ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সাকার বাঁকা হাসির দিন শেষ

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৬ জুলাই ২০১৫

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সাকার বাঁকা হাসির দিন শেষ

আমার মতো ভীতু বাঙালী ফাঁসির কথা শুনে আনন্দিত হতে পারে না। আমি যে কোন মৃত্যুর বিরুদ্ধে। ধর্ম, প্রকৃতি বা যে কোন অর্থে মানুষের জীবনের চেয়ে পরম কোন সম্পদ নেই। সে আমার শত্রু হলেও যা আমি তাকে দিতে পারি না, তা কেড়েও নিতে পারি না। তাই মৃত্যু আমাকে টানে না। আমরা বাঙালীরা এমনিতেই বড় দুঃখবিলাসী। বিয়ের মতো আনন্দ অনুষ্ঠানেও আমরা কেঁদে বুক ভাসাই। ভালবেসে মা-বাবার অমতকে মত বানিয়ে সংগ্রাম করা মেয়ে বিয়ের দিন কেঁদে বুক ভাসায়। গান শুনে নাটকে দেখে কবিতা পড়ে কাঁদি আমরা। অন্যরা যে কাঁদে না তা নয়। তবে এমন আবেগ অন্য জাতিতে বিরল। মৃত্যুর খবরে তাই আনন্দের কিছু নেই। বরং কান্নাপ্রিয় জাতির চোখ সজল হবারই কথা। কিন্তু সব মরণ সমান নয়। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা তাদের জীবনকে নিজের কারণে অন্যের কাছে বিষময় করে তোলে। তাদের অজান্তে বা ইচ্ছে করেই তারা মানুষের দুশমনে পরিণত হয়। দু’একজন মানুষের দুশমন সব মানুষ। দুনিয়ায় সবাইকে খুশি করা কারও দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা বলছি তাদের কথা, যারা তাদের কৃতকর্মে পুরো জাতি এমনকি রাষ্ট্রকেও বিষিয়ে তোলে। তখন তাদের জন্য কান্না তো দূরের কথা, ভাবার মানুষও থাকে না আর। আজ খবরে দেখলাম, ঘাতক সাকা চৌধুরীর ফাইন্যাল রায় অবধি গণজাগরণ মঞ্চ কর্মসূচী চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে। এই মঞ্চ এক সময় আশা-ভরসার প্রতীক হয়ে উঠলেও সেটা টেকেনি। কেন? সে কথা বলার দরকার পড়ে না। তবে তাদের এই কর্মসূচীতে আমার মত ভীতু মানুষেরও সমর্থন থাকবে। বলছিলাম মরণ জয়ের কথা। কিন্তু এই সাকা চৌধুরীকে আমরা চট্টগ্রামবাসীরা যেভাবে দেখেছি বা দেখে বড় হয়েছি তাতে করুণা করারও কোন কারণ দেখি না। সত্যি বলতে কি, আমি গোলাম আযম ও সাঈদী সাহেবের শাস্তির আদেশ হবার পর কিছুটা হলেও ভেবেছি। ভেবেছি এই কারণে, এরা আমাদের বিরুদ্ধে হলেও এক আদর্শের মানুষ। এদের জীবনের কোথাও না কোথাও উত্থান আছে বা ছিল। তারা কোনদিন মন্ত্রী ইত্যাদিও হননি। যদিও তারা আমাদের রাজনৈতিক শত্রু তারপরও আমাদের ভেতরেই তাদের সমর্থক আছে। সেদিক থেকে সাকা হচ্ছে নির্বোধ আর উন্মাদ টাইপের রাজনীতিবিদ। এখন দেখা যায় তার জন্য কেউ নেই। কিভাবে থাকবে? এই লোক যে রাজনীতিকে আশ্রয় করে বেঁচেছে তাকেও ছাড় দেয়নি। কথা বলার সময় চোখ-মুখ খিঁচিয়ে ভাষা বিকৃত করে বলত, কুকুর লেজ নাড়াবে এটা নিয়ম হবার পরও লেজ নাকি কুকুর নাড়ায়। খালেদা জিয়া ও তারেককে নিয়ে এমন অশ্লীল ব্যঙ্গ আওয়ামী লীগাররাও করেন না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে তার বক্তব্য ছিল আপত্তিকর। শুনে মনে হতো দু’গালে দুটো চড় কষাই। বিরোধিতা এক বিষয় আর নোংরামি ভিন্ন ব্যাপার। সাকা চৌধুরী একবার তার নির্বাচনী জনসভায় বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের মার্কাকে তিনি নৌকা মনে করেন না। এটা নাকি মা কালীর জিভ। এমন কথা কোন সভ্য দেশে বললে সেদিনই তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটত। একথা বলার পর হিন্দুরা প্রতিবাদ জানালে তিনি আইনী মারপ্যাঁচে পড়ে বলিনি বলেছি এমন না অমন এসব অজুহাতে পার পেয়ে যান। শোনা গিয়েছিল তার অপরাধ মুক্তির পেছনে ছিল আওয়ামী লীগের কিছু নেতা। হতেই পারে এটা তো ওপেন সিক্রেট, রাত বিরোতে এরা ছিলেন তার নেশা সঙ্গী। মজার ব্যাপার এই, এদের কেউ কেউ সাকা চৌধুরীর জানী দুশমন অমুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ। এই হলো সাকার আসল চরিত্র। রাজনীতির জন্য সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মবিদ্বেষ দোস্তির বেলায় হিন্দু প্রেম। বিএনপিতে আসার আগে তিনি এনডিপি নামে একটি দল গড়েছিলেন। এক নেতা আর কিছু সাগরেদ ও খুনির