বাগড়ায় খেলা বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিনা উইকেটে ৬১ রান তুলে আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাবের পরিচয় দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে ১৭ রানে এগিয়ে থেকে এখনও নিয়ন্ত্রণটা বাংলাদেশের হাতেই। বৃষ্টির পেটে দু’দিনে গেছে প্রায় ৫০ ওভার। সম্ভাবনা আছে আরও, তাই কোন দলের নিয়ন্ত্রণে আছে ম্যাচ তা বলা মুশকিল। তবে এই মুহূর্তে সাম্যাবস্থান দু’দলের। কিন্তু দুয়েকজনের অসাধারণ নৈপুণ্য মুহূর্তেই এগিয়ে দিতে পারে যেকোন দলকে। প্রথম ইনিংসে ৪০০ রান করার লক্ষ্যের কথা জানিয়েছিল বাংলাদেশ দল। তাই তৃতীয় দিনে বাংলাদেশের শেষ ভরসা হিসেবে উইকেটে থাকা সাকিব ও মুশফিকের দিকেই নজর ছিল সবার। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারলেন না ব্যাটিং নির্ভরতা মুশফিক। টানা ১১তম ইনিংসে তিনি অর্ধশতক হাঁকাতে ব্যর্থ হলেন। তবে আগের দিন বল হাতে ব্যর্থ বিশ্বের ভয়ঙ্করতম পেসার ডেল স্টেইন ঠিকই তৃতীয় দিনের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য সাফল্য বয়ে আনলেন। আগের দিনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংগ্রহে আর ১২ রান যোগ করে ২৮ রান নিয়ে ফিরে যান তিনি। তবে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট খেলতে নেমে সাকিবকে দারুণ সঙ্গ দিতে থাকেন লিটন দাস। আর এ সুযোগে দারুণ খেলে ক্যারিয়ারের ২০তম অর্ধশতকের কাছাকাছি চলে যান সাকিব। অবশ্য এর আগেই মধ্যাহ্ন বিরতি হয়ে গেছে। প্রথম সেশনে ওই একটিই উইকেট হারিয়ে বড় বিপদ ঘটতে দেননি দারুণ খেলতে থাকা সাকিব-লিটন জুটি। আগের দিনের ৪ উইকেটে ১৭৯ রানের সঙ্গে মধ্যাহ্ন বিরতি পর্যন্ত বাংলাদেশ যোগ করে আরও ৭৩ রান। সকাল থেকেই মেঘের ঘনঘটা ছিল সাগরিকার আকাশে। তবে মধ্যাহ্ন বিরতির সময় নামলো বৃষ্টি। যে কারণে লাঞ্চের পর আধা ঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। আগের দিন ২৫ ওভার বৃষ্টির কারণে নষ্ট হয়েছিল। তৃতীয় দিন সেটা কাটিয়ে ওঠার একটা লক্ষ্য উভয়দলের। কিন্তু উল্টো এদিনও বৃষ্টির হানায় কয়েকটা ওভার নষ্ট হলো। পরে খেলা শুরু হলেও আলোর স্বল্পতা থাকায় ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে খেলা চালানো হয়েছে। কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক এ দুই আলোর সংমিশ্রণে উইকেটে ভালভাবেই টিকে থেকেছেন লিটন-সাকিব। দু’জন মিলে ষষ্ঠ উইকেটে ৮২ রানের জুটি গড়েন। এটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের সেরা ষষ্ঠ উইকেট জুটি। এর আগে সাকিব-আফতাব আহমেদ ৭০ রানের জুটি গড়েছিলেন ঢাকায় ২০০৮ সালে। সাকিব অবশ্য হাফসেঞ্চুরি হাঁকানোর পরই সাজঘরে ফিরে যান। হারমারের সেই ওভারটিতে কেমন যেন এলোমেলো ব্যাট চালাচ্ছিলেন সাকিব। ওভারের দ্বিতীয় বলেই মিড উইকেটে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নো ম্যানস ল্যান্ডে পড়ার কারণে বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওভারের শেষ বলে একই ধরনের শট খেলতে গিয়ে আত্মাহুতি দিলেন তিনি। শর্ট মিডউইকেটে এবার খুব সহজেই ক্যাচটা তালুবন্দী করলেন জেপি ডুমিনি। ৪৭ রানে ফিরে যান সাকিব। ততক্ষণে এ জুটির কল্যাণে কাক্সিক্ষত লিড নিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। সাকিব ফিরে যাওয়ার পর বাকিদের দায়িত্ব তখন শুধু লিডটাকে যতখানি সম্ভব বাড়িয়ে নেয়ার। বিশেষ করে লিটন দারুণ এক ইনিংস উপহার দিয়েছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন তিনি। তবে সাকিব ৪৭, তামিম ৫৭ ও মাহমুদুল্লাহ ৬৭ করার পর যারা ভাল করেছেন সেই কাতারে প্রত্যাশা করা হচ্ছিল ওই ধারা অনুসারে লিটনের উইলো থেকে বেরিয়ে আসবে ৭৭ রানের একটি ইনিংস। কিন্তু ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে ১০২ বলে ৭ চারে ৫০ রান করার পরই হারমারের বলে সাজঘরে ফেরত যান তিনি। লিটন চলে যাওয়ার আগেই অবশ্য শহীদ ২৫ রানের একটি