ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিদিন ২ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে প্রতিষ্ঠান ;###;ফ্লাইটের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে

লন্ডন ফ্লাইটে অতিরিক্ত সাড়ে ৩ টন পণ্য পরিবহনে জালিয়াতি

প্রকাশিত: ০৬:১০, ২৭ জুলাই ২০১৫

লন্ডন ফ্লাইটে অতিরিক্ত সাড়ে ৩ টন পণ্য পরিবহনে জালিয়াতি

আজাদ সুলায়মান ॥ এক-দুই কেজি নয়। বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে সাড়ে তিন হাজার কেজি অতিরিক্ত কার্গো মাল ধরা পড়েছে পাইলটের দূরদর্শিতায়। হিসেবের অতিরিক্ত মাল নিয়ে ঢাকা থেকে বিমানের ফ্লাইট নিয়ে যখন লন্ডন অবতরণ করেন, তখন ওই পাইলট সেখানেই কার্গোর ওজন মাপেন। তাতেই ধরা পড়ে হিসেবের বাইরে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে পাঠানো অতিরিক্ত মাল পাচারের কাহিনী। হিসাবের বাইরে এই অতিরিক্ত মাল পাঠানো হয়েছে বিমানের কার্গো শাখা থেকে। এ পরিমাণ পণ্য পরিবহনের ভাড়া (চার্জ) আসে প্রায় এক কোটি টাকা। এ টাকা সবটাই ভাগবাটোয়ারা করে নেয় কার্গো শাখার জিএম থেকে পিয়ন পর্যন্ত সবাই। গত ৩ জুলাই লন্ডনে ফাঁস হয় এই ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা। এ ঘটনার অনুসন্ধান করতে গিয়ে তদন্তকারীরা দেখতে পায় কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার মতো কাহিনী। শুধু লন্ডন নয়, প্রতিদিনই প্রতিটি আন্তর্জাতিক রুটে এভাবে অতিরিক্তি কার্গো মাল বহন করে আত্মসাত করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দৈনিক প্রতিটি ফ্লাইটে গড়ে সাড়ে ৮ টন কার্গো মাল বহন করা হয়। এ পরিমাণ কার্গোর টাকা বিমানের তহবিলে জমা হয়। এ হিসেবে দেখা যায় যেখানে প্রতি ফ্লাইটে সাড়ে ৮ টন কার্গো বহন করে বিমান, সেখানে শুধু এক লন্ডন ফ্লাইটেই হিসাবের বাইরে জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৩ টন বহন করা হচ্ছে। এ মালের এক টাকাও বিমানের তহবিলে জমা হয় না। সবই আত্মসাত করছে কার্গোর দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট। এভাবে এ সিন্ডিকেট কমপক্ষে কার্গো শাখা থেকেই দৈনিক কমপক্ষে ২ কোটি টাকা আত্মসাত করছে। কার্গোর পিয়ন থেকে জিএম পর্যন্ত ৩১ জনের এই সিন্ডিকেট প্রতিদিন এ টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। বিমান লোকসানের অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা হচ্ছে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কার্গো শাখার লুটপাটকে। এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে একটি ফ্লাইটে এ পরিমাণ পণ্য পরিবহন বিমানকে আর্থিকভাবেই লোকসানী করছে না, ফ্লাইটের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ে। এতে বড় ধরনের দুর্ঘটনারও আশঙ্কা থাকে। বিমান জানিয়েছে, একটি অসাধু চক্রের কারসাজি করে এহেন রমরমা বাণিজ্য জড়িত। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর তাৎক্ষণিক অভিযোগ করা হয় বিমানের এমডির দফতরে। এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনা ফাঁস হওয়ায় চলছে তোলপাড়। চাঞ্চল্যকর এ জালিয়াতির ঘটনা স্বীকার করে বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল জামাল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আপনারা ভাল করে লেখেন। লিখে ফাটিয়ে দেন। এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তদন্ত চলছে।’ কিভাবে ফাঁস হলো এমন জালিয়াতি জানতে চাইলে বিমানের তদন্ত কমিটির একজন সদস্য জনকণ্ঠকে জানান, ৩ জুলাই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সকাল দশটায় বিজি ০০১ ফ্লাইটটি ঢাকা ছেড়ে যায়। তাতে ছিলেন ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক ও ক্যাপ্টেন নাদিম। যাত্রী ছিলেন ৪৯ জন। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ফ্লাইট টেক অফ করার আগে ক্যাপ্টেন ইশতিয়াক লোড শিটে দেখতে পান যে সংখ্যক যাত্রী ও কার্গো আছে তা খুবই স্বাভাবিক। তাতে জ্বালানি তেলও খুব বেশি পোড়ার মতো নয়। কিন্তু আকাশে ওঠার পর তিনি দেখতে পান এ পরিমাণ ওজনের বিপরীতে জাহাজের যে পরিমাণ জ্বালানি তেল পোড়ার কথা, তার চেয়েও বেশি তেল পুড়ছে। তখনই তার সন্দেহ হয়। ঢাকা থেকে লন্ডনে দশ ঘণ্টা উড্ডয়নের পর, মোট যে পরিমাণ তেল পোড়ার কথা তার চেয়ে অস্বাভাবিক হারে সেটা বেড়ে যাওয়ায় তার মনে সন্দেহ হয়। এতে হিথ্রো বিমানবন্দরে যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পর তিনি ওই ফ্লাইটের কার্গো মাল ওজন করান। তখন দেখতে পান ঢাকা থেকে দেয়া হিসেবের চেয়েও ৩৩৪৪ কেজি বেশি ওজনের কার্গো মাল। এ জন্যই অতিরিক্ত জ্বালানি তেল পুড়েছে। হিথরো এয়ারপোর্টে এ জালিয়াতি ফাঁস হওয়ার পর পরই সেখানকার বিমানের অপারেশন ম্যানেজার আশরাফুল ঢাকায় বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাইল হেউডের কাছে এক চিঠিতে বিস্ময় প্রকাশ করে লেখেন, লোড শিটের বাইরে জালিয়াতির মাধ্যমে এ পরিমাণ কার্গো বহন করাটা শুধু বাণিজ্যিকভাবে বিমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, এতে ওই ফ্লাইটের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। হিসেবের বাইরে এ পরিমাণ কার্গোর জন্য যে পরিমাণ জ্বালানি তেল দরকার, সেটা তো তেলের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থেকে পুড়েছে। যদি ফ্লাইটটি কোথাও কোন খারাপ আবহাওয়া বা অন্য কোন কারণে আকাশে অপেক্ষা করতে হতো, সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় ছাড়া আর কোন গত্যন্তর ছিল না। এমনই নিরাপত্তা হুমকির মুখেই কার্গো বহন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সে জন্য বিমানকে এখনই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানান, এটা শুধু জালিয়াতির মাধ্যমে দুর্নীতি নয় এটা রীতিমতো আত্মঘাতীমূলক কাজ। বিমানের হিসাব মতে এ সাড়ে তিন হাজার কেজি অতিরিক্ত কার্গোর চার্জ বাবদ ভাড়া এক কোটি টাকারও বেশি। বিমান নির্ধারিত ঢাকা থেকে লন্ডন রুটের ভাড়া কেজিপ্রতি ২৫ পাউন্ড। এ হিসেবে সাড়ে ৩ হাজার কেজি মালের ভাড়া আসে ১ কোটি টাকারও বেশি। কার্গো শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে এ পরিমাণ মাল পাঠানোর কারণে বিমান এ টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটা শুধু একদিনের চিত্র নয়। প্রতিদিনই এভাবে হাজার হাজার কেজি মাল জালিয়াতির মাধ্যমে বিমানে পাঠানো হচ্ছে। তাহলে কাদের পকেটে গেছে এ টাকা? এ সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা যায়, বিমানে দু’ধরনের মাল বহন করা হয়। একটি যাত্রীর সঙ্গে নিজস্ব লাগেজ, অপরটি কার্গোর মাল। যাত্রীর লাগেজের দায়ভার থাকে কাস্টমার সার্ভিসের ট্রাফিক শাখার ওপর। বিমানবন্দরে চেক ইন কাউন্টারে যারা থাকে, তারাই এ লাগেজের কম-বেশি করার সঙ্গে জড়িত। আর কার্গো মালের দায়ভার বিমানের কার্গো শাখার ওপর। লন্ডনে যেটা হয়েছে সেটার সঙ্গে জড়িত কার্গো শাখার চিহ্নিত সিন্ডিকেট। তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা যায়, বিমানের রফতানি কার্গো ভবনেই এ অতিরিক্ত মাল তোলা হয় ওই ফ্লাইটে। এখানে কর্মরত বিমানের নিরাপত্তা শাখা, কাস্টমস ও কার্গো কর্মকর্তা- কর্মচারীদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট বছরের পর বছর ধরে এভাবে অতিরিক্ত কার্গো জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত। এ জালিয়াতি গত তিন বছরে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বার বার এসব চিহ্নিত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ ধরা পড়লেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। রবিবার ওই ভবনে গিয়ে দেখা যায়, একটি সিন্ডিকেট গত কয়েক বছর ধরে একই সেকশনে ঘাপটি মেরে আছে। তাদের যোগসাজশেই কাস্টমস এবং কার্গো কর্মকর্তারা প্রতিদিন প্রতি ফ্লাইটে এভাবে অতিরিক্ত মাল তুলে দেয় ফ্লাইটে। এর সঙ্গে আছে রফতানিকারক কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, যাদের কাছ থেকে কার্গোর মূল ভাড়ার চেয়ে কম মূল্য আদায় করে হিসেবের বাইরে রাখা হয়। এভাবে অতিরিক্ত মাল পাচার করে প্রতিদিন কার্গো শাখা থেকে অবৈধ পন্থায় হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ২ কোটি টাকা। এ টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয় পিয়ন থেকে শুরু করে জিএম পর্যন্ত। তদন্ত কমিটির প্রধান ডিজিএম আব্দুল ওয়াদুদ জানানÑ লন্ডনের ঘটনায় ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু হয়েছে। ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। ইতোমধ্যে তদন্তের প্রশ্নাদি তৈরি করা হয়েছে। এখন জিজ্ঞাসাবাদের পালা। আগামীকাল থেকে শুরু করা হবে। এদিকে কার্গো শাখার অতিরিক্ত মাল বহনের মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের ঘটনায় বিমানের নিরাপত্তা শাখার বেশ কজন কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কার্গো শাখা থেকে যখন ওই ফ্লাইটে অতিরিক্ত মাল লোড করা হয় তখন সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তার ভূমিকা সন্দেহজনক হওয়ার পরও তাকেই ওই তদন্ত কমিটিতে রাখা হয়েছে। এমন একজন অভিযুক্ত দিয়েই তদন্ত কমিটি গঠন করায়ও প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ডিজিএম আব্দুল ওয়াদুদ জনকণ্ঠকে বলেন- আমি তো তদন্ত কমিটি গঠন করি না। কর্তৃপক্ষ যাকে ভাল মনে করেছে তাকেই দিয়েছে। তবে নিরাপত্তা কর্মকর্তা রেজার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে তাহলে তাকে পাল্টে দেব। আমি সঠিকভাবেই তদন্ত করব। দোষীরা যতই প্রভাবশালী হোক ছাড় পাবে না। তদন্তে যা উঠে আসে- সেটাই জমা দিয়ে দেব। কার্গোর লোকজন জড়িত না হলে কি সম্ভব অতিরিক্ত লাগেজ জাহাজে তোলা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছুই জানাতে পারেননি। এ বিষয়ে জনসংযোগ শাখার মহাব্যবস্থাপক খান মোশাররফ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, তদন্তের পর দেখা যাবে- কে দোষী কে নির্দোষ। কার্গো শাখায় যুগ যুগ ধরে ঘাপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেট এতই শক্তিশালী যে বিমান কখনই কোন ব্যবস্থা নিতে পারছে না। রবিবার কার্গো ভিলেজে গিয়ে দেখা যায়, এ ঘটনার পর থেকে মাল মাপার স্কেলের পাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ সময় সেখানকার কর্তব্যরতরা জানান, শুধু লন্ডন নয়, দুবাই, রিয়াদ, দাম্মাম, জেদ্দা, মাসকট, কুয়েত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের প্রতিটি ফ্লাইটেই অতিরিক্ত কার্গো মাল বহন করা হয়। লন্ডনের মতো প্রতিটি ফ্লাইটেই অতিরিক্ত মাল পাঠানো হয়, যা থেকে আদায়কৃত ভাড়া বিমানের তহবিলে জমা না হয়ে চলে যায় সিন্ডিকেটের পকেটে। এভাবে বিমান প্রতিদিন রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে এ ধরনের ভয়াবহ জালিয়াতি। বিমান প্রশাসন কখনও এদিকে নজর দেয়নি। এ ঘটনার পর এখনও পর্যন্ত বিমানের কোন উর্ধতন কর্মকর্তা কার্গো পরিদর্শনও করেননি। তাদের মনোভাব দেখে মনে হয়, এগুলো তেমন কোন অপরাধ বা ব্যাপার নয়। এ ধরনের ভয়াবহ জালিয়াতি ফাঁস হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করে বিমানের এক পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, এ চক্র এতই শক্তিশালী যে বিমান তাদের বিরুদ্ধে অতীতেও কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এবারও পারবে না। বিমানের সদিচ্ছা থাকলে, লন্ডন থেকে অভিযোগ পাবার সঙ্গে সঙ্গে কার্গো শাখার দায়িত্বে থাকা জিএম, ডিজিএমসহ জড়িত সব কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করতে পারত। অভিযোগ পাবার সঙ্গে সঙ্গে এ্যাকশন নেয়ার পরে তদন্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু যারা অপরাধী তাদের ওই চেয়ারে বহাল তবিয়তে রেখে, তদন্ত কতটা স্বচ্ছ হবে সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
×