দল। সে দলের দেয়াল লিখনে থাকত দেশবিরোধিতা। আঞ্চলিকতার নামে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে পৃথক রাখার এক জঘন্য ভাবনা দেয়ালি লিখত তারা। এমনকি প্রদেশ করে ফেলা বা স্বায়ত্তশাসন চাই এগুলোও লেখা হতো। এ জাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদের পরও এরশাদ সরকার তার বিরুদ্ধে কোনদিন কোন মামলা করেনি। কারণ সেটা ছিল অগণতান্ত্রিক একনায়কের শাসন। যেনতেন প্রকারে গদিতে থাকার জন্য যে কাউকে দরকার ছিল তাদের। অথচ সাকা সমানে দেশবিরোধী কথা বলে গেছে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, আওয়ামী লীগও তার বিরুদ্ধে রা করেনি। মানুষ যখন শুরুতে মিথ্যা বলে তখন অনুতপ্ত হয়। লজ্জিত হয়। আল্লাহর দরবারে মাফ চায়। কিন্তু মিথ্যে যখন অভ্যাসে পরিণত হয় তখন সে ভাবে ঈশ্বরকেও ঠকানো যায়। সাকার বেলায় সেটাই দেখেছি আমরা। এবারের আগেরবারে বিএনপির ভরাডুবির ইলেকশনে সাকা কিন্তু জিতে এসেছিল। পেয়ারুর বিরুদ্ধে জয়ের সে নির্বাচনে নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে সাকা তার স্বভাবসুলভ বেয়াদবি আর হামবড়া ভাবে লেখাপড়ার কলামে শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই বলে ঘোষণা দিয়েছিল। যেন এটা মগের মুল্লুক। যা ইচ্ছে হলো তাই বলে দিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার এই, সে নির্বাচনের পর আরও একটি নির্বাচন এবং লম্বা সময় পার হয়ে যাবার পরও সাকা চৌধুরীর সে মামলার রায় হয়নি। অন্যদিকে একই লোক নতুন চন্দ্র সিংহের হত্যার অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য বলছে, সে সময় নাকি পাকিস্তানে পড়তে গিয়েছিল। যে লোক স্বাধীন দেশের নির্বাচনে লেখাপড়া নেই বলে ঘোষণা দেয়, সে লোক একাত্তরে লাহোর বা পাঞ্জাবের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করল কিভাবে? জানি না এর উত্তর কেউ চেয়েছেন কিনা। না চাইলেও অবাক হবো না। কারণ এদেশে সবকিছু সম্ভব। যে কথা বলছিলাম, সাকা চৌধুরী এখন শেষ রায়ের দোরগোড়ায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরকাল ফোঁড়নকাটা আর দালালি করে যাওয়া এই লোকের শাস্তি আমরা না চেয়ে পারি না। কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবার পরিবর্তে খেলো করে কথা বলা, মানুষকে তাচ্ছিল্য করা আর পাক প্রেমে মশগুল থাকা সাকা গোলাম আযমের চেয়েও বড় অপরাধী। তার কারণে রাউজান এলাকা সন্ত্রাস আর হত্যার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল। আজ কেন সেখানে আগের মতো হত্যা আর সন্ত্রাস চলছে না? কারণ বড় ডাকাত অন্তর্ধানে বা কারাগারে। সাকার ফাঁসি হলে আমার মতো মানুষের জীবনে আর কোন প্রভাব না পড়লেও এটা জানব পাপ বাপকেও ছেড়ে কথা বলে না। তাছাড়া একটি দেশ, দেশের মানুষ, শহীদজন আর ধার্মিকদের বিশ্বাস নিয়ে পরিহাসও কম বড় অপরাধ নয়। সেটারও একটা যোগ্য শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। ভিডিওতে দেখেছি, মন্ত্রী কামরুলকে ওই ব্যাটা কামরুল সালাম দে বলে হাঁক পাড়ছেন সাকা। মন্ত্রীও সুবোধ বালকের মতো বলেছেন : দিলাম তো। কী আশ্চর্য দেশ। আর কি আমাদের নেতার ছিরি। আজ মনে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আরও ঋণী হয়ে গেলাম আমরা। দাম্ভিকতা, আস্ফালন, ধরাকে সরা জ্ঞান আর খুনের রাজনীতি যে চিরদিন চলে না সাকার বিচারের ভেতর দিয়ে সেটাই যেন প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। তাছাড়া দেশ ও মাটির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতারও একটা ফল আছে। এদেশের সন্তান শুধু হিন্দু বা আওয়ামী লীগ করার কারণে খুন হবে আর তার বিচার হবে না? ইতিহাস আর সময় যেন হাত ধরাধরি করে বলছে : দেখলে তো কা-টা, আমরা কিন্তু তোমাদের ছাড়া একদিনের জন্যও থাকি না। রবীন্দ্রনাথ সেই কবে বলেছিলেন, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভাল? সাকা চৌধুরী যতই আস্ফালন করুক এদেশ ও সময় তাকে মার্জনা করার মতো বর্বর হয়নি আজও। [email protected]
×