ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামী অবিচলানন্দ

উল্টোরথ

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ২৭ জুলাই ২০১৫

উল্টোরথ

কথায় বলে সনাতন ধর্মাবলম্বী হিন্দুদের অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। এগুলোর মধ্যে শ্রীশ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ও উল্টোরথ মানে পুনর্যাত্রা ইত্যাদি উৎসব সামাজিকভাবে বৈশিষ্ট্যম-িত। পুরাণ মতে, প্রায় দু’হাজার বছর পূর্ব থেকেই রথযাত্রা ও উল্টোরথ উৎসব প্রচলিত। ষড় ঋতুর দ্বিতীয় ঋতু মানে আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ার্ধে জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়। এর এক সপ্তাহ পর উল্টোরথ উৎসব হয়ে থাকে। রথোপরি ডানে প্রভু জগন্নাথ মাঝখানে তাঁর বোন সুভদ্রা এবং বামে বলভদ্র। ভক্তদের বিশ্বাস, রথোপরি আসীন দেবমূর্তি দর্শন ও রথ টেনে নেয়ার সুযোগ তাঁদের জন্য দেবতার আশীর্বাদ লাভের সহায়ক। কঠোপনিষদে আছে আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ ॥ (কঠ. উপ-১.৩.৩) অর্থাৎ, আত্মা হলেন রথী বা রথের মধ্যে অবস্থানকারী। রথ হলো শরীর বা দেহযন্ত্র। বুদ্ধি হলো সারথি বা চালক। মনকে লাগামের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইন্দ্রীয়গুলো অর্থাৎ অশ্ব বা ঘোড়ার সঙ্গে তুলনা করা যায়। পৃথিবীতে যত রকম ভোগ করার বিষয় আছেÑ সেই বিষয়গুলো হলো রথের গমনপথ বা সড়ক। অশ্ব বা ঘোড়াগুলো ভাল হলে অর্থাৎ সুনিয়ন্ত্রিত হলে রথটিকে সারথি সঠিকভাবে লক্ষ্যপথে পৌঁছে দিতে পারবে। আর যদি দুষ্ট হয় অর্থাৎ অসংযত হয়, তাহলে রথকে তারা কোথায় নিয়ে ফেলবে, কে জানে? প্রকৃতপক্ষে, মানবের জীবন রথের প্রতীক মাত্র। ভোগের পথ ছেড়ে মুক্তির পথে যে যেতে চায়, তার জীবন সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। শান্ত হতে হবে, সমাহিত হতে হবে। রথের রথী অর্থাৎ অন্তর্যামী, তিনি নির্লিপ্ত। তাঁর যথার্থ স্বরূপ এই নির্লিপ্ততা। সেই স্বরূপকে এই দেহরথের মধ্যে উপলব্ধি করতে হবে। অতি সূক্ষ্ম সেই অন্তরাত্মা পুরুষ মানুষের হৃদয়ে সর্বদা অবস্থান করেন। তিনিই রথী। এই রথীর দর্শন বা সাক্ষাতকার হলেই মুক্তি। ‘রথে তু বামনং দৃষ্টা পুনজন্ম ন বিদ্যতেÑ অর্থাৎ আমাদের দেহ ও শরীররূপ রথে আত্মারূপ বামন মানে পরমব্রহ্ম শ্রীভগবানকে দর্শন করতে পারলে দুঃখ-সুখ, রোগ-ব্যাধি, কাম-কীট পূর্ণ এ শরীর আর পুনরায় ধারণ করতে হয় না এবং এ পৃথিবীতে গমনাগমন করতে হয় না। উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জনগণ রথযাত্রা ও উল্টোরথ উৎসব পালন করেন। ভারতবর্ষে উড়িষ্যার পুরীতে মন্দিরে রথযাত্রা ও উল্টোরথ উৎসব উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশের ধামরাইয়ের রথযাত্রা উৎসবও অত্যন্ত বিখ্যাত। শ্রীশ্রী জগন্নাথাষ্ঠকম্ এ পাই... সুরেন্দ্রৈরারাধ্যঃ শ্রুতিগণশিখা-গীতচরিত জগন্নাথঃ স্বামী নয়নপথগামী ভবতু মে... যিনি দেবগণের আরাধ্য-ধন এবং বেদ, পুরাণ তন্ত্রাদি শাস্ত্রসমূহ যাঁর চরিত্র গান করছেন, সেই জগন্নাথদেব আমার নয়ন-পথের পথিক হন। রথোৎসব ও উল্টোরথোৎসব চলমান...মন্দিরে বিগ্রহের পূজানুষ্ঠান। সাধারণত মন্দিরেই বিগ্রহের পূজানুষ্ঠান হয়ে থাকে। মন্দির অভ্যন্তরে পূজায় সাধারণের অংশগ্রহণ সম্ভবপর নয়। কিন্তু এই রথোৎসবে ধর্ম, বর্ণ, মত ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণের এক বিরাট সুযোগ রয়েছে। বর্ষার এই পুণ্যলগ্নে জগন্নাথ দেবের নিকট প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন বিশ্বের সকল মানুষ এবং সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে সমগ্র বিশ্বের আপামর জনসাধারণকে সুখে-শান্তিতে ও আনন্দে রাখেন। লেখক : সন্ন্যাসী মহারাজ, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা
×