ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে ড. আতিউর রহমান

প্রতিকূলতার মাঝেও আর্থিক খাত দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ২৭ জুলাই ২০১৫

প্রতিকূলতার মাঝেও আর্থিক খাত দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের প্রায় ৭৯ শতাংশ মন্দমানের শ্রেণীকৃত ঋণ। দেশে কার্যরত ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণঝুঁকিতে রয়েছে ১১টি ব্যাংক। আর এ ঋণের ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ৫ ব্যাংকের। খেলাপী ঋণের সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ রয়েছে কৃষি খাতে। এরপরে ক্ষুদ্র খাতে রয়েছে ১৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা তৈরি পোশাক খাতে রয়েছে ১১ দশমিক ০৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০১৪ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। রবিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট-২০১৪’ এর মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গবর্নর ড. আতিউর রহমান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নরবৃন্দ, বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। গবর্নর বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ একদিনে তৈরি হয়নি। তবে খেলাপী ঋণ আমাদের জন্য এখনো উদ্বেগের বিষয়। এজন্য নতুন ঋণ প্রদানে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক হতে হবে। আর সেজন্য আমাদের নিরলস প্রয়াস চালাতে হবে যাতে খেলাপী ঋণের হার দ্রুত সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনা যায়। ড. আতিউর বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো কোন পদ্ধতিগত ঝুঁকির সম্মুখীন হয়নি। এমনকি বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চরম পর্যায়েও তা ঘটেনি। কেননা আমাদের অর্থনীতির বহির্খাত এখনো সীমিত মাত্রায় উন্মুক্ত এবং তা সচেতন ব্যবস্থাপনার আওতাধীন। গবর্নর আরও বলেন, ব্যাংকিং খাতের সম্ভাব্য বিভিন্ন ঝুঁকি ও নাজুকতা বিবেচনায় রেখে ব্যাংকগুলোকে আগাম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যাতে আর্থিক ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা কোনভাবে নষ্ট না হয়। তবে আর্থিক খাতে কোন অনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, আর্থিক খাতে কোন অনিয়ম নজরে এলে তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। গবর্নর বলেন, সামনে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিজনেস মডেল প্রচলনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হতে পারে। এছাড়াও, আমাদের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখা। ড. আতিউর রহমান বলেন, আশার কথা হচ্ছে, নানা প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের আর্থিক খাত সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং গড়ে ৬.২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন সক্ষম হয়েছে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ঈর্ষণীয়। বিশ্বের নামকরা রেটিং এজেন্সিগুলো (এসএন্ডপি ও মুডি’স) টানা ছ’বার ধরে আমাদের আর্থিক খাতের স্থিতিশীল অবস্থানের স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া, প্রথমবারের মতো ফিচ্্ রেটিং এজেন্সিও বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ‘স্থিতিশীল’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তিনি বলেন, সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সময়োচিত নীতি-পদক্ষেপের কারণে নানা প্রতিকূলতার মাঝেও আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সব সূচকে অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে Ñ যা সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। তিনি আরও বলেন, বর্তমান রিজার্ভ প্রায় ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম। অর্থনীতির এ ধারাবাহিক সাফল্য আমাদের জন্য নিশ্চয়ই আনন্দের। রেমিটেন্স ও রফতানি আয় বাড়ছে। বাড়ছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও Ñ যা দেশে বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত বহন করছে। মাথাপিছু আয় এখন ১৩১৪ ডলার। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন বলা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে ঋণ স্থিতি ছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে মোট খেলাপী ঋণ ছিল ৫০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এর মধ্যে বা ৭৮ দশমিক ৭০ শতাংশই হলো মন্দ মানে শ্রেণীকৃত, যা আদায়ের সম্ভাবনা একেবারে কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এসকে সুর চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপী ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের ঋণ বিতরণের পরিমাণ যেমন বেশি, খেলাপীর পরিমাণও বেশি। খেলাপী ঋণ আদায়ের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনার ঋণ প্রদানের বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে সব শ্রেণীর মানুষকে ঋণ প্রদান করছে। এখানে কোন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই। প্রতিবেদনে খাতওয়ারি খেলাপী ঋণের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দেখা গেছে, মোট খেলাপী ঋণের সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ রয়েছে কৃষি খাতে। এরপরে ক্ষুদ্র খাতে রয়েছে ১৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে থাকা তৈরি পোশাক খাতে রয়েছে ১১ দশমিক ০৩ শতাংশ। শিল্পখাতে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। রফতানি অর্থায়নে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ, আমদানি অর্থায়ন খাতে রয়েছে ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। জাহাজ নির্মাণ খাতে রয়েছে মোট খেলাপী ঋণের ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। এছাড়া টেলিযোগাযোগে ১০ দশমিক ০১ শতাংশ, বাণিজ্যিক ঋণে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ, ভোক্তা ঋণে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, চলতি মূলধনের ক্ষুদ্র ও মধ্যম শিল্পে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ ও ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ, সবচেয়ে কম ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ খেলাপী ঋণ রয়েছে আবাসন খাতে। জানা গেছে, বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ঋণ পুনর্তফসিলের বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল। এ সুবিধার আওতায় দেশের ১৫ শিল্পগোষ্ঠী সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করে। কিছু কিছু আবেদন বিবেচনা করে ঋণ পুনর্গঠনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বাকিগুলো দেয়া হবে বলে জানা গেছে। ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা না থাকলে খেলাপী ঋণের পরিমাণ আরও বাড়ত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তবে বর্তমানে খেলাপী ঋণের বড় অংশই মন্দমানের শ্রেণীকৃত ঋণ। এটা আদায় না হলে ব্যাংকিং ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে আমানতের ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ রয়েছে ১০ ব্যাংকের কাছে। আর অন্যান্য ব্যাংকগুলোর কাছে আছে ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ। শীর্ষ আমানত সংরক্ষণের তালিকায় রাষ্ট্রীয় মালিকানার ৪টি ও বেসরকারী মালিকানার ৬টি ব্যাংক রয়েছে। বিদেশী ও বিশেষায়িত কোন ব্যাংক আমানতে শীর্ষ ৫ বা ১০ ব্যাংকের তালিকায় নেই। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ দিয়েছে পাঁচটি ব্যাংক। দশটি ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ৪৫ শতাংশ। ঋণ বিতরণের শীর্ষে থাকা দশটি ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ৪টি, বিশেষায়িত ৩টি, বেসরকারী খাতের ১টি ও ২টি বিদেশী ব্যাংক। আর ১২টি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ আগের তুলনায় বেড়েছে, ২৭টি ব্যাংকের কমেছে আর ১৭টি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ একই রয়েছে। খাতওয়ারি ঋণ বিতরণে দেখা গেছে, বৃহৎ ও মধ্যম মানের ঋণ দেয়া হয়েছে ৬১ দশমিক ১ শতাংশ ও ক্ষুদ্র মানের ঋণ ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এসব শিল্পের মধ্যে শ্রেণীভেদে সব চেয়ে বেশি ২০ দশমিক ৮৮ শতাংশ রয়েছে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা খাতে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২০ দশমিক ৩১ শতাংশ রয়েছে বৃহৎ শিল্পে। তৃতীয় অবস্থানে থাকা আমদানি অর্থায়ন রয়েছে ১২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে রয়েছে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। কৃষিখাতে রয়েছে ৪ দশমিক ৮২ শতাংশ, সেবাখাতে ৪ দশমিক ২১ শতাংশ, রফতানি খাতে ৩ দশমিক ৯২ ও আবাসনে ৩ দশমিক ২১ শতাংশ ঋণ দেয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, ৫৬টি ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণঝুঁকিতে রয়েছে ১১টি ব্যাংক। আর ব্যাসেল-২ এর আওতায় ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে ৯১ শতাংশ ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণ করেছে। ব্যাংক খাতের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ ৩ বেড়ে ২১ হাজার ২৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যা ২০১৩ সাল শেষে ১৮ হাজার ৬১ কোটি টাকা। যদিও বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্তফসিলের কারণে তাদের নিট মুনাফা কিছুটা কমেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৩৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এর মধ্যে খেলাপী ঋণ ২০০ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততার হার বেড়ে ২১ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৩ সাল শেষে যা ছিল ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ।
×