ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুর্ঘটনার জন্য ৯১ ভাগ দায়ী চালক ;###;পরীক্ষা ছাড়া লাইসেন্স পান ৬১ ভাগ চালক ;###;সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম;###;প্রতিদিন গড়ে প্রাণ হারায় অর্ধশত যাত্রী

আরও ১৬ প্রাণ গেল ॥ পথে পথে মৃত্যু

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৫ জুলাই ২০১৫

আরও ১৬ প্রাণ গেল ॥ পথে পথে মৃত্যু

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সারাদেশে অবৈধ চালকের সংখ্যা ৩৩ লাখেরও বেশি। রেজিস্ট্রেশনবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। ৬১ ভাগ চালক কোনরকম পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স পাচ্ছেন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ৯১ ভাগ চালক। অর্থাৎ অবৈধ চালক আর পরিবহনের দখলে দেশের ৩৬১ রুট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অর্ধশত যাত্রী প্রাণ হারাচ্ছে। সরকারী হিসাব বলছে, প্রতিবছর গড়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার! সড়ক দুর্ঘটনার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। গোটা বিশ্বে যে ২০ কারণে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা দ্বিতীয়। বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অদক্ষ চালক দিয়ে পরিবহন পরিচালনা, অতিবৃষ্টির কারণে মহাসড়কে পানি জমে গর্ত হওয়া, সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল ও নসিমন-করিমনসহ অটোরিক্সার দৌরাত্ম্যই সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। গেল এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় অকালে ঝরেছে প্রায় দেড় শতাধিক তাজা প্রাণ। গতকাল শুক্রবারই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৬ জনের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেই। সড়কে দিন দিন বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাড়ছে। বছরে বাড়ছে ১০ ভাগ পরিবহন। এ সেক্টরে অরাজকতা কোন অবস্থাতেই রোধ করা যাচ্ছে না। দোষীরা আসছে না শাস্তির আওতায়। এজন্য দায়ী করা হচ্ছেÑ দুর্বল মোটরযান অধ্যাদেশ আইন, বিআরটিএ থেকে শুরু করে পুলিশ প্রশাসন, পরিবহন মালিক-শ্রমিকসহ যাত্রীদেরও। বলা হচ্ছে, দ্রুত সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এর ভয়াবহতা দিন দিন আরও বাড়বে। বাড়বে লাশের মিছিল। স্বজনহারা পরিবারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। বুক খালি হবে অসংখ্য মায়ের; কান্না থামবে না...। কেন বাড়ল দুর্ঘটনা ॥ বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে, ঈদ উৎসবের পর সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ে। এর কারণ হিসেবে পরিবহন চালক ও মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, ঈদের সময় সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির চাপ থাকে অনেক বেশি। গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে যানজট থাকে। স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলতে না পারায় দুর্ঘটনাও কম হয়। ঈদের পর ফাঁকা রাস্তার কারণে অনেক সময় চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোয় দুর্ঘটনা হয়। এছাড়াও উৎসবের সময় দক্ষ চালকরা অনেকেই ছুটিতে যান। এ সুযোগে আন্তঃজেলা থেকে শুরু করে দূরপাল্লার অনেক বাস চালান অদক্ষ চালকরা। ফলে দুর্ঘটনা বাড়ে। নসিমন, করিমন, কাভার্ডভ্যান থেকে শুরু করে মাইক্রো চালকরা যাত্রীবাহী বাস চালাতে শুরু করেন। পাশাপাশি ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ির আধিক্য তো আছেই। অনুমোদনহীন যানবাহনও দেদার চলে সড়কে। দেখা যায়, প্রাইভেটকার চালক ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ায় মহাসড়কে গাড়ি চালান মালিক নিজেই। এক্ষেত্রে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাবে সড়ক দুর্ঘটনা হয়। এবছর সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদের পর ৬০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে অতিবৃষ্টির কারণে রাস্তায় পানি জমে গর্ত সৃষ্টি হওয়ায়। তিনি বলেন, অতিবৃষ্টিতে বিভিন্ন মহাসড়কে সৃষ্ট খানাখন্দে পানি জমেছে। গর্তে চাকা