স্টাফ রিপোর্টার ॥ ভারতের প্রস্তাবিত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ফারাক্কার চেয়েও কয়েকগুণ ভয়াবহ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপর। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের বিহার-উড়িষ্যা-অসমসহ ১০টি রাজ্যেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের প্রকৃতি, কৃষি, অর্থনীতি ও অস্তিত্ব ধ্বংসের মুখে পড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এর প্রভাব হবে বাংলাদেশের প্রকৃতি-অর্থনীতি-অস্তিত্বে মারাত্মক এক আঘাত। তাই এর বিরুদ্ধে এদেশের জনগণকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
শনিবার বাপাসহ বেশ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের অস্তিত্ব ধ্বংসকারী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলন থেকে দাবি করা হয়েছে ভারত-বাংলাদেশ উভয়কেই জাতিসংঘ প্রণীত আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ অনুসমর্থন করতে হবে। তার ভিত্তিতে এ অঞ্চলের সকল দেশের প্রয়োজন ও প্রাপ্যতা বিবেচনায় রেখে পানি সম্পদ ব্যবহার পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, অসত্য তথ্য দিয়ে ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় ভারত। ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প একটি রাজনৈতিক ইস্যু। ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের প্রকৃতি, পরিবেশ, কৃষি ও অর্থনীতি ধ্বংস করবে। বক্তারা আরও বলেন, ভারতের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের নদীসমূহে অতিরিক্ত পানি রয়েছে। আর দক্ষিণ ভারতে রয়েছে পানির স্বল্পতা। এ সমস্যা সমাধান করাই তাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের বর্ষাকালীন পানির হিসাব ধরে বাংলাদেশের সারা বছরের পানির পরিমাণের মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করছে ভারত। অথচ শীতকালে এ দেশের নদীসমূহে পানিস্বল্পতা বিরাজ করে। ভারতের বর্তমান আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি কিন্তু ফারাক্কা নয়। এখানে অসংখ্য ফারাক্কার সম্মিলিত ক্ষতি বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে। এক কথায় এটিই হবে বাংলাদেশের প্রকৃতি-অর্থনীতি-অস্তিত্বে এক অবর্ণনীয় মারাত্মক আঘাত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)র সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মোঃ আবদুল মতিন বলেন, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ভারতের একটি পুরাতন প্রকল্প। প্রকল্পটি নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের প্রকৃতি, কৃষি, অর্থনীতি ও অস্তিত্ব ধ্বংস করবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের বিহার-উড়িষ্যা-অসমসহ ১০টি রাজ্যেও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এ কারণেই ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রকল্পটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছে। তিনি আরও বলেন, এক ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে আমরা বিপর্যস্ত অবস্থায় আছি, এখন আবার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ফারাক্কার চেয়েও কয়েকগুণ ভয়াবহ প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপর। এক কথায় এটি হবে বাংলাদেশের প্রকৃতি-অর্থনীতি-অস্তিত্বে অবর্ণনীয চরম মারাত্মক এক আঘাত। তাই এর বিরুদ্ধে এদেশের জনগণকে সোচ্চার হতে হবে। তিনি সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমরা সম্ভবত এই প্রথম লক্ষ্য করেছি বাংলাদেশ সরকার উদ্বেগ জানিয়ে খুবই দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারত সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছেন এর ব্যাখ্যা ও সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য। আমরা চাই বাংলাদেশ সরকার তাদের এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখবে এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাতিল নিশ্চিত করতে ভারত সরকারের সঙ্গে সফল আলোচনা করবে।
আব্দুল মতিন আরও বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সে দেশের মানুষকে খুশি করতে চায়। অথচ এর ফলে আমাদের দেশ সব দিক দিয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ভারতের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর মধ্যে ১৬টি খাল খনন করা হবে। এর অংশ হিসেবে সারা ভারতে ৭৪টি জলাধার ও অনেক বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সম্ভবত সেজন্যই তিস্তা চুক্তিতে ঢিলেমি চলছে।
বাপার সহ-সভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প উত্তর পূর্ব ভারতের জনগণের জন্য উদ্বেগ এবং আমাদের জন্য মহাউদ্বেগের বিষয়। চিঠি যথেষ্ট নয়, প্রকল্পটি বাতিলের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে জরুরী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দিন দিন উন্নত হচ্ছে এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখের ও খুশির বিষয়। তবে সম্প্রতি আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে ভারতের সরকারের উদ্যোগের সংবাদ আমাদেরকে ব্যথিত করছে ও উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।
পানি বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, পানির ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করতে পারে না ভারত। আর ভারত এই প্রকৃত বিধ্বংসী প্রকল্প করে যে উপকার লাভের আশা করছে বাস্তবে তা অর্জন হবে না, বরং ধ্বংস হবে দুই দেশের প্রকৃতি ও সম্পদ। তিনি আরও বলেন, ভারতীয় আন্তঃনদী প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ ও সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশাল টাকার এই মেগা প্রকল্প দু’দেশের কারও জন্যই শুভ ফল বয়ে আনবে না। এটি এখনই বাতিল করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বাপা’র সহসভাপতি সৈয়দ আবুল মকসুদের সভাপতিত্বে মূল বক্তব্য রাখেন বাপা’র সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন। বক্তব্য রাখেন ইনিসিয়েটিভ ফর পিপুলস ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)’র প্রধান নির্বাহী ড. মাহমুদুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক এম. শহিদুল ইসলাম এবং বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস প্রমুখ। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) ও পিপলস্ সার্ক পানি ফোরাম বাংলাদেশ যৌথভাবে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।