ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : মহেশ সচদেব;###;অনুবাদ : এনামুল হক

ইসলামী সন্ত্রাসের ভেতরের কাহিনী

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৬ জুলাই ২০১৫

ইসলামী সন্ত্রাসের ভেতরের কাহিনী

এক দশকেরও অধিককাল ধরে বিশেষজ্ঞরা ইসলামী বিশ্বের অধিকাংশ এলাকাজুড়ে যে উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের তাণ্ডব ও টালমাটাল অবস্থা চলছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাদের অনুসন্ধানী দৃষ্টির পরিধি সঙ্কুচিত করে এনে ধর্মীয় অনুপ্রেরণার ওপর নিবদ্ধ করেছেন। এমন ঘটনাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। বলা হয়েছে এটা খ্রীস্টান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ, বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জিহাদ কিংবা নাস্তিক শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। যারা সন্ত্রাস করছে তাদের কাছে এই ব্যাখ্যা বা বর্ণনাগুলো ইসলামের বিজয়ের গৌরবময় ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনার জন্য ইমানদারদের একত্রে সংগঠিত করা এবং তাদের মুজাহিদে রূপান্তরিত করার জন্য এক আকর্ষণীয় রণহুঙ্কারে পরিণত হয়েছে। আর বিরোধীদের কাছে এই বর্ণনাগুলো ইসলামপন্থীদের মধ্যযুগীয় নৈরাজ্যবাদী বা ধর্মোন্মাদ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের পিশাচরূপে তুলে ধরতে সহায়ক হয়েছে। তথাকথিত বিশেষজ্ঞদের কাছে এই ধর্মীয় ব্যাপারটা ছিল ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটেছে। এ অবস্থায় ইসলামী উগ্রবাদ তাদেরকে এক নতুন ও গুঢ় শব্দকোষ যুগিয়েছে, যার মধ্যে ডুবে থাকা যায়। অচিরেই এক ব্যাপক উৎপাদনশীল শিল্প গজিয়ে ওঠে আপাতদৃষ্টিতে পা-িত্যপূর্ণ সব ব্যাখ্যা বা তত্ত্বকথা ফাঁদতে লেগে যায়, যেগুলোর সবই সুবিধামতো ইসলামী বুলিতে পরিপূর্ণ। ইসলামী উগ্রবাদের এক সর্বজনীন তত্ত্বের সন্ধানের কাজটা অবশ্য বিপথেই চালিত হয়েছে। বরাবরের মতোই বাস্তব পরিস্থিতিটা অধিকতর জটিল এবং সেইসঙ্গে অধিকতর নীরসও বটে। ধর্মের ভূমিকার কথা অস্বীকার না করেও বলা যায় যে, এ ক্ষেত্রে অন্যান্য চালিকাশক্তিও এককভাবে কিংবা সমবেতভাবে ক্রিয়াশীল থাকতে এবং ইসলামী উগ্রবাদের উত্থানে প্রভাব ফেলতে পারে। জাতিগত বিষয় ধর্মের সংগঠিত রূপটি আবির্ভূত হবার আগে অনেক সময় গোত্র ও জাতপাতের মতো সমাজতাত্ত্বিক বিভাজনগুলো সংঘটিত হয়েছে। ইসলামী বিশ্বের কোন কোন প্রান্তে জাতিগত বা জাতিসত্তার প্রভাব অনেক সময় ধর্মের প্রভাবের সঙ্গে তুলনীয় হয়ে থাকে। পরিস্থিতিটা এমন নয় যে, হয় এটা থাকবে, না হয় ওটা থাকবে। অনেক সময় দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত উপজাতীয় রীতিনীতির সঙ্গে ধর্ম সম্পৃক্ত হয়ে মূল্যবোধের এক জটিল মিশ্ররূপের উদ্ভব হয়, যা জনগোষ্ঠীকে সত্তা ও সংহতি যোগায়। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায় যে, বোকো হারামের সদস্য সংগ্রহের প্রধান ক্ষেত্র হলো উত্তর-পূর্ব নাইজিরিয়া এবং তিন প্রতিবেশী দেশ নাইজার, ক্যামেরুন ও শাদের কানুরি উপজাতি। বোকো হারামের কর্মতৎপরতার এলাকা হলো প্রধানত সুন্নি মুসলিম এলাকা। তবে কর্মকা-ের মূল কেন্দ্রটি অতি ঘনসংবদ্ধ এবং সেটা প্রধানত কানুরি উপজাতীয় লোকদের নিয়ে গঠিত, যারা তাদের প্রাক ঔপনিবেশিক স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে চায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত কানুরিরা ছিল গর্বিত সভ্যতার অধিকারী। এরা ট্রান্স-আফ্রিকান স্থলবাণিজ্য পথ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে ধনসম্পদের অধিকারী হয় এবং প্রসিদ্ধি লাভ করে। বোকো হারাম নেতা আবুবকর শেখাউসহ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ আঞ্চলিক মিশ্রভাষা হাউসা ভাষাকে কাজে লাগিয়ে তাদের আওতা প্রসারিত করার চেষ্টা করেছিল। তবে কোন উল্লেখযোগ্য ফল অর্জিত হয়নি। হাউসা ধর্মের অনুসারীরা তাদের সন্দেহের চোখেই দেখতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা দায়িশ খিলাফতের প্রতি শেখাউর আনুগত্য ঘোষণার তাৎপর্যকে বড় করে দেখিয়ে থাকেন। তবে প্রকৃত বাস্তবতা কানুরি উপজাতিত্ব দ্বারাই নির্ধারিত। অনুরূপভাবে ফিনিক্স পাখির মতো ‘দাউলা ইসলামিয়া ফি ইরাক ওয়া শাম’ (ইরাক ও লাভান্ত ইসলামী রাষ্ট্র, যা আরবীতে প্রতিটি শব্দের আদ্যাক্ষর দিয়ে রচিত দায়িশ নামেই সমধিক পরিচিত) এর উত্থান এবং একে দমন করার জন্য লড়াইয়ে নিয়োজিত বহুজাতিক মহাজোট নিয়ে লিখতে গিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করা হয়েছে। অথচ এর উপজাতিগত যোগসূত্রগুলোর উল্লেখ আদৌ করা হয়নি বলা চলে। দায়িশ শাম্মার নেটওয়ার্ককে সক্রিয়ভাবে চালিত করছে। এই শাম্মাররা পশ্চিম এশিয়ার সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী উপজাতি বলে ধারণা করা হয়। শাম্মারদের বাস সৌদি আরবের উত্তরাঞ্চলের হেইল। তবে তাদের অনুসারী ও শাখা উপজাতিগুলো ইরাক, জর্দান, সিরিয়া, এমনকি তুরস্কেও আছে। শাম্মারদের অবস্থা যখন তুঙ্গে সে সময় তারা ও তাদের অনুগতরা আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ এলাকা এবং ইরাকের দক্ষিণাঞ্চল শাসন করত। সৌদি আরবের মরহুম বাদশাহ আবদুল্লাহ ছিলেন মায়ের দিক থেকে এই শাম্মার উপজাতিভুক্ত। দায়িশ নিয়ে চলমান সংঘাতে শাম্মারদের উভয় দিকেই দেখতে পাওয়া যায়। আইএসকে অর্থ সাহায্য জুগিয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে এমন অনেক উপসাগরীয় আরব শাম্মার উপজাতির সঙ্গে যুক্ত বলে ধারণা করা হয়। যেমন ধরুন গত জুন মাসে সৌদি আরবের শিয়া মসজিদে দুটি বোমাবাজির ঘটনা যারা ঘটিয়েছিল তারা হেইল এলাকার লোক। রাজনৈতিক অপশাসন ইসলামী বিশ্বের এই প্রবল আলোড়নময় অবস্থার কারণ হিসেবে অনেক সময় শাসন পরিচালনার ইস্যুগুলোকে দায়ী করা যেতে পারে। এসব দেশের অনেক কটিতে মূলত রয়েছে একনায়কতান্ত্রিক শাসন, যা হয় সশস্ত্র বাহিনীর, না হয় প্রভাবশালী কোন উপজাতির সমর্থনপুষ্ট। সাধারণত এই একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে জনঅংশীদারিত্বের অভাব, অপশাসন, দুর্নীতি ও নির্যাতন। এই বিষয়গুলোর সঙ্গে শোচনীয় অর্থনৈতিক অবস্থা যুক্ত হয়ে এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। উত্তর আফ্রিকার মাগরেব দেশগুলো যেমন আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া ও মিসরে