পরার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির স্ট্রিং লিভ ভেঙ্গে যায়। এর পরপরই পুরো গাড়িটি চালকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। স্টিয়ারিং, ব্রেক কিছুই কাজ করে না। তিনি বলেন, চালকরা ভাল রাস্তা দেখে গেলেও ফিরে আসতে আসতে রাস্তায় পানি জমে গর্ত হচ্ছে। তাছাড়া পানির নিচে গর্ত খেয়াল করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে অনুপযোগী হয়েছে। মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল বন্ধে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। এক সপ্তাহে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত ॥ ঈদের ছুটিতে সিরাজগঞ্জে ১৭ জনসহ ৬২ জন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। ২২ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় ২০ জন। ২৩ জুলাই গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় ৩০ জন। শুক্রবার ছুটির দিনে মাদারীপুর, গাজীপুর, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে অন্তত ১৬ জন। রুট পারমিট ও ফিটনেস ছিল না সাব্বির পরিবহনের ॥ ঈদের পরদিন সিরাজগঞ্জের মুলিবাড়িতে দুটি বাসের সংঘর্ষে ১৭ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হওয়ার ঘটনায় সাব্বির পরিবহনের বাসকে দায়ী করেছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে কমিটি বলেছে, বাসটির রুট পারমিট ছিল না। ছিল না ফিটনেসও। ত্রুটিপূর্ণ এই বাসের কারণেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। তদন্ত শেষে কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনোয়ার পাশা বুধবার বিকেলে প্রতিবেদনটি জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেন। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য দুটি বাসের মধ্যে সাব্বির পরিবহনের বাসকেই দায়ী করেছে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। কারণ বাসটির কোন ফিটনেস ছিল না। ২০১২ সালে বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ পার হয়েছে। একই সঙ্গে ওই পরিবহনের কোন রুট পারমিটও ছিল না। কমিটি অবিলম্বে ফিটনেসবিহীন যানবাহন বাতিলের পাশাপাশি মহাসড়কে গতিরোধক ও সড়ক বিভাজক নির্মাণ ও যানবাহনের গতি কমানোসহ ১১টি বিষয়ে সুপারিশ করেছে। গেল রবিবার সংঘটিত দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ তদন্ত কমিটি গঠন করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের (এআরআই) প্রধান ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমার কোন লক্ষণ নেই। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গাড়ি কমেনি। দিন দিন বিশৃঙ্খলা বাড়ছে সকল সড়ক মহাসড়কে। সড়কের ভূমি ব্যবহার বৃদ্ধিসহ নসিমন-করিমন ও অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচলের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে সমানতালে। অবৈধ চালক, ফিটনেসবিহীন পরিবহনের সংখ্যাও কমেনি। বছরে ৮-১০ ভাগ গাড়ি বাড়ছে। দুর্ঘটনা কমানোর দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থা নেই। ফলে এর মাত্রা দিন দিন আরও বাড়ার আশঙ্কা এই পরিবহন বিশেষজ্ঞের। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রতিদিন ৩৩ জন মানুষ দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে ৫০ জন। এর মধ্যে ১০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে রাজধানী ঢাকায়। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, দিনে নিহতের সংখ্যা মাত্র আটজন। এ প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, মামলার প্রেক্ষিতে পুলিশ পরিসংখ্যান তৈরি করে। নানান হয়রানির কারণে বেশিরভাগ মানুষ দুর্ঘটনার পর মামলা করেন না। এ কারণে পুলিশের পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত চিত্র ওঠে আসে না। শর্ত পূরণ ছাড়াই ১৪ লাখের বেশি লাইসেন্স ॥ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারিগরিসহ যথাযথভাবে সকল পরীক্ষা নিয়ে লাইসেন্স দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ)। বেশিরভাগ শর্ত পূরণ ছাড়াই এ পর্যন্ত ১৪ লাখের বেশি লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। ৬৪ জেলায় চোখের দেখায় লাইসেন্স সনদ পাচ্ছেন চালকরা। অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষক ও ডাক্তারের সার্টিফিকেট নকল করে মিলছে বৈধ চালকের সনদ। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ওস্তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে এমন চালকের সংখ্যাই বেশি। অনুমোদিত শতাধিক ড্রাইভিং স্কুলের কোন তদারকি নেই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে চালকদের বিরুদ্ধে নেই কঠোর আইনী ব্যবস্থা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, ৬১ ভাগ চালক কোনরকম পরীক্ষা ছাড়াই লাইসেন্স পাচ্ছেন। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ৯১ ভাগ চলক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে তিন ধরনের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সকল শর্ত পূরণ করতে হবে। সঠিক পদ্ধতি মেনে লাইসেন্স দেয়া হলে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বাড়াতে হবে শাস্তি। শিক্ষিতদের আনতে হবে চালকের পেশায়। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তারা। চালকদের মধ্যে একটি বড় অংশই নেশাগ্রস্ত। ভাড়ায় গাড়ি চালানো ও নেশা করার কারণে রাজপথে চালকরা অনেক সময় বেপরোয়া। ১৯৯০-২০১১ সাল পর্যন্ত শ্রমিক ফেডারেশনের তালিকা ধরে প্রায় ১ লাখ ৮৯ হাজার পেশাদার চালককে লাইসেন্স দেয়া হয় যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই। সারাদেশে লাইসেন্স আছে ১৪ লাখ ৩১ হাজার। এর মধ্যে পেশাদার লাইসেন্স প্রায় ৭ লাখ। সাত লাখের মধ্যে ২ লাখ ৩৭ হাজার ভারি যানবাহন; অর্থাৎ বাস, ট্রাক, লরি, কাভার্ডভ্যানের চালক। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। এরপরই নেপালসহ আফ্রিকার দেশগুলোয়। দুর্ঘটনার পর মামলায় সাজার দিক থেকে শতকরা ৮৩ ভাগ আসামিই থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। সুষ্ঠু তদন্ত ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে না বেশিরভাগ মামলা। বিচার শুরুর আগেই আপোসরফা হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় ফৌজদারি আইনে সর্বোচ্চ দ- এখন তিন বছর। অপরাধ জামিনযোগ্য! এমনকি আপোসযোগ্যও। দুর্ঘটনার পর একটি গাড়ি আটকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই থানা থেকে ছাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। মোটরযান অধ্যাদেশ আইনে সর্বোচ্চ কারাদ- চার মাসসহ জরিমানা ৫শ’ টাকা। যদিও আদালতের নির্দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সাজা এখন সাত বছর। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রাজধানীতে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত পরিবহনের সংখ্যা আট লাখ ৯৬ হাজার ১৯৩টি। একই সময় পর্যন্ত সারাদেশে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত মোট পরিবহনের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২১ লাখ। বেসরকারী গবেষণা বলছে, দেশে মোট যানবাহনের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি! তালিকাভুক্তির বাইরে প্রায় ১৯ লাখ অবৈধ যানবাহন দেশে। এর মধ্যে ফিটনেস ছাড়াই চলছে তিন লক্ষাধিক যানবাহন। লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা ১৩ লাখ। সরকারী হিসাব অনুযায়ী সাত লাখ অবৈধ চালক রেজিস্ট্রেশনভুক্ত যান চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮ লাখ নসিমন, করিমন, ভটভটি বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে, যার একটিও সরকারীভাবে অনুমোদিত নয়। ৩ লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইক মহাসড়কে চলতে দিয়ে কোন অবস্থাতেই নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন সক্ষম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬টি যানবাহন প্রতিবছর মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ছে। এই পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬৯ জন। দুর্ঘটনার কারণে দেশের ২ শতাংশ জিডিপি ক্ষতি হচ্ছে। গোড়ায় গলদ ॥ চালকদের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সচিব মুহাম্মদ শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রতিটি জেলায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি চালকদের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে চালকদের লিখিত, মৌখিকসহ ব্যবহারিক পরীক্ষা নেয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য পাঁচ কিলোমিটার মাঠ, রাস্তা, যান সঙ্কটসহ মেকানিক্যাল কোন ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব যান না থাকায় চালকের দক্ষতা নিরূপণের ব্যবস্থা প্রায় শূন্যের কোটায়। তিনি বলেন, প্রতিটি কমিটিতে একজন ডাক্তার থাকেন চালকের চক্ষুসহ ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য। চালক রং, ট্রাফিক সাইন, রাতে চালাতে পারে কিনাÑ এসব বিষয় দেখভাল করেন। বাস্তবে এমন মনিটরিং খুব একটা হয় না। এছাড়াও একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর চালকের সিগন্যাল টেস্ট পরীক্ষা নেন। তা যথাযথ হয় না। তিনি বলেন, চালকরা সকল নিয়মকানুন বা শর্ত পূরণ করে লাইসেন্স পেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। কিন্তু নানান সীমাবদ্ধতার কারণে সকল শর্ত পূরণ করে চালকদের লাইসেন্স দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। বছরে মারা যাচ্ছে ১৮ হাজার মানুষ ॥ সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত সরকারী পরিসংখ্যানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যে কোন মিল নেই। বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পৃথক দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১২ হাজার। প্রতিদিন মরছে ৩৩ জন মানুষ। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা একটি মরণব্যাধি। সারা পৃথিবীতে যে ২০ কারণে মানুষ মরছে এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার স্থান দ্বিতীয়। এটি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে এক সময়ে পৃথিবীজুড়ে মানুষ মৃত্যুর প্রধান কারণ হবে সড়ক দুর্ঘটনা। সংস্থাটির বাংলাদেশের দুর্ঘটনা অংশে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দেশটিতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৮ হাজার। দিনে মারা যাচ্ছে ৫০ জন মানুষ। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, গেল সাত বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহতের সংখ্যা ৩০ হাজার ৭৫৭টি। এ সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে ১৮ হাজার ৭৯৮টি। মারা গেছে ১৭ হাজার ২৬০ জন। ২০১১ সালের দুই হাজার ৬৩৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৫৪৬। ২০১২ সালে দুই হাজার ৬৩৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৫৩৮। ২০১৩ সালে দুই হাজার ২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে এক হাজার ৯৫৭ জন। ২০১৪ সালের মে মাস পর্যন্ত ৮১৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা সাড়ে ৮শ’ জন। দুর্ঘটনায় দোষীদের সাজা ৭ বছর ॥ সামরিক শাসক এরশাদের আমলে দ-বিধি সংশোধন করে সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় সাজা কমানোর সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। গত বছরের ২০ অক্টোবরের রায়ে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় দোষ প্রমাণিত হলে আগের মতোই সর্বোচ্চ সাত বছরের কারাদ-ের বিধান বহাল হবে। রায়ে বলা হয়, এই সংশোধনী বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ১৯৮৫ সালে তখনকার এরশাদ সরকার দ-বিধির ৩০৪ (বি) ধারা সংশোধন করে সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় সর্বোচ্চ সাজা সাত বছর কারাদ- থেকে কমিয়ে তিন বছর করে। অথচ জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে দুর্ঘটনায় চালকের দায় প্রমাণিত হলে ১০ বছরের বেশি কারাদ-ের বিধান রয়েছে। এছাড়া আমেরিকায় বিভিন্ন প্রদেশে দুর্ঘটনার জন্য সর্বোচ্চ ৯৯ বছর পর্যন্ত দ-ের বিধান আছে। আরও ১৬ জন নিহত সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৬০ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরে কাভার্ডভ্যান ও লেগুনার সংঘর্ষে পাঁচজন, মাদারীপুরের কালকিনিতে মাইক্রো-লোকাল বাসের সংঘর্ষে পাঁচজন, টাঙ্গাইলে তিনজন এবং বরিশাল, নীলফামারী ও ময়মনসিংহের ভালুকায় একজন করে নিহত হয়। বৃহস্পতিবার রাত ও শুক্রবার পৃথক দুর্ঘটনায় এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে। খবর