ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টানা বর্ষণে পানি উঠেছে উঁচু জমিতেও

বিপুল ক্ষতির মুখে সবজি, ফুল এবং বীজতলা

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৫ জুলাই ২০১৫

বিপুল ক্ষতির মুখে সবজি, ফুল এবং বীজতলা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ টানা বর্ষণে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। অতিবর্ষণে আমন চাষের বীজতলা থেকে সবজি ক্ষেত ফুল ক্ষেত তলিয়ে গেছে সব। ফলে ক্ষতির মুখে পড়েছেন চাষীরা। বিশেষ করে এবার বর্ষায় টানা বৃষ্টিতে অতীতের চেয়ে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানিতে উঁচু জমিও তলিয়ে গেছে। এতে উঁচু জমিতে চাষ করা সবজি, ফুল সব পানিতে পচে নষ্ট হয়ে গেছে। বাজারে সবজির সরবরাহও কমে গেছে। সঙ্কটের কারণে দ্বিগুণ এমনকি তিনগুণ বেড়েছে সবজির দাম। বাগেরহাট, যশোর, বগুড়া এবং নরসিংদীর কৃষক সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েছেন। এসব এলাকায় শত শত একর সবজি জমি পানির নিচে চলে গেছে। পানি জমে থাকায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সবিজ গাছ। কোথাও কোথাও বৃষ্টি থামলেও এখন আর ক্ষেতের সবজি বাঁচানো সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে একটু নিচু জমিতে সবজি চাষীরা। বাগেরহাট থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, অতি বৃষ্টি ও পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতায় চলতি আমন চাষাবাদ মৌসুমে এখনও বীজতলা (চারা) উৎপাদন করতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন বাগেরহাটের কৃষকরা। প্রতিবছর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময় যেখানে আমন চাষের অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যায়, সেখানে এখনও পর্যন্ত হাজার হাজার কৃষক ঠিকমতো তাদের বীজতলা তৈরির কাজ শেষ করতে পারেনি। বর্ষার পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় চাষাবাদের জমি জলাবদ্ধ হয়ে আছে। এ পরিস্থিতিতে অসহায় চাষীরা হাসফাস করছেন। বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, কচুয়া, চিতলমালী, রামপাল, মংলা ও সদর উপজেলার কৃষকদের অভিযোগ বর্ষার পানি আটকে থাকায় আমন চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে। মাছ চাষের নামে সরকারী খাল আটকে রাখায় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্লুইস গেটগুলোর অধিকাংশ অকেজো থাকায় যথাযথ পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। ফলে জমিতে পানি জমে থাকায় বীজতলা তৈরি করা যাচ্ছে না। যে সব জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছিল, তার অধিকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বীজ তৈরির উদ্দেশে মাঠে ফেলা ধান সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। শরণখোলা উপজেলার কৃষকরা জানান, কোথাও তেমন বীজতলা এখনও তৈরি করা যায়নি। এই উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ১১ হাজারের অধিক চাষী ইতোমধ্যে ১২,২৫০ হেক্টর জমিতে আমন চাষাবাদের জন্য আমন প্রস্তুতি গ্রহণ করলেও চারা উৎপাদন করতে না পারায় তারা চরম হতাশ। উপজেলার খাদা এলাকার কৃষক রিপন তালুকদার, আঃ হক তালুকদার ও ফারুক তালুকদার বলেন, চারা তৈরির জন্য এ পর্যন্ত মণকে মণ বীজ ধান জমিতে দিয়েও কোন চারা উৎপাদন করতে পারেননি। চলতি