ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

মৃণালের ফরিদপুর বার্লিনেও

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৫ জুলাই ২০১৫

মৃণালের ফরিদপুর বার্লিনেও

ফেব্রুয়ারি, কনকনে শীত। তুষারে আচ্ছন্ন তল্লাট, যেন মৃতের শাদা কাফনে আবৃত। বিকেল সাড়ে চারটেয় সঘন কালো আঁধার। নিয়নবাতির নরম আলোয় তুষার আরো ধবধবে, মায়াবী। মৃণাল সেনের শরীর মজবুত নয় আজ, ক্লান্ত। এসেছেন দুপুরের ফ্লাইটে, কলকাতা থেকে বোম্বে -ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে পশ্চিম বার্লিনে (তখনও বার্লিন বিভক্ত, পূর্ব-পশ্চিম) বারো ঘণ্টার বেশি জার্নি। বিস্তর ধকল। তা হোক, মৃণাল সেন বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রিত। ওঁর কোনও ছবি নেই এবার, কিন্তু বিশেষ অতিথি। সন্ধে থেকে একটার পর একটা মিটিং। ডিনার, পার্টির ঝামেলা তো আছেই। বললেন, ‘ভাই, আজ আড্ডা নয়, বিশ্রাম নেব। হোটেল ঘর বেশ গরম, অবশ্য হিটার সহ্য হয় না। কাল থেকে আড্ডা, যখন সময় পাবো। সময় পাবো কি-না জানি না, সকালে ব্রেকফাস্টের সময় এসো, সিডিউল দেখে জানাবো, কখন কতটা-সময় ঘরে থাকবো। ধীরাজ রায়কে খবর দিও।’ ধীরাজ রায়কে কেন? প্রশ্নের সহজ উত্তর, ‘ধীরাজ ফরিদপুরের। এখনও ফরিদপুরী টানে কথা কয়, এত বছর বার্লিনে থেকেও। প্রথম যখন বার্লিনে আসি, ধীরাজই প্রথম বাঙালী শনাক্ত করে আমাকে।’ বললুম, ফরিদপুরী বাঙালকে ফরিদপুরি ছাড়া কে চিনিবে বিভুঁইয়ে। আটাশ বছর আগের কথা বলছি। ডায়েরিতে যা লেখা, কথোপকথনসহ, হুবহু উদ্ধৃতি। মৃণাল সেনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেন গৌতম ঘোষ, সত্তর দশকের দ্বিতীয় পর্বে। মৃণাল সেন তখন দেশপ্রিয় পার্কের এক ভাড়া বাসায় (কলকাতার লোকে কয় বাড়ি), প্রিয়া সিনেমা হলের পেছনে। গৌতমের সঙ্গে বন্ধুতার কথামালা ভিন্ন। ওঁর স্ত্রী খুকু (নীলান্জনা) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের ছাত্রী, সহপাঠিনী নন, এক ইয়ার সিনিয়র, কিন্তু বন্ধু। বন্ধুতার সুবাদেই খুকু আমাদের গৌতমের প্রথম তথ্যচিত্র প্রদর্শনীরও আয়োজন করেন। মৃণাল সেনের সঙ্গে গৌতম এই বয়ানে পরিচয় করিয়ে দেন : ‘ছেলেটি বাঙাল। মুক্তি যোদ্ধা।’ (ডায়েরিতে লেখা)। মুক্তিযোদ্ধা নই, বলিনি। চেপে যাই। মৃণাল সেন আঁড় চোখে দেখে নিশ্চয়ই সন্দেহ করেন। মৃণাল সেনকে কবে থেকে মৃণালদা বলি, বলতে অপারগ। তাঁর পারিবারিক নই, তবে ঘরোয়া। কেচ্ছা বটে। কুনালের স্ত্রী (মৃণাল-গীতা সেনের পুত্র, একমাত্র সন্তান।) নিশা রূপারেল, নিশার ছোটবোন জাগৃতি (রূপারেল) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীর ছাত্রী। একই করিডরে নিত্যদিন দেখা, পড়ি তুলনামূলক সাহিত্য। একই ইয়ারে। জাগৃতির পয়লা সই ইনামিনা (উর্মিমালা লাহিড়ী। কঞ্চিদি তথা অপালা ঘটকের কন্যা। কবি-অনুবাদক-সাংবাদিক সমীর দাশগুপ্তকে বিয়ে করে অপালা দাশগুপ্ত। ইনামিনা এখন ইনাপুরী নামে খ্যাত। আর্ট কালেক্টর। যোধপুর পার্কে ইনারা আমাদের প্রতিবেশিনী। ইনার দৌলতেই জাগৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। জড়িয়েছিলুম মায়ায়, এক তরফা। গীতাদি বললেন একদিন, ‘জাগকে (জাগৃতি) ঢাকাই জামদানি প্রেজেন্ট করেছ, গতকাল পরে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। শাড়িটি খুবই সুন্দর।’ নিশা বললেন, ‘আর কক্ষনো কিচ্ছু প্রেজেন্ট করবে না।’ করিনি। তবে, গীতাদি-মৃণালদার স্নেহে ঘরোয়া। সম্পর্ক অটুট আজো। কথা হয় টেলিফোনে। বার্লিনে যখনই আসছেন মৃণালদা, দেখা। আড্ডা। নানা প্রসঙ্গ। রঙ্গরসিকতা। ফরিদপুরের কতজন আছেন বার্লিনে, ডেকে আনো। ডজনদেড়েক ফরিদপুরী আছেন, কাছে পেলেই আড্ডায় দিলখোলা। কে বলবেন ইনি মৃণাল সেন? ‘আমাগো মৃণালদা, ফরিদপুরের মৃণালদা, বাঙাল। খাঁটি মাটির মানুষ। ফরিদপুরের মানুষ।’ এই বার্তা রটিয়ে তারেক, শ্যামাপদ, হালিম, রাধারমণ, জাকির, ফরিদ, হাফিজ, হরিপদ পাত্তাই দেন না বার্লিনবাসী বাঙালীদের। মৃণাল সেনও ফরিদপুরী-বৃত্তে সুখী। এটাই বোধহয় দেশাচার, দেশমাটির টান, কালচার। ভিটেমাটির গন্ধে নিজেকে খুঁজে পাওয়া। দুই বার্লিন তথা দুই জার্মানির একত্রীকরণের আগে, পূর্ব জার্মানিসহ পূর্ব ইউরোপে ভারতীয় চলচ্চিত্রকার হিসেবে মৃণাল সেনের কদর তুঙ্গে। সত্যজিত নন। পূর্ব ইউরোপে যতবার গিয়েছি (কমিউনিজম ধসের আগে), মৃণাল সেন-বিষয়ে নানা কৌতূহল, প্রশ্ন শুনেছি। একবার সোফিয়ায় (বুলগেরিয়ার রাজধানী), একটি সেমিনার শেষে, কয়েকজনের সঙ্গে আড্ডায় (নারী-পুরুষও ছিলেন), মৃণাল সেনকে চিনি, আলাপ পরিচয় আছে, আড্ডাও দিই, এই বারতায় অবিশ্বাসী অনেকে, মিথ্যে বলছি হয়ত। কমিউনিজম ধসের আগে মৃণাল সেনের অধিকাংশ ছবিই পূর্ব ইউরোপের নানা দেশের টিভিতে, সিনেমা হলে বহুবার প্রদর্শিত হয়। গিয়েছি প্রাগে, সন্ধ্যার পরে নেই কাজ, বন্ধুনীসহ ঢুকেছি প্রাগের টাউন হলের সিনেমায়, মৃণাল সেনের ‘উকা উরি কথা’। চেক ভাষায় সাবটাইটেল। পাশে দেখি ভাসলাভ হাভেল। ছবি শেষে যেচে আলাপ করি। হাভেল বললেন, গ্রেট ফিল্ম। অকর্মণ্য, অলসতা ও সমাজ-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ। মনি কাউল বলছিলেন (বার্লিনে) : ‘মৃণাল সবসময়ই সমসাময়িক, ভারতীয় রাষ্ট্রসমাজে। ওঁর ছবি আমাদের ভারতীয় সমাজজীবনের চালচিত্র।’ (ডয়েচে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাতকার)। মৃণাল এসেছেন বার্লিনে, ওঁর ছবির রেট্রসপেকটিভ, আরসিনাল সিনেমা হলে। এসেছেন গীতা সেন, কুনাল, নিশাও (আমেরিকা থেকে)। প্রদর্শনীর পয়লা দিনে (১৯৯৯, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে শুরুতে) ভিড়ভাড়াক্কা। মৃণাল অভিভূত। আপ্লুত। দর্শক ঘিরে ধরেন। এক ফাঁকে বেরিয়ে কাছে আসেন, জানতে চান বন্ধু গ্যুয়েন্টার গ্রাসের কুশলাদি। বলি, ‘জানেন না? গ্রাস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, আজ দুপুরেই ঘোষিত।’ জেনে মহাখুশি। খুশির কথা বার্লিন চলচ্চিত্র বিভাগের কর্তা উলরিখশ্ গ্রেগরকে বলতেই খেঁকিয়ে ওঠেন গ্রেগর, “ওং রঃ হবংি ভড়ৎ ুড়ঁ? ঐড়ৎৎরনষব.” গ্রেগর পছন্দ করেন না গ্রাসকে, রাজনৈতিক মতাদর্শে। ভ্যাবাচাকা খেয়ে মৃণালের আমতা আমতা কণ্ঠ, মৃদুস্বরে, “গ্রাসকে জানি, বন্ধুও।” গ্রেগর : সো হোয়াট? মৃণাল চুপ। মৌন। ভাষাহীন। মৃণাল সেন ‘তৃতীয় ভুবন’ (আত্মজীবনী)-এ এই কাহিনী লেখেননি। দরকারও নেই, ঘটনা ছোট্ট, সাক্ষী হিসেবে বলাও হয়ত ঠিক হলো না। মার্জনাপ্রার্থী। মৃণালদা সর্বদাই ঘরোয়া, মার্জনা করেন বিরুদ্ধবাদী, সমালোচক, শত্রুকেও। তিনি বিশ্বমানব। সমকালীন। আমাদের প্রণতি।
×