ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃসময়ে মুশফিক

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ২৪ জুলাই ২০১৫

ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃসময়ে মুশফিক

স্পোর্টস রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে ॥ একজন অধিনায়ক দলকে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে। নৈপুণ্য তো অবশ্যই, এর পাশাপাশি আচরণ এবং দলের অন্য ক্রিকেটারদের সঙ্গে সদ্ভাব ধরে রাখা, মাঠে শক্ত হাতে সব পরিস্থিতি সামাল দেয়া ইত্যাদি। এর কোন কিছুতেই কখনও সমস্যা দেখা যায়নি বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের মধ্যে। তবে নৈপুণ্য না থাকলে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থাকে, বেরোতে থাকে একজন ক্রিকেটারের দোষ-ত্রুটি। সামান্য ভুলটাও তখন বড় হয়ে যায়। বর্তমানে একেবারেই ছন্দে নেই বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিক। ব্যাট হাতে টানা ব্যর্থতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি এখন পর্যন্ত। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে চট্টগ্রামে চলমান প্রথম টেস্টেও ব্যাট হাতে বড় কোন সংগ্রহ গড়তে পারেননি তিনি। ধারাবাহিকভাবে ব্যাটে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে বাংলাদেশ দলের মিডলঅর্ডারের স্তম্ভ হয়ে যাওয়া এবং ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ নাম কুড়িয়ে ফেলা মুশফিক এবার আউট হয়ে গেছেন ২৮ রানেই! তারচেয়ে বড় কথা মুশফিকের দিকেই ভরসা নিয়ে পুরো বাংলাদেশ ম্যাচের তৃতীয় দিনে তাকিয়ে ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকাকে চাপে ফেলার জন্য তার ব্যাটে আবার রান আসাটা অতীব জরুরী ছিল। সেই আস্থার প্রতিদান দিতে পারেননি। এ নিয়ে ১১ ইনিংস অর্ধশতক করতে পারেননি টাইগারদের এ নির্ভরতা। ৪৭ টেস্টের ক্যারিয়ার ঘেঁটে এমন ব্যর্থতা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি টাইগার দলপতির। সেদিক থেকে সবচেয়ে দুঃসময় কাটাচ্ছেন মুশফিক! অভিষেকটা হয়েছিল স্বপ্নের মতো। না ব্যাট চালিয়ে দারুণ কিছু করে কোন স্বপ্নকে বাস্তব করেছিলেন বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু ‘ক্রিকেট মক্কা’ খ্যাত ঐতিহাসিক ক্রিকেট মাঠ লর্ডসে খেলার স্বপ্ন সব ক্রিকেটারই দেখেন। আর সবচেয়ে মর্যাদার ফরমেট টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করলেন মুশফিক এই মাঠেই। সেদিন ব্যাট হাতে ব্যর্থ ছিলেন। কিন্তু কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের তৃতীয় টেস্টেই ৮০ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংস উপহার দিয়ে নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করেছিলেন। এরপরেই ঘটে ছিল ছন্দপতন। টানা ১০ ইনিংস এরপর আর কোন অর্ধশতক দেখা দূরের কথা, ১৫ রানের ইনিংস পেরোতে পারেননি! অনেকেই তখন খালেদ মাসুদ পাইলটের উপযুক্ত উত্তরসূরি হিসেবে মুশফিকের বিকল্প খোঁজার কথা বলতে শুরু করেছিলেন। কারণ ওই সময় টানা ১০ ইনিংসে তিনি ৬.৭৭ গড়ে করতে পেরেছিলেন ৬১! ইনিংসগুলোর চেহারা ছিল এমন- ১১*, ১, ৭, ৬, ৮, ০, ৭, ২, ১৫ ও ৪! ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এটিই এতদিন ছিল তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন দুঃসময়! এর মধ্যে তিনটি ইনিংস অবশ্য দেশের মাটিতে খেলেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নতুন হিসেবে ৭ ইনিংসই দেশের বাইরে খেলতে হয়েছিল বিধায় অনেকে সেটাকে কিছুটা স্বাভাবিক চোখেই দেখেছেন। তাছাড়া বাংলাদেশ দলগতভাবেই সে সময়টাতে তেমন কোন আহামরি নৈপুণ্য দেখাতে পারেনি। মুশফিক ক্যারিয়ারে অবশ্য এখন দেশ ও দেশের বাইরের নৈপুণ্যে একটা সামঞ্জস্য আনতে পেরেছেন। দেশের মাটিতে ২৮ টেস্টে ৩২.২১ গড়ে ১৪৮২ আর দেশের বাইরে ১৯ টেস্টে ৩১.৫১ গড়ে ১১০৩ রান করেছেন তিনি। সেই দুঃসময়টা কাটিয়ে উঠে ধারাবাহিকভাবে ভাল নৈপুণ্য দেখাতে শুরু করেছিলেন মুশফিক। কিন্তু আবার ছন্দপতন ঘটেছিল ঠিক দুই বছর পর। ২০১০ এর মার্চ থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত খেলা ৮ ইনিংসে করেছিলেন ১৬.০০ গড়ে ১২৮ (৩০, ৩, ১৬, ০, ১১, ১৩, ২৭ ও ২৮)। এরপরও তিনি সে বছরই বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক মনোনীত হন। দলের খেলোয়াড় হিসেবে তার ২৪ ম্যাচের ৪৭ ইনিংসে ২৭.১৬ গড়ে একটি শতক ও ছয় অর্ধশতকসহ এসেছিল ১১৯৫ রান। কিন্তু দলনেতা হওয়ার পর থেকেই সম্ভবত দায়িত্ববোধটা বেড়ে গিয়েছিল তার। ক্রমেই নিজেকে ব্যাট হাতে মেলে ধরতে শুরু করেন এবং অধিনায়ক হিসেবে এখন পর্যন্ত ২৩ ম্যাচে ৪০ ইনিংস খেলে ৩৭.৫৬ গড়ে করেছেন দুটি সেঞ্চুরি ও আট অর্ধশতকসহ ১৩৯০ রান। এর মধ্যে দেশের টেস্ট ইতিহাসে চিরস্মরণীয় ইনিংস খেলেছেন গলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০১৩ সালের মার্চে। বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে সেদিন তিনি ২০০ রানের ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন। ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সময়টা ছিল ২০১৩ সালের ৮ মার্চ থেকে গত বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলা ১৪ ইনিংসে। এ সময় তিনি করেছেন ৫৭.৬৯ গড়ে ৭৫০ রান। আর নাম হয়ে গেছে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে অধিনায়ক হিসেবে ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান অনেক ভাল হলেও এর মধ্যেই সবচেয়ে বাজে সময়টা রয়েছে তার। সম্প্রতি মূল পরিচয়টা উইকেটরক্ষক হলেও সেই দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালনে চরম বাজে প্রদর্শনীতে সমালোচিত হয়েছেন। এর মধ্যে আবার ব্যাটেও রান পাননি। গত ১০ ইনিংসে তিনি হাফসেঞ্চুরি পাননি। কিন্তু ব্যাটিং নির্ভরতা হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে তৃতীয় দিন তার ওপরই আস্থা ছিল দলের। আগের দিন বেশ স্বাচ্ছন্দ্য দেখিয়ে ১৬ রান করে অপরাজিত ছিলেন। কিন্তু প্রোটিয়াদের বিপক্ষে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অতীব জরুরী ছিল মুশফিকের জ্বলে ওঠা। সেটা পারেননি, আর ১২ রান করেই ডেল স্টেইনের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে গেছেন সাজঘরে। আগের দিন পুরোটা সময় বোলিং করে ব্যর্থ দিন কাটিয়েছিলেন বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট বোলার স্টেইন। তিনি সফল হন মুশফিককে শিকার করে। ৬১ বলে ৫ চার ও ১ ছক্কায় ২৮ রান করেন মুশফিক। টানা ১১ ইনিংস অর্ধশতক বঞ্চিত। এই ১১ ইনিংসে তিনি করেছেন ১৬.৯০ গড়ে ১৬৯ (২৩*, ১১, ০, ১৫, ৪৬, ৩২, ০, ১২, ০, ২ ও ২৮)। মুশফিকের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বাজে সময়। অথচ এই ইনিংসগুলো তিনি খেলেছেন দেশের মাটিতে। কোনভাবেই ব্যর্থতা কাটিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে পারছেন না বাংলাদেশের মিডলঅর্ডারে অন্যতম নির্ভরতা!
×