ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

উল্টো তদন্ত কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে;###;বিক্ষুব্ধ তামান্নার পরিবার বাধ্য হয়েই আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে

রাজশাহীতে বিমান দুর্ঘটনা ॥ তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা, সর্ষেয় ভূত!

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৬ জুলাই ২০১৫

রাজশাহীতে বিমান দুর্ঘটনা ॥ তদন্ত রিপোর্ট ধামাচাপা, সর্ষেয় ভূত!

আজাদ সুলায়মান ॥ প্রশিক্ষণের সময় রাজশাহীতে বিমান দুর্ঘটনায় পাইলট তামান্না রহমান নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেয়া হয়েছে। ঘটনার চার মাস পরও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে আরও অধিকতর তদন্তের সুপারিশ থাকলেও সেটাও আমলে নেয়া হচ্ছে না। এতে হতাশ হয়ে নিহত তামান্নার পরিবার বার বার সিভিল এভিয়েশনে ধরনা দিলেও তাদের জানতে দেয়া হয়নি- সে দিন কিভাবে কি ঘটেছিল, কারা এ জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বাধ্য হয়েই তামান্নার পরিবার এখন আদালতে মামলা ঠুকে দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মানসম্মত উড়োজাহাজ ও প্রশিক্ষক না থাকায় ফ্লাইং ক্লাব বন্ধ করা ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির জন্যই তারা এ মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন। এ বিষয়ে তামান্নার পরিবারের অভিযোগ, দুর্ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা দূরে থাক, প্রাথমিক তদন্তে যেটুকু উঠে এসেছে সেটাও ধামাচাপা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি সিভিল এভিয়েশন। প্রশিক্ষকের ভুল, ঔদাসীন্য, ফ্লাইং ক্লাবের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অরাজকতা ও অপেশাদারিত্বের মতো কর্মকা-কে এ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার কারণে তদন্ত কর্মকর্তা এইচ এম আখতার খানকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে অতীতের অন্যান্য বিমান দুর্ঘটনার মতোই এটাও ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের। তদন্ত কমিটির এক সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, এ দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত কখনই আশা করা যায় না। কারণ ফ্লাইং ক্লাবের যেসব কর্মকর্তার অনিয়ম ও লুটপাটের জন্য বার বার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে, যারা বার বার তদন্ত ধামাচাপা দিচ্ছে তারাই এখনও ঘাপটি মেরে আছেন সিভিল এভিয়েশনে। ফ্লাইট সেফটি রেগুলেশন বিভাগে যে ক’জন ফ্লাইট ইন্সট্রাক্টর রয়েছেন, তাদের নেই লাইসেন্সের মেয়াদ, নেই শারীরিক যোগ্যতা, দীর্ঘদিন ধরে তারা ফ্লাই করেন না, তাদের বয়সের মেয়াদও শেষ। অথচ তারাই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে আছে বছরের পর বছর বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। এ ধরনের অযোগ্য ইন্সট্রাক্টর দিয়ে চালানো হচ্ছে উড্ডয়ন প্রশিক্ষণের মতো পেশাগত কাজ। তারাই আবার জড়িত ফ্লাইং ক্লাবে। তারা যতদিন এ বিভাগে ঘাপটি মেরে থাকবে ততদিন এসব দুুর্ঘটনার তদন্ত ধামাচাপাই পড়বে আর একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সূত্র জানায়, এসব পদে থাকার জন্য দরকার কারেন্ট রেটেড পাইলট। দক্ষ লোকজনের অভাব থাকা সত্ত্বেও যিনি কারেন্ট রেটেড ইন্সট্রাক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তামান্না দুর্ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে আসল জায়গায় হাত দিয়েছিলেন, সেই আখতার খানকেই সিভিল এভিয়েশন থেকে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার দোহাই দিয়ে বের করে দেয়া হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, মূলত প্রশিক্ষকের উদাসীনতা ও মারাত্মক ভুলের কারণেই সেদিন সেসনাটি দুর্ঘটনায় পড়ে। কারণ প্রাকটিস ফোর্সড ল্যান্ডিং করতে গিয়ে প্রশিক্ষক সাঈদ কামাল মারাত্মক ভুল করে ফেলেন মাত্র দেড় শ’ ফুট ওপরে ওঠেই উড়োজাহাজটিকে টার্ন করতে গিয়ে। প্রশিক্ষণের সময় এ ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, এক হাজার ফুট ওপরে ওঠার পর টার্ন নেয়া। আট শ’ ফুটের নিচে কিছুতেই ইউটার্ন করাটা নিরাপদ নয়। অথচ সেদিন তিনি রাজশাহীতে মাত্র দেড় শ’ ফুট ওপরে ওঠেই টার্ন করতে গেলে উড়োজাহাজটি ধপাস করে পড়ে যায়। মুহূর্তেই তাতে আগুন ধরে যায়। যার করুণ শিকার হন তিনি নিজেও। এটা কেমন ভুল- তা যে কোন সচেতন পাইলট মাত্রই বুঝতে পারেন। এর আগেও এ ধরনের ভুলের জন্য তাকে একবার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সিভিল এভিয়েশনের বিতর্কিত ইন্সট্রাক্টররা তাকে আবার প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালনের অনুমতি দেন। পরিণামে কয়েকদিনের মধ্যেই দেখতে হলো এমন অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনা, মর্মান্তিক মৃত্যু। এ সম্পর্কে তামান্নার বাবা ডাক্তার আনিসুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, দুর্ঘটনার চার মাস পেরিয়ে গেছে। এখনও আমাদের জানতে দেয়া হয়নি কিভাবে আমার মেয়ে মারা গেল, কেন এ দুর্ঘটনা, কার কি দোষ ছিল, তাদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বার বার সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করেছি, তার কাছে অনুরোধ আবেদন নিবেদন করেছি যাতে এ দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। তিনি এ বিষয়ে আজও পর্যন্ত কোন অগ্রগতি জানাননি। দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক উল্টো যাদের গাফিলতিতে বার বার এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে তাদেরই এখন রক্ষা করার জন্য নানা কৌশলে তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে। যে কারণে বার বার সিভিল এভিয়েশনে ধরনা দিয়েও জানতে পারিনি তদন্ত রিপোর্টে কি আছে। এখন শুনছি আরও ভয়ানক কথা। তদন্ত রিপোর্টে ফ্লাইং ক্লাবের বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও অপেশাদারিত্বের মতো তথ্যাদি উল্লেখ করে ১৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে চেয়ারম্যানের দফতরে। এতে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করার জন্য অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখন রহস্যজনক কারণে নীরবতা অবলম্বন করছে। যাতে এ নিয়ে আর কোন কিছু প্রকাশ করা না হয়। এখানেই শেষ নয়, মূল জায়গায় হাত দেয়ায় এ ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার এইচ এম আখতার খানকে সিভিল এভিয়েশন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে অবশ্য সিভিল এভিয়েশনের এক পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, এসব অভিযোগ ঠিক নয়। তদন্ত কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার এইচ এম আখতার খানের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাকে আর নবায়ন করা হয়নি। জনসংযোগ কর্মকর্তা রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, দেখেছি তামান্নার পরিবার চেয়ারম্যানের সঙ্গে এসে দেখা করে গেছে। তবে তদন্ত রিপোর্ট কেন নিহতের পরিবারেরর কাছে প্রকাশ করা হচ্ছে না তা আমার বোধগম্য নয়। এ বিষয়ে তামান্নার মা রেহেনা ইয়াসমীন অভিযোগ করে বলেন, তদন্তে ফ্লাইং ক্লাবের দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি পেশাদারিত্বের অভাবকে দায়ী করা হয়েছে। যেমন-একটি ত্রুটিযুক্ত সেসনা দিয়ে সেদিন তামান্নাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল, যাতে সিট বেল্ট লকড হওয়ার পর সেটা খোলা যাচ্ছিল না, ভর দুপুরে ফ্লাইং নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও সেটা করা হয়েছে, ওই জাতীয় প্রাকটিস ফোর্সড ল্যান্ডিং (পিএফএল) প্রশিক্ষণের সময় রানওয়ের কাছেই রাখতে হয় ফায়ার সার্ভিস ইউনিট। অথচ সেদিন সেসনাটি পড়ে গিয়ে আগুন ধরার পর প্রশিক্ষক সাঈদ কামাল ঠিকই বের হয়ে আসতে পারলেন। আর তামান্না বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেখানে পৌঁছে বিশ মিনিট পর। কারণ ওই গাড়ির চালক গিয়েছিলেন সিগারেট টানতে। এ অবস্থায় প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করা অষ্টম শ্রেণী পাস করা মেকানিক মুনিরুজ্জামান রুমি নামের এক লোক নিজেই ফায়ারের গাড়ি চাালিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। ততক্ষণে তামান্না পুড়ে ছাই। ইয়াসমীন বলেন, যদি সঠিক সময়ে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেখানে পৌঁছত, যদি রানওয়ের পাশেই স্ট্যান্ডবাই ফায়ার সার্ভিসের ইউনিট রাখা হতো তাহলে তামান্নাকে এমন দুর্ঘটনার শিকার হতে হতো না। আমি বলব এটা দুর্ঘটনার জন্য সিভিল এভিয়েশন ও ফ্লাইং ক্লাব দায়ী। এ ধরনের গাফিলতি রীতিমতো হত্যার শামিল। এ জন্যই আমরা আদালতের আশ্রয় নিতে যাচ্ছি। কেননা আমরা হয়ত তামান্নাকে ফিরে পাব না। কিন্তু তামান্নার মতো আর যাতে কেউ প্রাণ না হারায় সেটা নিশ্চিত করতে চাই। উল্লেখ্য, গত ১ এপ্রিল দুপুরে রাজশাহীর শাহ মাখদুম বিমানবন্দরের রানওয়েতে বাংলাদেশ ফ্লাইং একাডেমির একটি প্রশিক্ষণ বিমান (সেসনা) বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন প্রশিক্ষণার্থী তামান্না রহমান। এ ঘটনার পর স্কোয়াড্রন লিডার আখতার খানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সিভিল এভিয়েশন। কমিটির অন্যান্য সদস্য হলেন- ক্যাপ্টেন এম মোস্তাক আলী, লুৎফুল কবির, আতাউল্লাহ হাশমী ও কর্নেল (অব) আব্দুল খালেক। তদন্ত কমিটিতে ক্যাপ্টেন মোস্তাকের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে প্রথমেই আপত্তি তোলে তামান্নার পরিবার। তিনি কারণ অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফ্লাইং ক্লাব সব কটা ফ্লাইং ক্লাবের ইন্সট্রাক্টর। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের প্রতিনিধিকে এ তদন্ত কমিটিতে রাখাটা অনৈতিক বলে দাবি করেন তামান্নার পরিবারসহ অন্যান্য এভিযেশন বিশেষজ্ঞরা।
×