ঝড়ো ইনিংস খেলেছেন। যার কারণে বাংলাদেশ ৩শ’ রানে পৌঁছতে পেরেছে দ্রুত। তিনি হারমারের এক ওভারে তিন চার ও ছক্কা হাঁকিয়ে ১৮ রান তুলে নেন। তবে লিটন-শহীদ দু’জনেই ফিরে যাওয়ার পর আর কেউ সুবিধা করতে পারেননি। সেটা না হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের টেলএন্ডারদের ওপর স্টেইনের গতি ঝড়! যে বোলারকে নিয়ে ভয় ছিল বাংলাদেশ শিবিরের, সেই স্টেইন জ্বলে উঠলেন, ফিরিয়ে দিলেন তাইজুল ইসলাম ও মুস্তাফিজুর রহমানকে। তৃতীয় দিনের শুরুতে অধিনায়ক মুশফিককে ফিরিয়ে দিয়ে শুরু করেছিলেন এবং মুস্তাফিজকে শিকার করে বাংলাদেশের ইনিংস ৩২৬ রানে শেষও করে দিলেন ওই স্টেইন। আগের দিন ১২ ওভার করেও কোন উইকেট না নিতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ৭৮ রানে তিন উইকেট নিয়ে তিনিই প্রোটিয়াদের সফলতম বোলার। হারমার বেদম পিটুনি খেয়েছেন, কিন্তু তিনিও নিয়েছেন তিন উইকেট। বরাবরই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে একেবারেই অসহায় ছিল বাংলাদেশ। গৌরব করার মতো কোন ঘটনার জন্ম দিতে পারেনি। তবে এই প্রথম বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তিন শ’ রানে পৌঁছতে পারলো। এর আগে খেলা আট টেস্টে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টাইগারদের সর্বোচ্চ দলীয় ইনিংস ছিল ২৫৯ রানের। সেটি ২০০৮ সালে এই চট্টগ্রাম টেস্টেই করেছিল বাংলাদেশ। এবার সেটা পেরিয়ে গেল মুশফিকের দল। ৩২৬ রানে শেষ করে বাংলাদেশ লিড নেয় ৭৮ রানের। টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হওয়ার পর প্রোটিয়াদের বিপক্ষে লিডে থাকল টাইগাররা দ্বিতীয়বারের মতো। ২০০৮ সালে ঢাকা টেস্টে প্রথম ও শেষবার দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে লিড নিতে পেরেছিল। এছাড়া ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করে প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লিড নেয়ার এটি পঞ্চম ঘটনা টাইগারদের। সর্বপ্রথম ২০১২ সালে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেটা করেছিল বাংলাদেশ। এছাড়া ২০১৩ সালে চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ড ও গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে এবং গত বছর মিরপুরে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে প্রতিপক্ষের পরে ব্যাটিং করেও লিড নিতে পেরেছিল। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও কিউইদের বিপক্ষে ড্র এবং জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে জিতে গেলেও ক্যারিবীয়দের কাছে হেরে গিয়েছিল। বৃষ্টির কারণে দ্বিতীয় দিন শেষ সেশন এবং তৃতীয় দিন দ্বিতীয় সেশনে বেশকিছু ওভার খেলা হয়নি। সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে চা বিরতি এক ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। চা বিরতির আগ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে বিনা উইকেটে ২৩ রান তুলে ফেলে। চা বিরতির পর ঝলমলে রোদে খেলা শুরু হয় এবং প্রোটিয়ারাও দারুণ ব্যাট চালাচ্ছিল। সাবলীল ভঙ্গিতেই খেলছিলেন দুই প্রোটিয়া ওপেনার ডিন এলগার ও স্টিয়ান ভ্যান জাইল। কিন্তু আলোর স্বল্পতার কারণে খেলা বন্ধ হয়ে যায়। পরে বৃষ্টি আসায় আর খেলা সম্ভব হয়নি। এদিনও প্রায় ২৫ ওভার খেলা হয়নি। বিনা উইকেটে ৬১ রান তুলে ফেলে বড় সংগ্রহ গড়ারই ইঙ্গিত দিচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বিতীয় ইনিংসে। তবে এখনও তারা পিছিয়ে ১৭ রানে। বাংলাদেশী বোলারদের জন্য আজ চতুর্থ দিনে আরেকবার জ্বলে ওঠার দিন। প্রথম ইনিংসে বোলাররা এবং ব্যাটসম্যানরা দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে এখন পর্যন্ত বলা যেতেই পারে ভাল অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। কিন্তু আরেকবার বোলাররা ভাল করতে না পারলে নিয়ন্ত্রণটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
×