বছর আদৌ আমন চাষ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে চিন্তিত তারা। চারঘাটা গ্রামের বাসিন্দা ফুল মিয়া আকন ও আঃ কাদের আকনসহ অনেকে বলেন, মাঠে চারা তৈরির কাজ না করতে পেরে ফুল মিয়া তার বসতবাড়ির আঙ্গিনার সবজি ক্ষেত নষ্ট করে বীজতলা তৈরি করলেও অনেকেই জমির অভাবে এখনও বীজ বুনতে পারেননি। যশোর অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, টানা ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে যশোর সদর উপজেলার চুড়ামনকাটি, কাশিমপুর ও হৈবতপুর ইউনিয়নের সবজি চাষীদের ব্যাপক ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। দিনের পর দিন ক্ষেতে পানি জমে থাকায় বেগুন, কাঁচামরিচ, সিম, পুঁইশাক, পটল, শসা ক্ষেতে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। কৃষকদের বক্তব্য বর্ষা আরও কয়েকদিন থাকলে তাদের ব্যাপক লোকসানের শিকার হতে হবে। কৃষকদের মতে, বর্ষার কারণে বর্তমানে যশোরে সবজির বাজার চড়া। যশোর জেলার ৮ উপজেলায় এবার ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে নানা ধরনের সবজি চাষ করা হয়। এর মধ্যে শুধু যশোর সদরেই সবজি চাষ করা হয় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে সদরের চুড়ামনকাটি, কাশিমপুর ও হৈবতপুর ইউনিয়নের মাঠের পর মাঠ বিভিন্ন সবজি চাষ করে কৃষকরা। শুরুতে ভাল ফলনও দেখা দেয় তাদের আবাদকৃত ফসলের ক্ষেতে। অনেকে চড়া মূল্যে সবজি বিক্রি করে লাভবান হলেও অনেকে এখনও কোন সবজিই বিক্রি করতে পারেনি। তারা স্বপ্ন দেখতে থাকেন ফসল বিক্রির। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে বাধ সাধে অতিরিক্ত বৃষ্টি। শুক্রবার বিকেলে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় চুড়ামনকাটি ইউনিয়নের বাগডাঙ্গা, দোগাছিয়া, আব্দুলপুর, সাজিয়ালী, কমলাপুরসহ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের শত শত বিঘা কৃষকের বিভিন্ন সবজির ক্ষেতে পানি জমে রয়েছে। দোগাছিয়া গ্রামের ইউনুচ আলী, তরিকুল ইসলাম ও মশিয়ারসহ বহু কৃষকের পটল ক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাদের দাবি, বৃষ্টি থামলেও এখন আর ক্ষেতের পটল বাঁচানো সম্ভব নয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হবে একটু নিচু জমিতে সবজি চাষীরা। দোগাছিয়া গ্রামের বেগুন চাষী ইউনুচ আলী জানান, তার ১০ কাঠা জমির বেগুন ক্ষেতে কেবল ধরা শুরু করেছে। যেভাবে বৃষ্টি হলো তাতে তার বেগুন গাছ মরে যেতে শুরু করেছে। ক্ষেতে পানি জমে থাকায় লাখ লাখ টাকার ক্ষতি হবে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন। ইউনিয়নের চুড়ামনকাটি গ্রামের প্রায় অর্ধশত কৃষকের শিম ও বেগুন ক্ষেতে পানি জমে রয়েছে বলে জানা গেছে। হৈবতপুর গ্রামের পটল চাষী সাত্তার জানান, বৃষ্টির পর যদি ক্ষেতে পানি জমে থাকে তাহলে কিছুদিন পর সব গাছ মারা যায়। এতে করে কৃষকদের এ বছর ব্যাপক লোকসানের শিকার হতে হবে। বিজয়নগর গ্রামের মুলা চাষী রফিকুল ইসলাম জানান, তার এক বিঘা মুলা বিক্রি করার মতো হলেও অতি বৃষ্টির কারণে পচন দেখা দিয়েছে। তিনি আরও জানান, মূলা দ্রুত পচনশীল হওয়াই বিক্রি করা সম্ভব নয়। কৃষকরা জানান, মৌসুমের শুরুতে তারা বিভিন্ন মহাজনের কাছ থেকে জ্বালানি, সার বাকিতে ক্রয় করে আবাদ করে থাকেন। পরে ফসল বিক্রি করে তারা মহাজনদের দেনা পরিশোধ করে থাকেন। কিন্তু এ বছর তারা মহাজনদের দেনা পরিশোধ নিয়ে রয়েছেন মহাচিন্তায়। সাধারণত দেখা যায়, প্রতি ঈদের পর যশোরে সবজির দাম কম থাকলেও এখন তা বেশ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। নরসিংদী থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সবজি ভা-ারখ্যাত নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সময়মতো জমি প্রস্তুত, বিগত বছরের উন্নত বীজ সংগ্রহ করে জেলার নরসিংদী সদর, পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় এ বছর বিপুল পরিমাণ সবজির আবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির ফলে সবজি গাছের গোড়া পচে যাওয়ায় কৃষকদের মাথায় হাত পড়েছে। শুক্রবার জেলার নীলকুঠি, বারৈচা, মরজাল ও মাহমুদাবাদের পাইকারি বাজারগুলোতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে বাজারে পর্যাপ্ত সবজি নেই। গোড়া পচা ও মরা গাছের শুকিয়ে যাওয়া কিছু সবজি নিয়ে কয়েকজন কৃষক বসে আছে। জেলার বেলাব উপজেলার বারৈচা গ্রামের সবজি চাষী আবু নাছের বললেন, ক্ষেতে পানি জমে সবজি গাছ মরে গেছে, পচে গেছে বিভিন্ন জাতের সবজি। মাহমুদাবাদের নুর মোহাম্মদ জানান, জমিতে সবজি নেই তাই এর প্রভাব পড়েছে বাজারে, বাড়তে শুরু করেছে এর দাম। একদিকে বর্ষাকাল অপরদিকে টানা বৃষ্টিতে জমির ফসল পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এলাকার কৃষকরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। রঈছউদ্দিন নামে এক কৃষক জানান, জমি শুকালে নতুন করে পুনরায় সবজি আবাদ শুরু হবে। তবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় পেলে কৃষকরা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে। বগুড়া অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, বর্ষার মধ্যভাগে শ্রাবণে বগুড়া অঞ্চলে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতই আছে। তবে আবহাওয়া বিভাগের মতে জুলাই শেষে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে। টানা ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনাই করছে তারা। এই অবস্থা হলে পরে উঠতি সবজি আবাদের ক্ষতি হবে। এখন পর্যন্ত নদী তীরবর্তী ও চরের নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতায় সবজি আবাদের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে বেগুন, করলা, পটল, ঝিঙ্গার ক্ষতি হয়েছে বেশি। বগুড়ার উঁচু এলাকায় বৃষ্টিতে সবজির ক্ষতি তেমন হয়নি। মাঠ পর্যায়ের চিত্র বলে দেয়, এবারের বর্ষা মৌসুমে সবজির আবাদ বেশ ভালই হয়েছে। এই সময়টায় সবজি ফসলের মাঠে আছে করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, বেগুন, কাকরোল, পেপে। গৃহস্থ ও কৃষকের উঠানে আছে লাউ, কুমরা, লাল শাক, পুঁই শাক, পালং শাক। বেশি কিছু এলাকায় মুলাও ফলেছে। যদিও মুলার আবাদটি রবি মৌসুমের তারপরও কিছু সবজি ভর বছর ফলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক চন্ডিদাস কুন্ডু জানালেন এখন পর্যন্ত বৃষ্টি পরিমিত মাত্রাতেই আছে। সবজি আবাদের ক্ষতি তেমন হয়নি। এদিকে বগুড়া অঞ্চলের সবজি দেশের প্রতিটি এলাকায় যাচ্ছে। সবজি উৎপাদনে অন্যান্য জেলার চেয়ে বগুড়া অনেক এগিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে আর দিনকয়েক পরই আগাম রবি ফসলের রোপণ কার্যক্রম শুরু হবে। কৃষক সেই প্রস্তুতি নিয়েছে। আশা করা হয়েছে টানা ভারি বর্ষণ না হলে আগাম রবি ফসল এবার ভালই হবে।
×