এই পরিস্থিতি হোগরা নামে অভিহিত হয়েছে, যেখানে শাসকশ্রেণী যে কোন ধরনের সাজার হাত থেকে অব্যাহতি পেত। বাকি জনগোষ্ঠী এমন ব্যবস্থায় নিদারুণ ক্ষুব্ধ ছিল। এর পরিণতিতে উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়েছিল ধর্মীয় গ্রুপগুলো। অনেক ক্ষেত্রে এরাই ছিল একমাত্র সংগঠিত বিরোধী দল, যার খানিকটা হলেও বৈধতা ছিল। ধর্মীয় চরমপন্থীরা অত্যন্ত সুবিধাবাদী ভূমিকা পালন করেছিল। তবে তাদের অবদানকে উভয়পক্ষই কাজে লাগিয়েছে। ক্ষমতার শূন্যতা সিয়াদ বারি পরবর্তী সোমালিয়া কিংবা মোয়াম্মার গাদ্দাফী পরবর্তী লিবিয়া এবং মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তী ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিকে বিভিন্ন মত ও পথের ইসলামী সংগঠন রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের প্রকাশ্য আমন্ত্রণ হিসেবে দেখে। বেশিরভাগ সময় তারা সুবিধাবাদী কৌশল হিসেবে ইসলামী ঝা-াকে কাজে লাগিয়ে দুর্বৃত্তদের তালুক প্রতিষ্ঠা করে বসেছে। যেমন আল শাবাবের সঙ্গে সোমালী জলদস্যুরা গাঁটছড়া বেঁধেছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য লেজই অনেক সময় কুকুরকে নাড়িয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক প্রসারের বিষয়টিকে বুঝতে পারা সম্ভবত সবচেয়ে সহজ। বিদেশী পৃষ্ঠপোষক নিজের সম্প্রসারণবাদী অভিসন্ধির জন্য ইসলামকে ট্রয়ের ঘোড়া হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। আফগানিস্তানে মুজাহিদ ও তালেবানদের প্রতি পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী সাহায্য-সমর্থন দেয়া এই কৌশলের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এমনকি অমুসলিম শক্তিগুলোও যৌক্তিকতা হিসেবে ইসলামকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে বৈরীভাব পোষণ করেনি। সিআইএ সোভিয়েত লালফৌজের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদে প্রকাশ্যে অর্থ জুগিয়েছিল। এসব ক্ষেত্রে ধর্মীয় উদ্দেশ্য ও সেকুলার উদ্দেশ্যের মধ্যকার সুনির্দিষ্ট মিশ্রণের ব্যাপারটা কাকে সে কাহিনী শোনানো হচ্ছে তার ওপর ভিত্তি করে মাত্রা নির্ণয় করে পরিবেশন করা হয়। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, ইসলামী উগ্রবাদ মনোলিথিক কিছু নয়। স্নায়ুযুদ্ধের দীর্ঘ অধ্যায়ে পাশ্চাত্য কমিনটার্নকে প্রায়শই এমন সহজ ও অতিরঞ্জিত উপায়ে চিত্রিত করেছিল এবং তাতে করে বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের ভ্রান্তি ঘটেছিল। ইসলামী সন্ত্রাসবাদ এক গুরুতর হুমকি, যার প্রভাব এই সন্ত্রাসের প্রত্যক্ষ কর্মক্ষেত্রের বাইরেও বহুদূর ব্যপ্ত। অবশ্য এই সন্ত্রাসের ইন্ধন হিসেবে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন অনুপ্রেরণার মধ্যকার সূক্ষ্ম তারতম্য উপেক্ষা করা হলে কেবল একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে এবং একই ধরনের পরিণতি দেখা দেবে। [লেখক অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় কূটনীতিক। আরবী ভাষার ওপর তার ভাল দখল আছে। তিনি আলজিরিয়া ও নাইজিরিয়ায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন] সূত্র : দি হিন্দু
×