নিজস্ব সংবাদদাতা ও স্টাফ রিপোর্টারের। গাজীপুরে শুক্রবার কাভার্ডভ্যান ও যাত্রীবাহী লেগুনার মুখোমুখিু সংঘর্ষে দুই নারীসহ পাঁচজন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। নিহতরা হলেন শেরপুরের ঝিনাইগাঁতি থানার কান্দুলি গ্রামের হযরত আলীর ছেলে লেগুনা চালক সাইদুল (২০), পটুয়াখালীর গলাচিপার ছোট সিবা গ্রামের আবুল বাশার সরদারের ছেলে সোহেল মিয়া (৩০), মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানার হলাগাঁও গ্রামের ফখরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা বেগম (২৮) এবং গাজীপুরের ভোগড়া এলাকার তমির শেখের স্ত্রী মনিরা বেগম (২৬)। নিহত অপরজনের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। হতাহতদের সবাই লেগুনার যাত্রী। কালকিনি ॥ শুক্রবার দুপুর একটায় মাদারীপুরের কালকিনির গোপালপুরে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের মেলকাই এলাকায় মাইক্রো ও লোকাল বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচ যাত্রী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ১২ জন। বরিশাল থেকে ১৪ যাত্রী নিয়ে মাওয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসা মাইক্রোবাসটি কালকিনির গোপালপুরের মেলকাই এলাকায় পৌঁছলে বিপরীত দিক থেকে আসা ভুরঘাটাগামী ‘মায়ের দোয়া’ লোকাল বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হয়। নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি। সুমন খন্দকার (২৫), আনসারী (৩০), শারমীন (১৮), মকবুল হোসেন (৪৫) ও আনোয়ার হোসেন (৬০)সহ কমপক্ষে ১২ জন গুরুতর আহত হন। আহতদের কালকিনি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। টাঙ্গাইল ॥ টাঙ্গাইল শহর বাইপাস দরুন এলাকায় শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে বাসচাপায় সেলিম মিয়া (২৬) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। সেলিম সদর উপজেলার দরুন এলাকার সিরাজ মিয়ার ছেলে। এদিকে মির্জাপুরের সোহাগপুর এলাকায় গাইবান্ধাগামী যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে দু’জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৩০ জন। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে। আহতদের মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নীলফামারীর রোকনুজ্জামান ও গাইবান্ধার সাহারুন মারা যান। আহত ১৫ জন কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। বরিশাল ॥ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের গৌরনদীর কটকস্থলে শুক্রবার দুপুরে বাসচাপায় নাসির উদ্দিন হাওলাদার (৩০) নামে এক মোটরসাইকেল চালক নিহত এবং শহীদ ও সেলিম মিয়া নামে দুই আরোহী গুরুতর আহত হয়েছেন। নিহত নাসির উজিরপুরের ওটরা গ্রামের উজ্জ্বল হাওলাদারের ছেলে। একইদিন দুপুরে গৌরনদী-সরিকল সড়কের পিঙ্গলাকাঠী বাজারের সিরাজ মৃধার চায়ের দোকানে চলন্ত প্রাইভেটকার ঢুকে গেলে আটজন আহত হয়। গুরুতর আহত দুলাল সিকদার, আরজ আলী সিকদার, সালাউদ্দিন গাজী ও সোহরাব সিকদারকে শেবাচিম ও অন্যদের স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নীলফামারী ॥ নীলফামারীতে ট্রাক্টর উল্টে চালক আইয়ুব আলী (২৭) নিহত হয়েছেন। শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে শহরের কলেজ স্টেশনের কাছে হাড়োয়া গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত আইয়ুব হাতিবান্ধা গ্রামের জোবেদ আলীর ছেলে। এছাড়া জলঢাকায় বেইলি ব্রিজ ভেঙ্গে বালি বোঝাই একটি ট্রাক ও মোটরসাইকেল নদীতে পড়ে গেলে তিনজন গুরুতর আহত হন। আহতরা হলেন ট্রাকচালক ইয়াকুব আলী (৪৫), হেলপার রাসেল (৩০) ও মোটরসাইকেল আরোহী সুমন (৩৫)। তাদের জলঢাকা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে পঞ্চগড়-ডোমার-জলঢাকা-রংপুর সড়কের জলঢাকার অদূরে আউলিয়াখানা নদীতে এ ঘটনা ঘটে। ভালুকা ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, ভালুকা থেকে জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কাঁঠালী ইনডেক্স মিলের সামনে শুক্রবার সন্ধ্যায় গাড়ি চাপায় অজ্ঞাত যুবক (২২) ঘটনাস্থলেই মারা যায় । নিহতের মাথা থেঁতলে যাওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
×